পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সুনির্দিষ্টভাবে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক আদর্শে পরিণত হয়েছে। কোনো কারণেই ভারতীয় মুসলমান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে না।
ভিন্ন নেতৃত্বের বাস্তববাদী দূরদর্শিতার গুণে মুসলিম লীগ রাজনীতিতে জাতীয়তার যে সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে, তাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানেরও স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত ও সম্ভব হয়ে উঠেছে। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত রূপায়ণের ভাবী রূপ নিয়ে মুসলিম বাংলার চিন্তা-নাগরিকদের মধ্যে এখন থেকেই আন্দোলন-আলোচনা খুব স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি যে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকার অভিনয় করছে, সে সম্বন্ধে বাংলার মুসলমান এমনকি, তাঁদের শিক্ষিতাংশও, আজও পুরোপুরি সচেতন হননি। বিশেষত এই ‘সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণস্বরূপ ‘আজাদ’ সম্পাদক মাওলানা আবুল কালাম শামসুদ্দীন ও সহসম্পাদক মাওলানা মুজিবর রহমান খাঁ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাঙ্গিক রূপায়ণে যে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার দায়িত্ব বহন করে যাচ্ছেন, তা ভবিষ্যৎ বাংলা একদিন শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, এ সম্বন্ধে আমার মনে তিলমাত্রও সন্দেহ নেই। বস্তুত, পাকিস্তানবাসীকে একটা নিছক রাজনৈতিক, এমনকি নির্বাচনী স্লোগান থেকে একটা ইন্টেলেকচুয়াল আইডিয়ালিজমে রূপান্তরিত করেছে প্রধানত এই দুই ব্যক্তির মনীষা। আমি একাধিকবার স্বীকার করেছি এবং আজও অসংকোচে স্বীকার করছি যে প্রধানত এঁদেরই প্রেরণায় আমি পাকিস্তানের আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। কায়েদ-ই-আযমের মনে যা-ই থাক, বাংলায় পাকিস্তানবাদ নিশ্চয় পার্লামেন্টারি কচকচিতে খেই হারিয়ে ফেলত, যদি না এই দুজন ব্যক্তি নানা বিপদ ও অপ্রীতি অগ্রাহ্য করে নিশিদিন কলম চালিয়ে পাকিস্তানবাদকে এই ইন্টেলেকচুয়াল রূপ দিতেন এবং অনেক প্রতিপত্তিশালী লোকের অপ্রীতি ও অসন্তোষভাজন হয়েও চরম বিপদের মুহূর্তেও সে আদর্শবাদের ঝান্ডা উঁচু রাখতেন।
এই দুই ব্যক্তিই আমার নিতান্ত আপনার জন। তবু ওপরের কথাগুলো মোটেই ব্যক্তিগত প্রশংসার মতো শোনাবে না এই জন্য যে তাঁরা মুসলিম-বাংলার ইন্টেলেকচুয়াল রূপায়ণে যে বিপুল দান করেছেন ও করছেন, তার তুলনায় আমার মন্তব্য অতিশয়োক্তি তো নয়ই, যথেষ্টও নয়।
কিন্তু আমার আজকার আলোচনার জন্য এটা নেহাত দরকারি। কারণ, তথারা শুধু ‘পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটিরই জীবনস্বরূপ নন, পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় দৈনিক ‘আজাদ’-এর কান্ডারিও বটে।
আমার আজকের আলোচ্য বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের জবান। আমার মতো লেখকেরা মুসলিম-বাংলার শিক্ষিতাংশের সঙ্গে কথা বলেছে কালে-ভদ্রে। আর তাঁরা তাঁদের কাছে কথা বলছেন রোজ সকালে। আমরা পাকিস্তান চাইনি; বরং গোড়ার দিকে ব্যক্তিগতভাবে আমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধতা করেছি। কারণ, আমাদের রাষ্ট্রাদর্শের স্বপ্ন ছিল অন্য রকমের। ফলে পাকিস্তানবাদের ইন্টেলেকচুয়াল আকৃতির জন্য সমস্ত প্রশংসা তাঁদেরই প্রাপ্য। আমাদের তাতে কোনো অংশ নেই। এমনকি আমার বিশ্বাস, বাংলার লীগের বড় বড় পার্লামেন্টারি নেতারও তাতে কোনো অংশ নেই। গোটা প্রশংসা ‘আজাদ’-এর।
প্রশংসা যেমন তাঁদের, দায়িত্বও প্রধানত তাঁদেরই। এর কারণ আগেই বলেছি যে তাঁরা রোজ দেশবাসীর সঙ্গে আছেন। আরেক কারণ এই যে মুসলিম-বাংলার শিক্ষিতগণের মনে, আসনে তাঁদের দোসর নেই।
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক রূপায়ণ নিয়ে যথেষ্ট না হলেও অনেক আলোচনাই তাঁরা করেছেন। আমরাও সে আলোচনায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কী হবে, এ নিয়ে সোজাসুজি আলোচনা তাঁরা আগে করেননি। করেননি বোধ হয় এই জন্য যে পূর্ব পাকিস্তানের ‘জাতীয় দৈনিক ‘আজাদ’ বাংলা ভাষার কাগজ এবং এঁরাও তা-ই ধরে নিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা যে বাংলা হবে, এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েই আছে।
হয়েই ছিল সত্য। বাংলার মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা হবে কি উর্দু হবে, এ তর্ক খুব জোরেশোরেই একবার উঠেছিল। মুসলিম-বাংলার শক্তিশালী নেতাদের বেশির ভাগ উর্দুর দিকে জোর দিয়েছিলেন। নবাব আবদুর রহমান মরহুম, স্যার আবদুর রহিম, মো. মনসুর হক, ডা. আবদুল্লাহ, সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবুল কাসেম মরহুম প্রভৃতি প্রভাবশালী নেতা উর্দুকে বাঙালি মুসলমানের ‘মাতৃভাষা’ করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম-বাংলার সৌভাগ্য এই যে উর্দুপ্রীতি যাঁদের বেশি থাকার কথা, সেই আলেমসমাজই এই অপচেষ্টার বাধা দিয়েছিলেন। বাংলার আলেমসমাজের মাথার মণি মাওলানা মোহাম্মদ আকবর খাঁ, মাওলানা আবদুল্লাহেল বাকী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী উর্দুবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব করেছিলেন। তাঁদের প্রয়াসে শক্তি জুগিয়েছিলেন মরহুম নবাব আলী চৌধুরী সাহেব। সে লড়াইয়ে তাঁরাই জয়লাভ করেছিলেন। বাংলার ওপর উর্দু চাপানোর সে চেষ্টা তখনকার মতো ব্যর্থ হয়।
কিন্তু নির্মূল হয়নি। বাংলার বিভিন্ন শহরে, বিশেষত কলকাতায়, মাঝে মাঝে উর্দু কনফারেন্স করে করে উর্দুওয়ালারা নিজেদের আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছিলেন। সম্প্রতি পাকিস্তান আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদ তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শের বনিয়াদে পরিণত হওয়ায় উর্দুওয়ালারা আবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি ‘মর্নিং নিউজ’ ও ‘স্টার-অব-ইন্ডিয়া’ এ ব্যাপারে কলম ধরেছে। জনকতক প্রবন্ধ লেখকও তাতে জুটেছেন। তাঁরা বলছেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা স্বভাবতই উর্দু হবে।
মুসলিম লীগ মুসলমানদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বলে অধিকাংশ মুসলমান দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে। বাংলায় লীগ-সমর্থক মুসলিম দৈনিক খবরের কাগজের মধ্যে একটি মাত্র বাংলা; দুইটা ইংরেজি আর সব উর্দু। এই দুটি ইংরেজি কাগজও যদি উর্দুর পক্ষে প্রচার চালায়, তবে বিপদ যথেষ্ট রয়েছে, এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তবু আমরা আশা করতে পারতাম যে এক ‘আজাদ’ই ওই দুটি ইংরেজি ও চার-পাঁচটা উর্দু দৈনিকের প্রচারের মুখে দাঁড়াতে পারবে যদি-না অন্য কতকগুলো ব্যাপারও আমাদের মুখালেফ হতো।
পয়লা ধরুন বাংলার নেতাদের কথা। লীগ মন্ত্রিসভাই বলুন, প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটিই বলুন, লীগ রিলিফ কমিটিই বলুন, মুসলিম চেম্বার অব কমার্সই বলুন, প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগের অ্যাডহক কমিটিই বলুন, নিখিল ভারতীয় যেকোনো ব্যাপারে মুসলিম-বাংলার প্রতিনিধিত্বই বলুন, কলকাতা করপোরেশনের মেয়র-ডেপুটি মেয়রগিরির যোগ্য মুসলমান বাছাইয়ের ব্যাপারই বলুন, এসব ব্যাপারের যেকোনোটিতে আমরা যখন মুসলিম-বাংলার বাছাই করা আধা ডজন নেতার নামের মোকাবিলা হই, তখন যাঁদের আমরা দেখি, তাঁরা শুধু যে নিজেরাই বাংলা বলেন না তা নয়; লাটসাহেবের সামনে বরং বাংলায় মনোভাব প্রকাশের ভরসা করতে পারেন।
কিন্তু এসব নেতার সামনে সে ভরসা নেই। সোজা কথায়, মুসলিম বাংলার তকদিরের রাজমিস্ত্রি, ইঞ্জিনিয়ার এবং শুভ রসিয়ারেরা সবাই উর্দুভাষী।
তার বাদে ধরুন, বাংলার রাজধানী কলকাতার কথা। কলকাতা ভারতবর্ষের আন্তর্জাতিক শহর। এখানকার রাস্তার ভাষা উর্দু। এ শহরের বাংলা খবরের কাগজের সংখ্যার চেয়ে উর্দু-হিন্দি খবরের কাগজের সংখ্যা কম নয়। মুসলমানদের বেলায় এটা আরও গুরুতর। অর্থাৎ কলকাতাবাসী অধিকাংশ মুসলমানের ঘরের ভাষাও উর্দু। তাঁদের বাংলা খবরের কাগজের চেয়ে উর্দু খবরের কাগজের সংখ্যা বেশি। তাহ্জিব, তমদ্দুন ও শিক্ষাগত ব্যাপারে রাজধানীর প্রভাব দেশের জনসাধারণের ওপর কত বেশি, সেটা সবাই জানেন। এই দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, মুসলিম-বাংলার ভাষাগত ভাগ্যনির্ণয়ের ব্যাপারে রাজধানীর প্রভাব বাংলা ভাষার মুখালেফ।
এর সঙ্গে বিচার করতে হবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বর্তমান নেতা হিন্দু ভ্রাতৃগণের ভাবগতিক এবং বাংলার শিক্ষা বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তাদের শিক্ষানীতির কথা। বাংলার মুসলমানের জবানি বাংলা এঁদের কাছে অস্পৃশ্য; মুসলমানদের নিত্যব্যবহার্য শব্দ বাংলা সাহিত্যে অপাঙ্ক্তেয়। হিন্দুর মন্দিরের মধ্যে তুর্কি টুপি পাওয়া গেলে যেমন হইচই লেগে যাবে বলে অনুমান করা যেতে পারে, বাংলা বইয়ে ‘আল্লাহ’, ‘খোদা’ ও ‘পানি’ দেখা গেলে হইচই তার চেয়ে কম শুরু হয় না। তাঁদের খুব জোরের কথা এবং সুস্পষ্ট অভিমত এই যে বাংলা ভাষায় ‘ওসব আরবি-ফারসি শব্দ চলবে না।’ ‘আমি পানি খাব’, ‘আমরা আল্লাহর ইবাদত করি’—এটা তাঁদের মতে শুদ্ধ বাংলা নয়। পরীক্ষার কাগজে ওসব লিখলে নম্বর কাটা যাবে। মুসলমানরা ইচ্ছে করলে ওভাবে কথা বলতে পারে বটে কিন্তু লেখার সময় শুদ্ধ বাংলায় লিখতে হবে ‘আমি জল খাব’, ‘আমরা ভগবানের উপাসনা করি’। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বর্তমান দিকপালদের মতে, মুসলমানদের মুখের ভাষা বাংলা নয়। এখানে বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা, বাংলা সাহিত্যের মুরব্বিরা উর্দুওয়ালাদের সঙ্গে একমত। কাজেই এ অবস্থাটাও উর্দুরই অনুকূল।
ওপরে যে চারটা অবস্থার বর্ণনা করা গেল, তার প্রতিটাই গুরুতর; আর চারটির সমবেত শক্তিতে নিশ্চয়ই গুরুতর। কিন্তু এদের গুরুত্ব যে শেষ পর্যন্ত মুসলিম-বাংলার ভাব নির্ধারণে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে, এটা আজও তেমন সুস্পষ্ট নয়। সুস্পষ্ট নয় বলেই বিপদ আরও বেশি। এ রকম ক্ষেত্রে বিপদ এমন হঠাৎ আসবে যে তখন ঠেকানো দায় হবে। ঠেকানো দায় হবে দুইটা কারণে। যাঁরা উর্দু প্রবর্তনের বিরোধী, তাঁদের মনোভাবটা উপেক্ষার মনোভাব। তাঁরা ভাবেন, ‘ওসব কিছু না। মুসলিম-বাংলার ওপর উর্দু চাপানোর চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।’ ব্যর্থ হতে যে বাধ্য, সে সম্পর্কে দুই মত নেই। কিন্তু চেষ্টা যে হতে পারে এবং সে চেষ্টার অনুকূলে পরিবেশও যে চমৎকার, ওপরে আমি শুধু তারই উল্লেখ করেছি।
অপর যে কারণে উর্দু প্রবর্তনের অপচেষ্টা ঠেকানো দায় হবে, তা এই যে কার্যত এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ লোকের সংখ্যা কম হবে না। তাঁরা সমাজের চিন্তাহীন অংশ; যেকোনো অবস্থায় আত্মসমর্পণ করার মতো নির্বিরোধ তাঁদের প্রকৃতি। তাঁরা ভাবেন, হোক না উর্দু, দোষ কী তাতে? নিতান্ত তর্ক উঠলে তাঁরা জবাব দেবেন, মুসলমান জনসাধারণের শতকরা ৯৫ ভাগই যখন নিরক্ষর, তখন তাঁদের উর্দু শেখানো যা, বাংলা শেখানোও তাই। বলা দরকার, এটা গুরুতর রকমের ভুল যুক্তি। একটু পরেই এই যুক্তির গলদ দেখানো হবে।
পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি মসলিম-বাংলার ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্টের প্রতীক। এই সোসাইটি স্বভাবতই ওই বিপদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। সোসাইটির একাধিক বৈঠকে এ সমস্যার আলোচনাও হয়েছে। হাজিরানে মজলিশের বিপুল মেজরিটি উর্দুর বিরুদ্ধে মত এজহার করেছেন। কিন্তু উর্দুর পক্ষে যাঁরা বলেছেন, তাঁদের সংখ্যা ও যুক্তিও নিতান্ত তুচ্ছ ছিল না। রেনেসাঁ সোসাইটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়, কাজেই তাতে ভোটাভুটিও হয় না; কোনো জাবেদা প্রস্তাবও গৃহীত হয় না। এখানে যুক্তিতর্কের দ্বারা শুধু প্রচার করা হয়। এখানে মাইনরিটি মেজরিটির মতো মেনে চলতে বাধ্য নন। মেজরিটি পক্ষের যুক্তিতর্কের ফলে মাইনরিটি দলের কতজন তাঁদের মত বদলিয়েছেন, তার ঠিক ঠিক হিসাব ধরাও সম্ভব নয়। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে, মুসলিম-বাংলার চিন্তকদের মধ্যে যতই ছোট হোক এক দল রয়েছে, যারা উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করার পক্ষপাতী।
এ থেকে নিশ্চয় এটা বোঝা উচিত হবে যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে, এমনকি তার আগে থেকেই, বাংলায় উর্দু অভিধান হওয়া মোটেই অবাস্তব কল্পনামাত্র নয়; এবং সে চেষ্টা হলে তাতে বাধা দেওয়াও খুব সহজ হবে না।
তবে কি সে চেষ্টা সফল হবে? তাও হবে না। হলে উর্দুর বিরুদ্ধে আমাদের কোনো আপত্তিই হতো না। কারণ, বৈজ্ঞানিক মনে ভাষা সম্বন্ধে কোনো কুসংস্কার নেই। মুক্তবুদ্ধির মানুষের কাছে ভাষায়-ভাষায় পক্ষপাতিত্বের কোনো ইতরবিশেষ থাকা উচিতও নয়। ভাষার বিচার হবে শুধু বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে। ছাপাখানা, টাইপ-রাইটিং, টেলিগ্রাফ, পরিভাষা, আন্তর্জাতিকতা ও বর্ণমালার নিতিক বৈজ্ঞানিকতা প্রভৃতি আধুনিক গুণাবলির দ্বারা ভাষার ভালো-মন্দের বিচার হতে পারে, অন্য কিছুতে নয়। কাজেই এসব গুণনির্বিশেষে এবং দোষ-গুণ নিরপেক্ষভাবে উর্দুর বিপক্ষে বা বাংলার পক্ষে আমাদের মনে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই।
ভাষা হিসেবে আমরা উর্দুর নিন্দুক নই। আমরা শুধু বাংলার ওপর উর্দু চাপানোর প্রয়াসের বিরোধী। আমাদের এ বিরোধের কারণ এই নয় যে বাংলা ভাষা ভাষা হিসেবে উর্দুর চেয়ে উৎকৃষ্ট—সে তর্কই আমরা এখানে তুলব না। উর্দু প্রবর্তনের চেষ্টার বিরোধী আমরা অন্য কারণে। সে কারণগুলোই এই আলোচনায় আমি দেখানোর চেষ্টা করব।
সবচেয়ে বড় কারণ এই যে কোনো জাতির মাতৃভাষা বদলিয়ে এক ভাষা থেকে অপর ভাষায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এটা একেবারেই অসম্ভব সে জাতিতে, যে জাতির লোকসংখ্যা প্রায় চার কোটি। বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানের সংখ্যা তা-ই। ওদের সবাইকে বাংলা ছাড়িয়ে উর্দু শেখানোর চেষ্টা পাগলামি মাত্র।
ভাষাটা শুধু কতকগুলো অক্ষরও নয়, কতকগুলো শব্দ নয়। অক্ষর, শব্দ, ব্যাকরণ, উচ্চারণ, ফনিটিকস, ফসহিত্য বালাগত, মুখ্রেজ, তালাফ্ফুজ প্রভৃতি নিয়েই একটা ভাষা হয়। এর মধ্যে শিক্ষার নমুনা ও শিক্ষিতের বাহাদুরি যে অক্ষর, সেটা হচ্ছে ভাষার সবচেয়ে গৌণ ব্যাপার। আমরা দেশের শতকরা যে ৯৫ ভাগকে অশিক্ষিত বা নিরক্ষর বলি, তারা শুধু হরফের ব্যাপারেই নিরক্ষর-ব্যাকরণ, ফনিটিকস, মুখরেজ ও তালাফ্ফুজের ব্যাপারে তারা অশিক্ষিত নয়। কারণ, ওসব বিদ্যা স্বভাবজাত, সমাজের দেওয়া। কথাটা খুবই সোজা। তবু অসাবধান পাঠকের সুবিধার খাতিরে একটা নজির দেওয়া দরকার।
প্রথমে ধরুন মুখরেজ বা ফনিটিকসের কথা। ‘হাওড়া’ যে ‘হাওরা’ নয়, এটা শেখাতে বা বোঝাতে বাঙালিকে ফনিটিকসও পড়তে হয় না; এমনকি ‘ড়’ ও ‘র’র পার্থক্য বোঝার জন্য ‘বর্ণবোধ’ও পড়তে হয় না। যেকোনো অশিক্ষিত, নিরক্ষর ও নাবালক বাঙালি নিজের অজ্ঞাতসারেই ‘হাওড়ার হারু বিড়িওয়ালা’র ফনিটিক্যাল বিশুদ্ধ উচ্চারণ করে যাবে। কিন্তু অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফনিটিকসের প্রফেসরও অমন নিখুঁতভাবে ‘ড়’ ও ‘র’ পার্থক্য উচ্চারণ করতে পারবেন না।
তার বাদে ধরুন ব্যাকরণের কথা। একজনে যে ‘আমি,’ ‘তুমি’ ও ‘সে’ হয়, আর বেশি লোকে যে ‘আমরা’ ‘তোমরা’ ‘তারা’ হয়; আমি যে ‘গেছ্লাম’, ‘তুমি’ যে ‘গেছলে’, সে যে ‘গেছ্লো’ এবং ‘আপনি’ যে ‘গেছলেন’ এত ‘শব্দরূপ’ ও ‘বিভক্তি’-জ্ঞান নিরক্ষর জনসাধারণ কোথায় শিখেছে? দিল্লি-লক্ষ্ণৌর যেকোনো নিরক্ষর কুলির মুখে শুনবেন ‘মরদ করতা হ্যায়’ আর ‘আওরত করতি হ্যায়’। এ ব্যাকরণ তারা মায়ের পাঠশালা ও সমাজের স্কুলেই শিখেছে।
তারপর ধরুন তালাফ্ফুজ বা এক্সেন্টের কথা। তারা (তাহারা), তারা (তারকা), পারা (সক্ষম হওয়া), পারা (পারদ), বাত (বাতাস), বাত (রোগ), বাত (কথা), বাত (ভাত-পূর্ব বাংলা), এসবের উচ্চারণভেদ বা এক্সেন্ট শেখানোর জন্য বৈয়াকরণদের কোনো দিন ঘরে ঘরে প্রচার করতে হয়নি।
এতেই বোঝা যাচ্ছে যে হরেক জবানের একেকটা নিজস্ব ব্যাকরণ বা বালাগত, উচ্চারণতত্ত্ব বা মখ্রেজ, যতিতত্ত্ব বা তালাফ্ফুজ রয়েছে, যার প্রথম স্থান কেতাবে না, মানুষের জিহ্বা এবং কানে। এটা সব ভাষা সম্বন্ধেই সত্য। সত্য বলেই এক জাতির ভাষাকে সাধারণভাবে গণভিত্তিতে আরেক জাতির গণভাষায় পরিণত করা সম্ভব না।
ধরুন, বাংলা ভাষার যে কয়টা বিশেষত্বের কথা ওপরে বলা হলো, যদি আমরা ইচ্ছে করি যে সেসব বিশেষত্ব ছেড়ে দিয়েই আমাদের জনসাধারণকে উর্দু শিখিয়ে ফেলব, তবু আমরা তা পারব না। কারণ, উর্দু ভাষার মধ্যেও ওই সব এবং ওই ধরনের আরও অনেক বিশেষত্ব রয়েছে। ওই সব বিশেষত্ব মানুষকে পাঠশালায় শেখানো যায় না। যুগ-যুগান্তরের পরিপার্শ্বে ওই সব বিশেষত্ব গড়ে উঠেছে। মাত্র পরিপার্শ্বই আমাদের ওই সব বিশেষত্ব শেখাতে পারে। পরিপার্শ্বের প্রভাব এ ব্যাপারে এত দরকারি ও প্রভাবশালী যে আপনি যদি বছর কুড়ি লক্ষ্ণৌ বাস করেন এবং আপনার ছেলেমেয়েরা যদি সব লক্ষ্ণৌতে জন্মায় এবং পনেরো-কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত লক্ষ্ণৌতেই বাস করে, তবে তারা মাদ্রাসা-মক্তবে না পড়েও সুন্দর উর্দু শিখে ফেলবে। বাঙালি ছেলেমেয়ে বলে তাদের ধরাই যাবে না। অথচ বাংলার কোনো পাড়াগাঁয়ে আপনি লাক্ষ্ণৌর খুব বড় পণ্ডিতকে শিক্ষক রাখলেও আপনার ছেলেমেয়েকে অমন উর্দুভাষী করতে পারবেন না। এখানে মনে রাখবেন, উর্দু ভাষায় লেখক বা পণ্ডিত হওয়া আর উর্দুভাষী হওয়া এক কথা নয়। এখানে আরেকটা কথা পরিষ্কার করে রাখা ভালো। বলা হবে, উর্দু হরফ চালানো তো আর কঠিন কাজ নয়। ছেলেমেয়েদের ‘ক’ ‘খ’ শিখতে যা, ‘আলেফ’ ‘বে’ শিখতেও তাই। উর্দু যাঁরা আনতে চাইছেন, তাঁরা উর্দু হরফও তো আনবেন। তবে আমি এ আলোচনায় হরফের ব্যাপারে কোনো কথা বলছি না কেন? কারণ, এই যে হরফের ব্যাপারটা আলাদা। হরফ বদলালেই স্বতই ভাষা বদলানো হয়ে যায় না। বাংলা ভাষা আরবি বা রোমান বা অন্য যেকোনো হরফে লেখা যেতে পারে এবং তার উল্টোটা সম্ভব। কাজেই হরফ-সমস্যাটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। আমি আরেক প্রবন্ধে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ওপরের আলোচনা থেকে পাঠকগণ বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয় যেকোনো এক জাতির ভাষাকে গণভিত্তিতে অন্য স্থান ও অন্য আবহাওয়ায় দুসরা জাতির গণভাষায় পরিণত করা যায় না। ভাষা, খোরাক ও পোশাক স্থানীয় পরিবেশের চাপে, স্থানীয় প্রয়োজনের তাগিদে, যুগ-যুগান্তর ধরে গড়ে ওঠে। এতে সংস্কার চলে, কিন্তু আমূল পরিবর্তন চলে না; এতে নতুন জিনিস ঢোকানো চলে, কিন্তু পুরোনোকে বাদ দেওয়া চলে না।
উর্দুওয়ালারা এটা বুঝতে পারছেন অথবা পরে পারবেন। তবু তাঁরা এ চেষ্টা করবেন কয়েকটা কারণে:
১. চেষ্টা করে দেখাই যাক না; যদি সফল হয়, তবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গণভাষা এক হয়ে যাবে। এটা কত বড় কাজ!
২. যদি নিতান্তই ব্যর্থ হয়, তবু তো পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের এক বিরাট অংশ, অন্তত উচ্চশিক্ষিত অংশ, উর্দুজ্ঞানী হবে। সেটা কম লাভ কি?
৩. বাংলার ওপর উর্দু চাপানোর প্রয়াসের মধ্যেই বাঙালি মুসলমানদের ওপর পশ্চিমা ভাইদের ইন্টেলেকচুয়াল প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। অপর জাতির ওপর ইন্টেলেকচুয়াল প্রাধান্য ও মাতব্বরি করার মধ্যে একটা গৌরব, একটা মাদকতা রয়েছে; সে সম্ভাবনার মধ্যেও একটা রোমান্স রয়েছে। ছয় আনার ভোটার চাষি মুসলমানদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা আসার পরেও যে কারণে বাংলার লীগ-নেতৃত্ব, সুতরাং রাষ্ট্র-নেতৃত্ব, উর্দুভাষীদের হাতেই রয়েছে, ঠিক এই কারণ থেকেই উর্দু প্রসারের প্রয়াসও হবে।
৪. পাকিস্তানবাসীর ভাবের আদান-প্রদানের সাধারণ ভাষা হিসেবে আমাদের অন্তত দ্বিতীয় ভাষাস্বরূপ উর্দু শেখা উচিত, এই যুক্তিতে উর্দুওয়ালারা একটা শেষ চেষ্টাও করতে পারেন।
ওপরের চারটি কল্পিত ও সম্ভাব্য অবস্থার প্রতিটিতেই ওদের একটা বড় যুক্তি থাকবে এই যে উর্দু ভাষা যেমন ইসলামি ভাবের অনুকূল, উর্দু সাহিত্য তেমনি ইসলামি কেতাবে ভরা। আরবি ও ফারসি সাহিত্য তার চেয়ে অনেক বেশি ইসলামি কেতাবে ভরা, বিশেষত আরবি ভাষা মুসলমানদের ধর্ম ভাষা এবং বিশ্বের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা হতে পারে, এ যুক্তি দিয়ে কিন্তু তাঁরা আমাদের আরাব শিখতে বলছেন না। বরং কেউ যদি ওসব যুক্তি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মাতৃভাষা উর্দুর বদলে আরবি করার জন্য দিল্লি-লক্ষ্ণৌতে গিয়ে সভা-সমিতি করতে চায়, তবে এরাই বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্বের কথা শিকায় তুলে রেখে বক্তাদের মুগুর নিয়ে তাড়া করে আসবেন। এর কারণ কী, এর মনোবিজ্ঞানগত কৈফিয়তটাই-বা কী, তা ক্রমে পাঠকগণ বুঝতে পারবেন।
এবার আসুন আমরা বিচার করে দেখি, উর্দুকে বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা হলে কী কী অবস্থা ঘটতে পারে। ধরুন, পাকিস্তান হয়ে গেছে; পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম জনসাধারণ তাদের ইচ্ছামতো ও পছন্দমতো রাষ্ট্র গঠন করে নিয়েছে। গণপ্রতিনিধিগণ জনসাধারণের হুকুমমতো রাজ্য করছেন। শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-বাণিজ্য—সবই মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের ইচ্ছামতো চলছে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, ফ্যাক্টরি-কারখানায় দেশ ছেয়ে গেছে।
ঠিক এই সময়ে পাকিস্তানের নেতারা বললেন, আমরা জনসাধারণ মেনেও নিলাম যে পাকিস্তানের জনসাধারণের ভাষা বাংলার বদলে উর্দু করতে হবে। এটা সফল করতে হলে:
১. বাংলার সব প্রাইমারি স্কুলে উর্দু বাধ্যতামূলক করতে হবে;
২. উর্দুকে শিক্ষার মিডিয়াম করতে হবে;
৩. উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, অর্থাৎ অফিস-আদালতের ভাষা, নথিপত্র, সরকারি কাগজপত্র, আইনকানুনের কেতাব, রেল, পোস্টাফিস ও টেলিগ্রাফের টিকিট পর্যন্ত সবই উর্দু ভাষায় করতে হবে।
সোজা কথায়, ইংরেজি ভাষা আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও শিক্ষাজীবনে যে স্থান দখল করে আছে, উর্দুকে সে স্থানে বসাতে হবে।
অথচ ইংরেজি দেড় শ বছরে আমাদের মাতৃভাষাও হয়ে যায়নি; সে চেষ্টাও হয়নি। ইংরেজিকে আমাদের মাতৃভাষা বা গণভাষা করার উদ্দেশ্যেই ইংরেজ যে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে এভাবে ইংরেজি ঢুকিয়েছে, এ কথা বলা যেতে পারে না। ইংরেজিকে শুধু রাষ্ট্রভাষা করাই ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল। শুধু রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি আমাদের জীবনে যতখানি জায়গা দখল করে আছে, উর্দুকে গণভাষা করতে হলে তাকে আমাদের জীবনে ইংরেজির চেয়ে আরও বেশি জায়গা দিতে হবে।
দিলে কী হবে, তার বিচার করুন। দেড় শ বছরে আমরা কতজন কী পরিমাণ ইংরেজি শিখেছি? ইংরেজি অবশ্য শিক্ষাকে আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেনি। কাজেই আমাদের মধ্যে শতকরা পাঁচ-সাতজনের বেশি লেখাপড়া শেখেনি। কিন্তু যারা লেখাপড়া করেছে, তাদের সবাইকে তো ইংরেজি পড়তে হয়েছে। যারা উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে, তাদের সবাইকে সাহিত্য ছাড়া অন্যান্য বিষয়ও ইংরেজি মারফত শিখতে হয়েছে। ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তি দিয়েই আমাদের শিক্ষার উচ্চতা মাপা হয়েছে; ইংরেজি-জ্ঞান বিচার করেই আমাদের চাকরি-নকরি দেওয়া হয়েছে। ইংরেজিতে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েই আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ওকালতিতে শ্রেষ্ঠত্ব, নির্ধারিত হয়েছে।
তবু আমরা দেড় শ বছরে কতটা ইংরেজি শিখেছি? ইংরেজি ভাষা কী পরিমাণে, কত দূর আমাদের শিক্ষিত সমাজের গণভাষায় পরিণত হয়েছে? আমাদের বাংলা কথায় আমরা প্রচুর ইংরেজি ‘ওয়ার্ড’ ‘ইউজ’ করছি বটে, কিন্তু ইংল্যান্ড-আমেরিকার ভদ্রলোক ইংরেজ-মার্কিনদের সঙ্গে তো দূরের কথা, কলকাতার ট্যাশদের সঙ্গেই কি আমরা সহজভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে শিখেছি? যেসব বাঙালি অধ্যাপক কলেজে মিল্টন-শেক্সপিয়ার পড়াচ্ছেন, তাঁরাই রাস্তায় বেরিয়ে একটা সাধারণ ট্যাশের সঙ্গে দুই দণ্ড ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন?
উর্দুর বেলায়ও আমরা এর বেশি শিখতে পারব না। পাকিস্তানে শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে; সুতরাং সবাই উর্দু লিখতে-পড়তে পারবেন। কিন্তু তার মধ্যে শতকরা দুই-দশজনও মোল্লা জান মোহাম্মদের সঙ্গে সহজভাবে উর্দুতে আলাপ করতে পারবেন না। বর্তমানে শিক্ষা বাধ্যতামূলক হয়ে যদি বাংলার সবাই গ্র্যাজুয়েট হয়েও যেত, তবুও রাগের সময় ‘ড্যাম’ ‘রাস্কেল’ ছাড়া আর বেশি কিছু ইংরেজি কথোপকথন করতে পারত না। তেমনি বাংলার সব মুসলমান উর্দুতে পুরা কেতাবি জ্ঞান লাভ করার পরেও রাগের মাথায় ‘শুয়ার কা বাচ্চা’র বেশি উর্দু বাৎচিত সহজভাবে করতে পারবে না।
কিন্তু কিছুসংখ্যক বাঙালি যেমন বিলেত ঘুরে এসে, মেমসাব বিয়ে করে, বাড়িতে বিলাতি কুত্তা এবং নেপালি রেখে কিছুটা সাহেব হয়েছে এবং ছেলেমেয়েদের বেবি ডেকে ইংরেজি ভাবার মধ্যে তাদের ‘পাপা-মাম্মা’ শিখিয়েছে, উর্দুর বেলায়ও কিছু মুসলমান মিরাটা বা সুবিধাবাদী ছেলেমেয়েকে উর্দু শেখাতে পারবেন। কিন্তু বিলাতফেরত ‘কালা-সাহেবদের মতোই ওরা হবেন একটা একঘরে শ্রেণি, ‘ক্লাস বাই দেমসেলভস’। বাংলার জনসাধারণের সঙ্গে তাদের কোনো আত্মীয়তা থাকবে না। বিলাতফেরত ‘কালা-সাহেবরা’ যেমন লড়াই লাগার আগ পর্যন্ত ছোটার মধ্যে বিলাতে ‘হোমে’ যেতেন, পূর্ব পাকিস্তানের ওই সব উর্দু শরিফও ছুটাতে তেমনি লক্ষ্ণৌ বা মিরাটে ‘হোমে’ যাবেন।
এসবই হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চালানোর সামগ্রিক চেষ্টার দশ-বিশ-পঞ্চাশ-এক শ বছরের পরের কথা। সে চেষ্টার গোড়াতেই কী হবে, এখন চলুন আমরা তার বিচার করে দেখি।
আগেই বলেছি, উর্দু পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করার প্রথম পদক্ষেপ হবে, তাকে বাংলার রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মিডিয়াম করা। এবার ধরুন—
১. অফিস-আদালতের ভাষা ইংরেজির বদলে উর্দু করা হলো,
২. শিক্ষার মিডিয়াম ইংরেজির বদলে উর্দু করা হলো,
৩. শিক্ষার সকল স্তরে এমনকি, প্রাইমারি স্কুলেও উর্দুকে বাধ্যতামূলক করা হলো।
এর প্রথম ফলই হবে যে হাকিম-হুকামা, ডিপটা-মুনসেল, জজ-ম্যাজিস্ট্রেট, শিক্ষক-অধ্যাপক, সবাইকে উর্দুতে হতে হবে। এটা অবশ্য এক দিনে হবে না। রাতারাতি সব সরকারি কর্মচারী উর্দুভাষী হয়ে যাবেন না। কিন্তু কী নীতি ও কী তরিকায় এটা কাজ করবে, তার বিচার করতে পারি আমরা ইংরেজির গতি থেকে। ইংরেজিও এক দিনে চাপানো হয়নি। ইংরেজি দ্বারা শুধু প্রাধান্য, অগ্রগণ্যতা বা প্রেফারেন্স পেয়েছে মাত্র। বস্তুত এই প্রেফারেন্স-নীতি অবলম্বন করা ছাড়া এক ভাষাকে অন্য ভাষার স্থলবর্তী করার আর কোনো তরিকা নেই। আমরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাই, তবে এই প্রেফারেন্স-নীতি আমাদের এখতিয়ার করতেই হবে।
ফলে—
১. ইংরেজি প্রবর্তনের গোড়াতে শিক্ষকতা ও অধ্যাপনা যেমন ইংরেজদের একচেটে ছিল, তেমনি পাকিস্তানের শিক্ষকতা ও অধ্যাপনা, অন্তত কিছুদিনের জন্য, পশ্চিমা ভাইদের একচেটে থাকবে;
২. সরকারি অফিস-আদালতে ইংরেজদের স্থলে দিল্লি-লক্ষ্ণৌওয়ালাদের প্রাধান্য, অগ্রগণ্যতা মেনে নিতে হবে;
৩. শিল্প-বাণিজ্যে, কল-কারখানায় ইংরেজ প্রাধান্যের স্থলে দিল্লি-মুম্বাইওয়ালাদের প্রাধান্য মেনে নিতে হবে।
এই তিনটা ব্যাপারের গুরুত্ব একটু ধীরভাবে চিন্তা করে দেখলেই আপনারা দেখতে পাবেন যে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, শিক্ষাগত ও সামাজিক রূপায়ণের প্রাথমিক স্তরে বাংলার জনসাধারণ তো দূরের কথা, মুসলিম বঙ্গের আজিকার শিক্ষিত সম্প্রদায়ও কোনো সক্রিয় অংশ নিতে পারবে না; তারা অভিনয় করবে শুধু বেকার, নিরপেক্ষ, নির্বোধ, দর্শক ও ট্যাক্সদাতার ভূমিকায়। ইংরেজদের অধীনে আমরা ভারতবাসী আজ যেরূপ সাবঅর্ডিনেট পজিশনে থাকতে বাধ্য হচ্ছি, বাঙালি মুসলমানকে উর্দুভাষীদের কাছে সেই সাবঅর্ডিনেট পজিশনেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বিদ্যায়, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, প্রতিভায় অনেক ভারতবাসী ইংরেজের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ হয়েও যেমন শুধু ভাষার প্রাধান্যে নিচে পড়ে আছে, বাঙালি মুসলমানের বেলায়ও ঠিক তা-ই হবে। পাণ্ডিত্য থাকে পেটে ও মাথায়। কথাবার্তাতেই শুধু সেটা প্রকাশ পেতে পারে। সহজভাবে কথা বলার ভাষার অভাবেই আমাদের অনেক জানা কথা বলা হয় না; এবং তর্কে আমরা হেরে গিয়ে থাকি। ইংরেজের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে গিয়েই আমরা ছোট ও বোকা বনে থাকি মুখে অনেক কথা ও মাথায় অনেক বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও। এই প্রকাশশক্তির অভাব হেতুই বক্তার মনে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স জন্মে থাকে। ইংরেজির বেলায় আমাদের জীবনে যা যা ঘটেছে, উর্দুর বেলায়ও ঠিক তা তা ঘটবেই। উর্দু ভাষার রাষ্ট্রভাষা হওয়ার ১০ বছরের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারব ও স্বীকার করব যে দিল্লি-লক্ষ্ণৌওয়ালারা প্রতিভা-মনীষায় বাঙালি মুসলমানের চেয়ে সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ। একটা জাতির ইন্টেলেকচুয়াল মৃত্যুর জন্য এই মনোভাবই যথেষ্ট।
তার ওপর আসবে অর্থনৈতিক তারতম্য। বাংলার শিক্ষিত মুসলমান লাখ লাখ যুবক-প্রৌঢ় উর্দু-জ্ঞানের অভাবে হবে বেকার। যারা খাতির-খোশামোদে চাকরি পাবে, তারাও পাবে সাবঅর্ডিনেট পদ। মাইনেও হবে তাদের কম। কাজেই অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বও দেবে ওদের আভিজাত্য। বর্তমানের ‘আইসিএস’-এর মতো একটা পশ্চিমা ‘স্টামফ্রেম’ ক্রমে গড়ে উঠবে এবং অন্তত কয়েক যুগ ধরে বাংলা শাসন করবে তারাই। পূর্ব পাকিস্তান কার্যত থাকবে পশ্চিম পাকিস্তানের একটা উপনিবেশ মাত্র।
অথচ এত করেও বাংলার চার কোটি বাংলাভাষী মুসলিম জনসাধারণ হাজার বছরেও উর্দুভাষী হবে না, সে কথা আমি আগেই বলেছি। লাভের মধ্যে হবে একশ্রেণির অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। এদের সঙ্গে জনসাধারণের কোনো যোগ থাকবে না, এ কথাও আগেই বলেছি। কিন্তু তাঁরা পশ্চিমাদের গলায় সুর মিলিয়ে উর্দুর মাহাত্ম্য গেয়ে যাবেন। কারণ, তাঁরাই হবেন পশ্চিমাদের এ দেশি আত্মীয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শাসকশ্রেণি। শাসকশ্রেণির ভাষা থেকে জনসাধারণের ভাষা পৃথক থাকার মধ্যে মস্ত বড় একটা সুবিধে আছে। তাতে অলিগার্কি ভেঙে প্রকৃত গণতন্ত্র কোনো দিন আসতে পারে না। সুতরাং, পূর্ব পাকিস্তানে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রোকাওট হিসেবে রাজনৈতিক মতলবেই এই অভিজাত শ্রেণি উর্দুকে বাংলার ঘাড়ে চাপিয়ে রাখবেন। শুধু চাকরিবাকরিতে নয়, আইনসভার মেম্বরগিরিতেও যোগ্যতার মাপকাঠি হবে উর্দু বাগ্মিতা। সুতরাং, সেদিক দিয়েও এই ভাবাগত আভিজাত্যের স্টিলফ্রেম ভেঙে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করার চেষ্টার বিপদ এখানে। পাকিস্তানের প্রধান রাজমিস্ত্রি ‘আজাদ’ সম্পাদক মাওলানা আবুল কালাম শামসুদ্দীন ও রেনেসাঁ সোসাইটির সম্পাদক মাওলানা মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি এবং আগে থেকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি।
অথচ উর্দু নিয়ে এই ধস্তাধস্তি না করে আমরা সোজাসুজি বাংলাকেই যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি, তবে পাকিস্তান প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা মুসলিম বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পগত রূপায়ণে হাত দিতে পারব। আমাদের নিজেদের বুদ্ধি, প্রতিভা ও জীবনাদর্শ দিয়েই আমাদের জনসাধারণকে উন্নত, আধুনিক জাতিতে পরিণত করব, জাতির যে অর্থ, শক্তি, সময় ও উদ্যম উর্দু প্রবর্তনে অপব্যয় হবে, তা যদি আমরা শিক্ষা-সাহিত্যে, শিল্পে-বাণিজ্যে নিয়োজিত করি, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে আমরা শুধু ভারতের নয়, সমগ্র মুসলিম জগতের, এমনকি, গোটা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত করতে পারব। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকেও আদর্শ মুসলিম ভাষা ও মুসলিম সাহিত্যে পরিণত করতে পারব।
পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষার কী রূপ হবে, আগামী প্রবন্ধে আমি তার আলোচনা করব।
(দৈনিক প্রথম আলো থেকে সংগৃহিত)
Dear Saif,
Zazakallah.
Regards,
Hasan
LikeLike