চোখ ১,২ ও ৩ / আসাদ চৌধুরী

চোখ : ১

রাজনীতিবিদ শুধায় আমায়
‘কারে কয় প্রকারণা?’
জিভ শুধু দিলো তোমার চোখের
অকপট বর্ণনা।

চোখ : ২

যখন বিষাদ এসে
ঢেকে দেয়
সব বিনোদন,
তখন তোমার চোখে
আশ্বাসের
দীপ্রদীপস জ্বলে।
যখন আনন্দ এসে
ঢেকে ফ্যালে
মলিন ভুবন,
তোমার চোখের তারা
সিক্ত হয়
স্নিগ্ধ ধারাজলে।

চোখ : ৩

তোমার দু’চোখের জলের ভরসায়
জুয়ার শেষ দান
রেখেছি বাজি।
দুগ্ধ সাহারায় দু’একটি ফোঁটায়
এমন কী হ’তো যে
হও নি রাজি?

প্রেম: ৫,৬,৭ ও ৮ / আসাদ চৌধুরী

প্রেম : ৫

রে নির্বোধ,
প্লাটফর্মে খুঁজে এলি
বিশুদ্ধ আবেগ।
-যেখানে মরণমৃত্যুর ছোটো মালা
ছলছল ক’রে পালা করে।
সেখানে প্রতিটি ফুসফুস
বিশুদ্ধ বাতাসের কাঙাল।

শনিবারের সুনীলবিকেলে
গভীর তিয়াসায় হন্তদন্ত হ’য়ে
ছুটে গেলি হৃদয়বতী হৃদের কাছে;
পিপাসিত জিহ্বার ছায়া
তোর সরল শরীর
ছুঁতে না-ছুঁতেই
হে প্রসন্ন জলাশয়,
শুকিয়ে গেলি আঁখির আঁধারে।
তোমার তৃষ্ণার জল,
আসাদ, পেয়েও হারালে।

প্রেম : ৬

মলীন আশা আসতে চায় ঘরে
দিচ্ছে মৃদু হালকা টোকা আশা,
হায়রে আমি কাঁপতে থাকি ডরে,
বাঁধলো বুঝি বক্ষে ভালবাসা।

চুলের মাঝে ধবল এক ফুল
যেই দেখেছি যায়রে সব যায়।
চপলতম গোপনতম ভুল
নাচছে দেখি তাহার কব্জায়।

প্রেম : ৭

ঘুম ভাঙলে তন্দ্র থাকে।
চায়ের কাপে
কাঁকন কাঁপে।

প্রেম : ৮

মধ্য রাতে কে  দরোজায় এলে?
বসলে তুমি আমারই দুই চোখে।
অন্ধকারে কাঁপে গভীর রাত।
মশারিটাও আকাশ হ’লো শোকে।

প্রেম : ১,২,৩ ও ৪ / আসাদ চৌধুরী

প্রেম : ১

আসবে ব’লে আশার সকল পথে
ফেলে এলাম শোকের চোখের জল
কাঁটার ’পরে বক্ষ পেতে দিলাম
পরশ পাবে তোমার চরণতল।

তোমার হাতে গোলাপ দেখেছিলাম
দারুণ লোভে বিছাই করতল-
বারেক হেসে পেরেক ঠুকে দিলে
তোমার চোখে দেখবো কি কাজল?

প্রেম : ২

গভীর ক্ষত থেকে    রক্ত ঝরছিলো
তবুও তোমাকেই
দিলাম ভার।
চিকিৎসক তুমি    আমিও নতজানু
বিঁধলো তবু তীর
অবজ্ঞার।

প্রেম : ৩

বকুল ফুল কোথায় পাই প্রিয়ে?
তোমায় শুধু জড়াতে চাই
নগ্ন বাহু দিয়ে।

প্রেম : ৪

তোমার সুরে মেলাতে চাই গলা
ছোট্টো কথাই
হয় নি আমার বলা।

দেয়াল / আসাদ চৌধুরী

দেয়াল জুড়ে অন্ধকারের চাষা
ক্ষেত দিয়েছে, আটকে গেলো দৃষ্টি।
দেয়াল আমার চর্যাগীতির ভাষা
সাঁঝের মতো নয়ন নত কৃষ্টি।
অন্ধকারের গভীর কালো ব্যথায়
রাত দুপুরে আকাশ মেশে সেথায়।
ভাবনা গলে যেমন মধুর বৃষ্টি।
সাদা দেয়াল শুভ্র শাড়ির ছবি-
কখনো-বা ভয় আবার কখন মিষ্টি
দেয়ালই হয় খেয়ালি এক কবি।
অন্ধকারের বন্ধ কালো ব্যথায়
ক্ষুব্ধ আমার ভাষা পড়ি সেথায়।
বাঘের গায়ে কৃষ্ণ ডোরা দাগে
হলুদ ফোঁসে ভীষণ রকম রাগে
ব্যগ্র দেয়াল কালের ঘ্রাণে জাগে
কমলা রোদ ঝরুক অনুরাগে।
অন্ধকারের নীরব বোবা ব্যথায়
গভীর কবি ব’সে আছেন সেথায়।

নতুন সবক চাই

(ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিবেদিত)

দেয়লে পিঁপড়ের সারি দেখে পিতামহ
আষন্ন ঝড়ের অঙ্ক নির্ভুল কষতেন।
মৃত্তিকার গন্ধ শুঁকে কাহাতের শরীর ছুঁতেন
গ্রামের মোড়ল, প্রকৃতির এ-সমস্ত সহজ আয়াতে
মিশে গেছে জেরজবরহীন দুর্বোধ্যতা।
জনকের ফুল্ল প্রসারিত জমিগুলো হাত-ছাড়া হ’য়ে গেছে
আমার মায়ের সরল বিশ্বাসে
চুলের চেয়েও সুক্ষ্মচিড় ধ’রে গেছে ব’লে
রোজ তার চিন্তা বাড়ে।
গ্রামের সাহসী যুবা, পেশাল কৃষক- যার ভয়ে
জোড়া বলদ সরল রেখায় হাঁটতো
সে আজ শ্রমিক নেতা।
আমি হে মৌলবী, পিঠ ঠেকিয়েছি সব শেষের দেওয়ালে,
আর পা রেখেছি আসন্ন অসম্ভবের চাকার উপর,
মিলদবিহীন এপার্টমেন্ট থেকে রঙিন সুর
ঝুরে ঝুরে পড়ে।
অথচ আমার কালো সন্তানের বুকে
এক গাছি কালো সুতো
লতিয়ে উঠেছে বিশ্বাসের প্রতিশ্রুতি।
সব শব্দ কালো হ’য়ে গেছে একালের অভিধানে!
দীপ্তিহীন, রক্তহীন, ফ্যাকাসে, পান্ডুর হ’য়ে
ক্ষ’য়ে ক্ষ’য়ে লীন হচ্ছে-
পদাবলী, হায় শব্দাবলি,
তোমার বিশাল বুকে, হে সর্দার, মাথা রেখে আমি
কিছুকাল একাকি কাটাবো। নতুন সবক নেবো।
কম্পিত আঙুল দিয়ে তুমি মোরে লিখন লেখাবে?

আলোকচিত্র: ১, ২ ও ৩

আলোকচিত্র: ১

ঘর : একটি আয়োতন,
ঘর : নিবিড় আশ্রয়,
দীর্ঘশ্বাস জমা রাখা যায়,
ঘর : সে তো সময়ের
সবুজ পালক ঘেরা নীল অবসর
নিজেকে বিস্তার ক’রে দেখা যায়,
শরীর ও হৃদয়ের খুচরা
খুঁটিনাটি পার্টস।

আলোকচিত্র: ২

সারা বছর ঘুমায় এ মাঠ শান্ত ছেলের মতো
পায়ের তলা শিশির পেলেই শিরশিরিয়ে ওঠে ॥
তামাক পাতায় তাহের চাচা ছিটান হুঁকোর পানি
চারদিকেতে লঙ্কা গাছে লাল সবুজের মেলা!
সারা বছর ঘুমায় এ মাঠ শান্ত ছেলের মতো

আলোকচিত্র: ৩

মাছরাঙা স্থির হ’য়ে ব’সে আছে
পুকুরের কোণায় কোণায় ধোঁয়া,
বাঁশের জিংলায় মাছরাঙা পাখিটি-
সুপুরির বাগান থেকে আসছে অসহিষ্ণু গালাগালি
আর একটা গভীর ঘ্রাণ;
জলে নামার আগে ঘাটে কে যেন কাশছে।

পাপ

গাছের পাতারা সবুজ,
আমি অবশ্য দু’-একটি সাদা পাতা দেখেছি
পাতাবাহারের চিত্রল প্রেমে রাঢ়ে, বঙ্গে
কে না মজেছে, শৈশবে?
অথচ রাত নামলেই সব কালো।
ক্ষণায়ু দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে
শ্রাবণ রজনীতে
আমি কোনো বনবিরিক্ষির পাতা-পত্রালি দেখি নি।
কাঠি নিভলে, ডানে, বায়ে, সামনে পেছনের ছায়ায়
অমাবস্যায় কি পূর্ণিমায়, সে কালো, সব কালো।
আমি যখন রাজার সঙ্গে কথা বলি
তাঁকে শোনাই গান
তখন সকল পাতায় কালো, আমার
গোপন রাজার মতো…
একবার সিলেট থেকে ফেরার পথে
চা-বাগানের ফাঁকে ফাঁকে
নীল টয়োটা ফিনকি আলো ছিটিয়েছিলো-
জীবনে, আপনারা বিশ্বাস করুন।
অই একটি অশ্লীল দৃশ্য দেখেছি।
আর একবার, এক নগ্ন প্রাচীন বটবৃক্ষকে
আমি নিঅনে স্নান করতে দেখেছিলাম
পেট্রোল পাম্পের কাছে,
ভাগ্যিস আমি নেশাগ্রস্ত ছিলাম।

বৃক্ষের স্বভাবচরিত্র

অপরূপ সেই সে বৃক্ষ
দেখলে চোখের পাপ থাকে না।
– লালন শাহ

কোনো রকম ঘন্টা ছাড়াই
গাছ তার যাত্রা শুরু করে।
আমার গ্রামের একটা গাছকে সিনেমার পর্দায় দেখে
চমকে উঠেছিলাম।

সেই গাছটিই আবার লামডিং-এর
পরের ছোট্ট স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলো,
আমার শরনার্থী অবস্থা দেখে লজ্জাও পেয়েছিলো।
বালিগঞ্জের ট্রাম-লাইনের পাশে
সেই গাছ আমাকে চোখ মেরেছিলো।
আমি তাড়াতাড়ি জানালা থেকে
মুখ সরিয়ে নিয়েছিলাম।
মেয়েদের মতো গাছেদেরও অহংকার আছে।

কোমল করাত

আমাকে কেবল
হিংসাহীন শত্রুমিত্রহীন বোধে শুধু এক কোমল করাত
রাত-দিন দিন-রাত আরোগ্যের দিকে টানে।
শিয়রের কাব্যগ্রন্থ মলাট-বিহীন, টেবুলের নানা আকারের শিশি তন্দ্রাতুর স্বপ্নময়।
এই বৃষ্টি, এই রাত, মনে নেই কতোই শ্রাবণ।
মনে হয়, আমি আজ বুঝে গেছি সুপ্রাচীন কবিদের একান্ত অপ্রকাশিত অভিমান,
তাহাদের সুজাসুজি দর্প, অহংকার,
অতি তুচ্ছ ভুল বোঝাবুঝি।
লিপিকার গায়েনের সাথে অসহিষ্ণু খিটিমিটি
তাহাদের আনুপূর্ব ইতিহাস, জেনে গেছি আজ,
আজ বৃষ্টি, আহা আজ কাঁদুক আকাশ।

তাহাদের স্বপ্নের ভিতরে কোন শব্দে স্বপ্নের আবহ বেজেছিলো?
কার সুরে?
কী ভাষায়?
মানুষের? না পাখির? মেঘের? নদীর?
নাকি ফোকের সরল বাঁশি
কেঁদে কেঁদে ফেলে গেছে আধোয়া জামায় মোছা
লেপ্টে যাওয়া দু’চোখের জল।
ধোঁয়া ধোঁয়া ছায়া ছায়া কাঁপা কাঁপা শরীরের আয়োতন নিয়ে
সরল উত্তর তার বেজে যায়।
মনে হয় কিছু তার বুঝি, যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
মাথা কুটে মরেছেন তার কিছু আমি আজ পেয়ে গেছি
বৃষ্টি-ভরা, দৃষ্টি-মেলা শ্রাবণের রাতে।
সে কি কোনদিন বলা যাবে? কোনোদিন বলা হবে মানব-ভাষায়?
নাকি সেও রাতের রহস্য হ’য়ে অন্ধকারে পাড় বুনে যাবে?
শুধু আমি, জীবিত জনেরা, তার পিছে পিছে কাঙালের মতো
লেগে থাকব আমরণ নিয়তি পীড়িত।

গোলাপের কাঁধে হাত রেখে

শরীরের ভার যতই হাল্কা হোক
গোলাপের কাঁধে হাত রেখে ওঠা যায় না-
সিঁড়িগুলো তার ধাপে ধাপে কাঁপে ভারে
অথচ কপাট খুললো না কেউ, হায়!

দুঃখের ভারে আকাশ পড়ে না ভেঙে
জ্যোৎস্নার কাছে ক’ফোঁটা চোখের জল
রাখতে দিয়েছি আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে
সঞ্চয় ওই ক’ফোঁটা চোখের জল’।

গোলাপ আপনি কেমন আছেন? শুনি।
জ্যোৎস্না আপনি দেউলে হন নি আজো?
কুশল শুধাই কেন না বাড়ছে দ্বিধা
পার্স থেকে শেষ ফুলটিও ঝ’রে যায়।

কাঠের তারের বাদ্যযন্ত্রগুলো
সুরের শরীর কী ক’রে যে ধ’রে রাখে!
চামড়ার বেড়া, হাড়ের শরীরে প্রেম
মাছের চেয়েও দ্রুতগামী, স’রে যায়।

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: