এক
আমি যখন আল মাহমুদের দিকে তাকালাম
হোমারকে দেখতে পেলাম। অন্ধ।
কিন্তু দেখেন দৃষ্টির অতিরিক্ত মহাকাশ।
চাঁদের চেহারা থেকে ছিনিয়ে আনা আয়শার মতো জ্যোৎস্না
মুখে ছড়িয়ে আল মাহমুদ বললেন, আমি তো কানা মামুদ, কানা…
বললাম, আমার চোখ নিয়ে নিন আপনি
আপনার কানা চোখের ভেতরে যে ইন্দ্রজাল, সেটা আমাকে দিয়ে দিন।
আল মাহমুদ খুব হিসেবি। তিতাসের
কই মাছের ঝোলের স্বাদ
উগরে দিয়ে তিনি হাসলেন।
বললেন, ‘কবিদের চোখের হাড়িতে আজকাল কর্ণফুলীর ব্যঙ!
কিন্তু কানা মামুদের চোখের ভেতরে কী আছে এমন, যা তোমার চাই?’
বললাম, সেই জ্যোতি, যা দিয়ে তৈরী হয় ত্রিকালজ্ঞ চোখ!
যা দৃশ্যের ভেতর- বাহিরকে দেখেই থামে না,
শিকার করে নেয় ইতিহাসের নদীতে সময়ের জলপানের শব্দও!
আমার চোখ দিয়ে আল মাহমুদের কোনো কাজ নেই।
কারণ আমি জানি, যখন সত্যটা দেখি, দৃশ্যমান চোখ দিয়ে দেখি না।
প্রকৃত দর্শক আমি আসলে অন্ধ।
কারণ চোখ বন্ধ না করলে
আমি দেখি না আকাশের সাথে আমার গোপন চুক্তিনামা
দেখি না মহাজাগতিক সংবাদ শিরোনাম!
দেখি না মানুষের শরীরের ভেতরে গর্তে মলত্যাগরত বুনো শুয়রের মুখ!
আমি কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করলাম আসল দৃষ্টির প্রয়োজনে।
তোমরা তখন বলতে থাকলে – এই দেখো আরেক অন্ধ।
যেভাবে জ্বলন্ত তারার মতো দৃষ্টিবান আল মাহমুদকে বলা হতো অন্ধ।
কেননা দৃশ্যের অতিরিক্ত দৃশ্যে ডুব দিতে
তিনি একদা বন্ধ করেছিলেন দৃশ্যমান চোখ!
দুই
দেখলাম
আল মাহমুদ গল্প করছেন ঈশপের পশু- পাখির সাথে
রাখাল ছেলের মিথ বদলে দিয়ে লেখছেন মিথ্যাবাদী রাখাল
কুষাণ কুমারী আর কিরাতের কৃষকেরা
কৌমের কেলিকে কল্লোলিত করছিলো;
চক্রবর্তী রাজার অট্রহাস্যে ভয়ার্ত হলো তারা-
তখনই অনিবার্য আল মাহমুদ!
তখনই বখতিয়ারের ঘোড়া।
আল মাহমুদের দহলিজে ইয়েটস- বুদলেয়ার।
দরোজায় মিশেছে তিন দিকের তিন পথ।
একপথে ফুলকুড়ানো শিশুদের নিয়ে জসীম উদদীন যাচ্ছেন মামার বাড়ী!
একপথে পাখির নীড়ের মতো চোখ মেলে সুশীতল বনলতা সেন!
একপথে পাশব সভ্যতাকে পদাঘাত করে
পুরনো তারার সাথে একমনে কথা বলে
ডাহুকের কবি ফররুখ!
আমি দুধভরা এক চাঁদের বাটি নিয়ে
আল মাহমুদের বাটিতে এসেছি।
তিনি এক টিনের বাকসো থেকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন
হাজার হাজার নদী
ধানখেত
সাধ্যমতো ঘর-বাড়ী
বর্ণিল কামকেলি
বঙ্গোপসাগরের হাঙ্গর
ফেব্রুয়ারির একুশের দুপুর বেলার বৃষ্টি …
আমার অপেক্ষা শুধু দীর্ঘ হচ্ছে
হাজী শরিয়তের মতো গলা ছেড়ে বললাম-
আল মাহমুদ বেরিয়ে আসুন!
ঈগল গিলে খাচ্ছে ইতিহাস!
শারমেয় কামড়ে নিচ্ছে কাশ্মীর!
পূঁজির ফেরাউন সদলে হামলে পড়ছে মুসার উপর!
পাগলা কুত্তার মতো চিল্লাচ্ছে বিকলাঙ্গ ইজম!
হারামজাদারা চোরাইমালের মতো সস্তাদামে বিক্রি করছে বাংলাদেশ!
আল মাহমুদ বেরিয়ে এলেন!
পিঁপড়ে সারির মতো কালোমানুষের ধারা সরোষে জেগে উঠলো!
আমরা পথ চলছি,দুলছে ইতিহাস!
আমরা পথ চলছি, হচ্ছে বজ্রপাত!
আমরা পথ চলছি,রক্তবৃষ্টি,বোমাবৃষ্টির
ভেতর উচ্চারিত হচ্ছে মুক্তির তাকবির!
চারদিকে অগণন আলোর সন্তান!
অগণিত ক্রন্দসী ঈভের শপথ!
আমরা এখন অতিকায় সাম্রাজ্যবাদী ডায়নোসোরের মুখোমুখি!
কে দাঁড়াবে এবার!
আল মাহমুদ দাঁড়ালেন।
বললেন- ‘ শোনো আমেরিকা,তোমার জবাব দিচ্ছে একজন কবি!’
আমরা জবাব দিয়েই এগুতে থাকি।
আমরা বিনিময় করি অদৃশ্য ঈমান।
আমাদের পদধ্বনি মৃতশতাব্দীর বুকে জাগায় যৌবন।
ঢাকার অন্ধকার রাতে ঐতিহ্যের মহল্লায়
হানাদার কালো শেয়ালদের তাড়িয়ে
শুরু করা আমাদের অভিযান গোলার্ধে গোলার্ধে
কান্না ও বিনাশের বিপরীতে
সৃষ্টি ও ভালোবাসার আযান হয়ে
অনন্তকালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে!
দেখতে পাচ্ছো?