তারা তাকে হত্যা করেই ফেললো
কারণ তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে
সে তার জবান খোলেনি একবারও।
সে দাঁড়িয়ে ছিলো তার পুরোনো কাস্তেটি হাতে নিয়ে
ধানখেতের মাঝখানে।
তার মুখভরা ছিলো ঈশা খাঁর দাঁড়ি।
সে কোনোদিন স্কুলে গিয়েছিল বলে শোনেনি কখনো কেউ।
সত্তর বছর ধরে এ গাঁয়ের আলো ও বাতাসে
রৌদ্র ও বর্ষায়
ফলন্ত বৃক্ষের মতো বেঁচে ছিলো সে।
রাজনীতির আড্ডায়, ফুটবলের মাঠে কিংবা চায়ের দোকানে
তার উপস্থিতি কারো চোখে পড়েনি কখনো।
তাকে শুধু দেখা গেছে মাঠেঘাটে কিংবা বিলে
কখনো লাঙল নিয়ে, কখনো কোদাল, কখনো নিড়ানিÑ
সাধকের মতো সে নিমগ্ন হয়ে আছে তার নিত্যকার কাজে।
কখনো বা সেচঘরে বসে থাকতে দেখা গেছে তাকে
শ্যালো মেশিনের পাশে;
কখনো বা দেখা গেছেÑএকা একা
ঠিক করে চলেছে সে ইরি ব¬কের পানির লাইন।
কখনো গাঁয়ের হাঁটে ছুটতে দেখেছে তাকে লোকজন:
কাঁধে তার খেত থেকে তুলে আনা তরতাজা তরকারির স্তুপ।
ক্লাবের ছেলেরা তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
তাদেরকে উসকে দিয়েছিল তার সুখ ও সাফল্যে ঈর্ষান্বিত
এ গাঁয়েরই দুষ্টু কিছু লোক।
ছেলেরা পতাকা হাতে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল তার কাছে;
বলেছিল, “ক্রিকেটে আপনি কোন্ দেশের সাপোর্টার?”
বলেছিল, “আপনাকে কেন দেখা যায় না বিজয় দিবসের
প্রভাতফেরিতে?” বলেছিল, “আপনি কি
এদেশকে ভালোবাসেন না একটুও?”
সে কেবল ফ্যালৃফ্যালৃ করে নির্বাক তাকিয়ে ছিলো
তাদের মুখের দিকে।
তার নিরবতা ভেঙে দিয়েছিল তাদের ধৈর্যের বাঁধ।
তাদের উত্তপ্ত ধমনীর ভেতর এক কড়াই গরম তেলের মতো
টগবগ করে ফুটতে থাকা তাদের বিক্ষুব্ধ দেশপ্রেম
খুনী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর এবং শেষমেশ
হন্যে কুকুরের মতো তাকে হত্যা করে ফেললো, পিটিয়ে।
তারা চলে গেলে, তার লাশ
ঘিরে কেঁদে উঠলো সুগন্ধি বনের বাতাস।
চারদিকের ধানখেত তার শোকে কেঁপে উঠলো থরথর।
মাঠের গরুরা, গরুদের পিঠের উপর বসে থাকা কয়েকটি ফিঙে
আর শূন্য সেচঘর
তার নামে করতে থাকলো আহাজারি।
আর এক নারীÑ
তার দেশ,
সিক্ত চোখ, আলুথালু কেশÑ
উদ্ভিদের মতো নরম মৃত্তিকা ফুঁড়ে জেগে উঠে বলে উঠলো সক্রোধে:
‘তুমুল বর্ষায় ও প্রচণ্ড রোদে
কে আর বেসেছে ভালো তার অধিক আমাকে একদিনও?
গাছের পাতারা সাক্ষী আর জমিনের সব তৃণ,
তার চেয়ে প্রিয় আর ছিলো না কেউই, দুঃখে কি সুখে,
এ মুলুকে।’
তবু তারা দেশময় হেসে চললো বিজয়ের হাসি
এই বলে: ‘ফেলেছি বীরের মতো হত্যা করে তাকে
কারণ আমরা ভালবাসি
আর সে ভালোবাসেনি একবারও এই দেশটাকে।’
৫.৩.২০১৫ মিলনমোড়, সিরাজগঞ্জ
মন্তব্য করুন