বালিসের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে সময় দেখলো সাইরা- রাত এখন আড়াইটা বাজে। শেয়াল আর কুকুরের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে। বহুদিন পর আজ একটু শান্তি করে ঘুমোতে চেয়েছিলো, তা আর হলো না। বাইরে কয়েকটা শেয়াল কিছু একটা কাড়াকাড়ি করছে আর পাড়ার নেড়ী কুত্তাটা দূরে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। কাছে ঘেঁসতে সাহসে কুলোচ্ছে না ওর। জানালাটা খোলা ছিলো তাই শব্দটা বেশি আসছে। বিছানা থেকে উঠে জানালা আটকাতে গেলো সাইরা। হঠাৎ কি মনে হতে, টর্চটা হাতে নিলো- কি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে?
বাইরে টর্চের আলো ফেলতেই ডাকাডাকি থামিয়ে দিয়েছে শেয়ালগুলো শুধু দূরে দাঁড়িয়ে কুকুরটা ডেকেই চলেছে। শেয়ালগুলো পিছিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢেুকে যাচ্ছে , শুধু একটা শেয়াল হতভম্বের মতো টর্চের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো টর্চের আলোর কারণে চোখে দেখছে না। মুখে কিছু একটা ঝুলছে যেনো। ভালো করে লক্ষ্য করলো ছাইরা। আঙ্গুলগুলো অপরিণত। একটা মানব শিশুর হাত!! হাত থেকে টর্চ পড়ে গেলো, কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লো সাইরা। মনে হলো আজ যাকে সে নিজের দেহ থেকে আলাদা করেছিলো তাকে নিয়েই যেনো শেয়ালের হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। ডুকরে কেঁদে উঠলো সাইরা। অ্যাবর্শনের পর থেকে এ পর্যন্ত যা কাঁটার মতো বিঁধেছে এখন তা ছুরি হয়ে গলায় বসতে চাচ্ছে।
তনু ওকে বলেছে যে মাস দুয়েকের মধ্যেই বিয়েটা সেরে ফেলবে। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে ও। চেহারা সুরতে খুবই স্মার্ট। এমন একটা ছেলেকে ও সবসময়ই চেয়েছে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে। ভার্সিটিতে পরিচয়। অন্য ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই ছিলো তনু। ওরই এক বান্ধবীর মাধ্যমে প্রেমের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো। প্রথমে না করতে হয় তাই করেছিলো কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জমে ওঠে প্রেম। ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে শেষমেশ আজকের পরিণতির জন্যে এককভাবে কেউই দায়ী না। কিভবে কি হয়ে গেলো কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না ওরা। এ অবস্থায় কাউকেই ব্যপারটা জানানো যাচ্ছিলো না। আবার সমস্যা দিন দিন স্পষ্ট হয় উঠছিলো।
শেষ কাজটা করার আগে অনেকবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে সাইরা। ‘তুমি কি তোমার সন্তানকে হত্যা করবে??’ মন মানতে চায়নি কখনো, কিন্তু উপায় কি?? ওর ভালোর জন্যই ওকে পৃথিবীর আলো দেখানো যাবে না। মানুষ ওকে দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে, অবৈধ বলবে তা হতে দেবে কেনো সাইরা। মা হয়ে এসব ওর সহ্য হবে না। কিন্তু একটু আগে ও যা দেখলো তার কি হবে…?? আঙ্গুলগুলো অপরিণত হলেওতো ওগুলো ওর সন্তানেরই আঙ্গুল। ঐ আঙ্গুলগুলো হাতের মুঠোই করে পরিণত করে তোলাই তো ওর মাতৃত্বের দাবি ছিলো। কিন্তু আজ অপারেশন থিয়েটারে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে তাকে। তনু ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। অপারেশনের সব ব্যায় ওই বহন করেছে। সবসময় ওকে সাপোর্ট দিয়েছে কিন্তু তারপরও ও মানতে পারছে না। জীবনকে ওরা অন্যভাবে সাজাবে ভেবেছিলো। জেনে বুঝে, একে অপরকে পরিপূর্ণরূপে চিনে তারপর। কিন্তুু এরই মাঝে যে তাদের দুজনের সাক্ষ্য রক্ত মাংশে প্রকাশিত হতে চাবে সেটা তারা ভাবেনি কখনো। এই সাক্ষ্যকে লুকোতেই এতো কিছু। নিজেকে খুনি ছাড়া আর কিইবা ভাবতে পারবে এখন। যেই মা তার গর্ভের সন্তানকে খুন করেছে…!!! এর চেয়ে নিষ্ঠুর খুনি আর পৃথিবীতে আছে কি??
শেয়ালের ডাকাডাকি থেমে গেছে। ফিরে গেছে নেড়ীটাও। তনু হয়তো ঘুমোচ্ছে এখন। সাইরার চোখে ঘুম নেই…
“এভাবেই নয় শুধু, কখনো ছেলে সন্তানের প্রত্যাশায়, কখনো নিজেকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আবার কখনো নির্লজ্জ লালশার বসে আমরা হয়ে যাই নিকৃষ্ট খুনি।”