সবার মধ্যেই দেখেতে পাচ্ছি আমাকে নিয়ে উদ্বেগ। আমার দিকে তীর্যক চোখের দৃষ্টি।
ফিসফিসিয়ে কথা। এই তুমি লাইন ভেঙে এগুচ্ছো কেন? দেখছ না আমরা আছি?
আমরা তোমার মুরব্বী। বয়সে তো বড়?
আমি বুঝলাম না, আমার একটা পা একটু আগ বাড়ানো বটে। কিন্তু আমি তো লাইন ভেঙে যাইনি।
আমি তো নড়িনি। কেন সবাই ভাবছে আমি তাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছি?
আমার চেহারাটাও আমি যতদূর জানি বেয়াদবের মতো নয়। তাছাড়া আমি
অদৃশ্য পাখা কোথায় পাবো? আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেন
মানুষ ভাবে আমি তাদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছি? ভেতর দিয়ে
চলে যাচ্ছি? ভেদ করে যাচ্ছি, প্রভেদ করে যাচ্ছি?
হায় আল্লাহ! প্রভু আমার আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেন গতির সৃষ্টি হয়।
আমি স্থানু। কিন্তু অন্যের বিবেচনায় অশ্বারহী। যদি আমার নিয়তি আমাকে
এমনভাবে আকাশ ফাটানো বিদ্যুতের ঝিলিকে ছড়িয়ে দেয়, আমার কী করার আছে?
ঘাড় ফিরিয়ে দেখি সবাই আমার চেনা, আমার আত্মীয়, পরম কুটুম্বের মুখোশে ঢাকা
ওইসব প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখোশ টেনে ছেঁড়ার দায়িত্ব তো আমার নয়, আর আমি দাঁড়িয়েও
থাকতে চাই না। লাইন ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার যে নেই, এমন তো নয়।
আমি তো প্রকৃতপক্ষে সব সীমা ছাড়িয়ে উপচিয়ে পড়তে চাই। কিন্তু আমি
বিবেকহীন নই, ধর্মহীন নই, মানুষ্যত্বহীন নই। যারা আমার পোশাক টেনে ধরেছে
তারা জানে আমাকে আটকে রাখার ক্ষমতা তাদের আর নেই। আমাকে পরাভূত
বানাতে পারে যারা, তারা তো কেউ এ লাইনে এসে দাঁড়ায়নি। দাঁড়ায়নি অবশ্য
তাদের অনুকম্পার জন্যে, ভালবাসার জন্যে। এ প্রতিযোগিতায় সেই নারীকেও
দেখছি না, যার ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে আমি ভষ্ম হয়ে যাই এই ভয়ে পৃথিবীতে সারা
জীবন আমি পালিয়ে বেড়ালাম। গাছের আড়ালে, পর্বত ও গিরি-শৃঙ্গের
পেছনে মুখ লুকিয়ে থাকলাম।
কিন্তু তবু আমার লাইনের অগ্রগামীরা ভাবছে আমি তাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছি। মাড়িয়ে
যাচ্ছি কিংবা সবাইকে হারিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছি।
আমার আত্মার ভেতরে এক গোপন প্রেরণার শিখা দেখতে পাচ্ছি বটে। কিন্তু আমি তো
তা নিজে জ্বালাইনি। আমার প্রভুর দিকে বার বার সিজদা দিতে দিতে
অকস্মাৎ মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি কী যেন একটা ঘটে গেছে। আমার
সুরত আগের মতোই ঠান্ডা, চোখে বিদ্যুতের বিভা। কেউ না জানলেও
আমি তো জানি আমার পিঠে অগ্রভেদী দু’টি ডানার নিক্কণ। আমি
ছাড়িয়ে যাবো এটা কোনো ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হলো, যারা আমার দাঁড়িয়ে
থাকাতেও গতির বিদ্যুৎ দেখতে পায় তারা ঈর্ষাকাতর। মৃত্যুর স্তব্ধতায় তারা স্থবির।
যারা নিঃশ্বব্দ গতির ধাবমানতাকে নিজেদের মাথা দিয়ে মাপে তারা বামন।
আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও তাদের ছাড়িয়ে যাই।