দীনেশের কালোরাত / আহমদ বাসির

স্কুল ছুটি হতে এখনও অনেক বাকি। হঠাৎ করেই আলীম স্যার ক্লাসরুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। তিনি এ স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। ক্লাস নিচ্ছিলেন আরিফ স্যার। তিনি এ স্কুলের নবাগত জুনিয়র শিক্ষক। আলীম স্যারকে ক্লাসরুমের দরজায় দেখেই আরিফ স্যার একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন।
—আসসালামু আলাইকুম স্যার, আসুন স্যার আসুন, কোনো সমস্যা স্যার?
আলীম স্যার কোনো কথা না বলেই ক্লাসরুমে ঢুকে পড়লেন। আরিফ স্যার ভেবেছিলেন ছাত্রদের ক্লাস নিতে গিয়ে কোনো ভুল করে ফেলেছেন। সে কারণেই কিছুটা বিব্রত ভঙ্গিতে তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। ছাত্ররা সবাই দাঁড়িয়ে গেল। আলীম স্যার খুব নিচু গলায় আরিফ স্যারের সালামের জবাব দিয়ে বললেন—না, কোনো সমস্যা না। আপনি ক্লাস নিতে থাকেন। শুধু দীনেশকে একটু ছুটি দিতে হবে। এরপর আরিফ স্যারের কানে কানে আলীম স্যার কী যেন বললেন। আলীম স্যারের কথা শুনেই আরিফ স্যারের মুখমÐল কেমন যেন শুকিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দীনেশকে ডাক দিলেন—দীনেশ!
ছাত্ররা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানো অবস্থায়ই দীনেশ জবাব দিলো—ইয়েস স্যার।
—তুমি তোমার বইপত্র গুছিয়ে ব্যাগ নিয়ে বাড়ি চলে যাও। তোমাকে আজ আর ক্লাস করতে হবে না।
—কেন স্যার?
দীনেশের সরাসরি প্রশ্নে আরিফ স্যার আবারও বিব্রত হয়ে পড়লেন। তিনি আলীম স্যারের দিকে তাকালেন সরাসরি। আলীম স্যার ছাত্রদের উদ্দেশে বললেন—তোমরা সবাই বসে পড়। দীনেশের বাড়িতে একটু জরুরি কাজ পড়েছে। ওকে ছুটি দিতে হবে।
এরপর দীনেশকে আলাদা করে বললেন—দীনেশ, তুমি দ্রুত বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে আমার কক্ষে চলে এসো। আমি তোমাকে সব বলছি।
কথাগুলো বলেই আলীম স্যার বের হয়ে গেলেন। আরিফ স্যার দাঁড়িয়েই থাকলেন। দীনেশ আগা-মাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তবুও স্যারের নির্দেশ মোতাবেক বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় আরিফ স্যারকে ‘নমস্কার’ বলতেও ভুল করল না। আরিফ স্যার নমস্কারের জবাব দিয়ে দীনেশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এরই মধ্যে ক্লাসে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। নিচু গলায় ছাত্রদের কানাকানি ফিসফিসানি লক্ষ্য করে আরিফ স্যার ছাত্রদের দিকে মনোযোগ দিলেন। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে তিনি ছাত্রদের বললেন, তোমরা সবাই চুপ করো। আরিফ স্যারের গম্ভীর গলা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। কিন্তু ক্লাসের একটু দুষ্টু প্রকৃতির মেধাবী ছাত্র মনোয়ার স্যারকে প্রশ্ন করে বসল—স্যার, কী হয়েছে, আমরা কি একটু জানতে পারি?
—কী হয়েছে, সে কথা আমি তোমাদের বলতে পারব না।
এতক্ষণ পড়াবার সময় আরিফ স্যার যতটা স্বতঃস্ফ‚র্ত ছিলেন এখন তার মুখমÐল তার চেয়েও গম্ভীর এবং বিষণ্ন হয়ে আছে। মনোয়ার দমবার ছেলে নয়। সে আবারও প্রশ্ন করে বসে—স্যার, আলীম স্যার তো আপনাকে কানে কানে সব বলে গেলেন।
—সব কথা যদি তোমাদের জানাবার মতো হতো, তাহলে তো তিনি আর কানে কানে বলতেন না; জোরে জোরেই বলতেন।
—না স্যার, সে জন্য বলছি না। সম্ভবত দীনেশের কাছে কিছু লুকাবার জন্যই আপনার কানে কানে বলেছেন। এখন তো দীনেশ নেই, এখন কি আমাদের বলা যায় না?
—না, বলা যায় না। তোমাদের কাছে বলতে হলে স্যারের অনুমতি লাগবে। হেড স্যার নেই, আলীম স্যারের অনুমতি ছাড়া আমি তোমাদের কিছুই বলতে পারব না।
স্যারের কাটা কাটা জবাবে মনোয়ার এবার দমে যায়।
ক্লাসরুমজুড়ে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা।

দীনেশ দুরুদুরু বুকে আলীম স্যারের কক্ষে প্রবেশ করে।
—নমস্কার স্যার।
—নমস্কার। দীনেশ, তোমাকে এখনই বাড়ি যেতে হবে। আমি তোমার জন্য একটা রিকশা ঠিক করতে পাঠিয়েছি। রিকশা এখনই চলে আসবে। তুমি রিকশা চড়ে সোজা বাড়ি চলে যাও। একদম কোনো দুশ্চিন্তা করবে না। হেড স্যার স্কুলে নেই। তিনি থাকলে আমিও তোমার সঙ্গে যেতাম। আশা করছি, তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। তিনি এলেই আমরা রওনা করবো।
স্যারের কথা শেষ হতে না হতেই রুমের দরজায় পিয়ন এসে হাজির—আসসালামু আলাইকুম স্যার, রিকশা নিয়ে এসেছি স্যার।
আলীম স্যারের একটানা কথাগুলো শুনতে শুনতে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে দীনেশ। তার মুখ দিয়ে কোনো কথাই সরছিল না। সে বুঝে ফেলেছে, তার বাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। কী দুর্ঘটনা ঘটতে পারে সেটাই সে এতক্ষণ ধরে চিন্তা-কল্পনা করছিল মনে মনে। কিন্তু কোনো হিসাবই মিলাতে পারছিল না। পিয়নের কথায় তার সম্বিত ফিরে আসে। হাউ মাউ করে দীনেশ আলীম স্যারকে জড়িয়ে ধরে—কী হয়েছে স্যার, আমার বাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে স্যার? কী হয়েছে স্যার, আমাকে একটু বলুন।
—দীনেশ, তোমাকে এতটা ভেঙে পড়লে হবে না। ঘটনা-দুর্ঘটনা জীবনজুড়ে চলতেই থাকে। তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। তুমি এসো, রিকশায় উঠে পড়ো। বাড়ি গেলেই সব জানতে পারবে।
কথা বলতে বলতেই দীনেশের জড়িয়ে ধরা হাতগুলো আলতো করে খুলে দিয়ে আলীম স্যার রুম থেকে বেরিয়ে পড়েন। দীনেশ একটা চলমান পুতুলের মতো স্যারের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। সিঁড়ি থেকে নেমে স্কুল ভবনের নিচতলার বারান্দা ধরে স্যার আগে আগে হাঁটতে থাকেন, দীনেশ তার পিছু পিছু, তারও পেছনে পিয়ন। যেখানে স্কুলের বারান্দার পাশেই একটা রিকশা দাঁড়ানো, সেখানে এসেই আলীম স্যার ঘুরে দাঁড়ান। একেবারে দীনেশের মুখোমুখি।
দীনেশ দাঁড়িয়ে পড়ে, সঙ্গে পিয়নও। আলীম স্যার দীনেশকে বললেন, রিকশায় ওঠো, বাড়ি গেলেই সব জানতে পারবে।
দীনেশ একবার সরাসরি আলীম স্যারের মুখের দিকে তাকায়। কিছু না বলেই আবার মাথা নিচু করে রিকশায় উঠে বসে। রিকশাচালক রিকশা টান দিতে যাবে এমন সময় স্যার বলে ওঠেন—রাখো, রাখো।
তারপর পিয়ন খলিলুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বলেন—খলিলুর রহমান, আপনিও ওর সঙ্গে যান। ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এই রিকশা নিয়েই তাড়াতাড়ি চলে আসবেন। রিকশা ভাড়া এখানে এলেই পাবেন। একদম দেরি করবেন না।
পিয়ন খলিলুর রহমান রিকশায় উঠে বসে। রিকশাওয়ালা ও পিয়ন একই সঙ্গে স্যারকে সালাম দেয়। রিকশা চলতে শুরু করে, কিন্তু আনমনা দীনেশ স্যারকে নমস্কার বলতে ভুলে যায়। রিকশা স্কুলমাঠ পার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আলীম স্যার স্কুলের নিচতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন।
আরিফ স্যার ক্লাসে মনোযোগী হতে পারছেন না। ছাত্রদের মধ্যেও উস্খুস্ ভাব। অবশ্য মনোয়ার দমে যাওয়ার পর কেউ আর কোনো কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। আরিফ স্যার হাতের বইটা বন্ধ করে ছাত্রদের বললেন—আজ আর পড়াতে ইচ্ছা করছে না। তোমাদেরও মনোযোগ নেই। দীনেশের ব্যাপারটা নিয়ে তোমরাও উস্খুস্ করছ। তোমাদের বরং আজকে একটা কবিতা শোনাই। কবিতাটা তোমরা খাতায় লিখে রাখো, মুখস্থ করে রাখো।
দীনেশের ব্যাপারটা নিয়েই এ কবিতা আমার মনে বারবার উঁকি দিচ্ছে।
আরিফ স্যারের কথায় ছাত্ররা নড়েচড়ে বসে। সবাই খাতা-কলম নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায়। স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভারি গলায় কবিতাটি আবৃত্তি করতে শুরু করেন—
মারলে একটা পাখির ছানা
একটাই যায় মরে
ছিঁড়লে একটা ফুলের কলি
একটাই যায় ঝরে,
কিন্তু একটা মারলে মানুষ
করলে একটা খুন
খুন করা হয় সকল মানুষ
সকল তমদ্দুন।
তাই খুনিদের বিরুদ্ধে হও জড়ো
লড়াই লড়াই তুমুল লড়াই করো

শেষের পঙ্ক্তিটি উচ্চারণের সময় স্যারের মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে ওঠে, হাত দু’টিও মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের ভালো লেগে যায় কবিতাটি। স্যার ধীরে ধীরে কবিতাটি আবৃত্তি করলেও অনেকে পুরোপুরি লিখতে পারেনি। ফলে আবারও আবৃত্তির অনুরোধ করে কোনো কোনো ছাত্র। আরিফ স্যার বেশ কয়েকবার কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান। এরই মধ্যে সবার খাতায় কবিতাটি লেখা হয়ে যায়। কারো কারো মুখস্থও হয়ে যায়।
আরিফ স্যার গণিতের শিক্ষক হলেও মাঝে মাঝে নতুন নতুন কবিতা আবৃত্তি করে ছাত্রদের শোনান। পাঠ্যপুস্তকের বাইরের এসব কবিতা শুনে কোনো কোনো ছাত্র মুগ্ধ হয়। আবার কেউ কেউ মনে করে এসব কবিতা শুনে আমাদের কী লাভ? তবে আজকের কবিতাটি প্রায় সবারই মনে ধরে।
সবার খাতায় কবিতাটি লেখা হয়ে যাওয়ার পর এ কবিতা সম্পর্কে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন আরিফ স্যার। ঠিক এ সময় আবারও ক্লাসরুমের দরজায় এসে দাঁড়ান আলীম স্যার।
তড়িঘড়ি করে আলীম স্যারকে সালাম দিয়েই আরিফ স্যার বলেন—আসুন স্যার, আসুন।
আলীম স্যার সালামের জবাব দিতে দিতে ক্লাসরুমের ভেতরে ঢুকে পড়েন। ছাত্ররা দাঁড়িয়ে যায়। আলীম স্যার আরিফ স্যারকে পাশে দাঁড় করিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে বলতে শুরু করেন—আজকের দিনটা তোমাদের বন্ধু, তোমাদের ক্লাসমেট, আমাদের খুবই প্রিয় ছাত্র দীনেশের জন্য খুবই কষ্টের দিন। ওর বাবা আর এ পৃথিবীতে নেই। আজকের জন্য তোমাদের ছুটি। যদি তোমাদের পক্ষে সম্ভব হয় তাহলে তোমরা ওর বাড়িতে যাবে এবং ওকে সান্ত¡না দেবে।
এভাবে অযাচিত ছুটি পেয়েও ছাত্ররা কোনো রকম হৈ-হুল্লোড় না করে চুপ করে থাকলো। গোটা ক্লাসরুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো।
চোখে রুমাল চেপে আলীম স্যার বের হয়ে গেলেন। ছাত্রদের নীরবতার মধ্যে রেখেই আরিফ স্যারও তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

দুই.
রিকশাটি বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। বাড়ির ভেতর থেকে অনেক মানুষের শোরগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আরেকটু এগোতেই দেখা গেল একদল মানুষ জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশাটি জটলার কাছাকাছি হতে না হতেই জটলার ভেতর থেকে কেউ একজন প্রায় চিৎকার করে ওঠে—ওই তো দীনেশ এসে গেছে।
সেই চিৎকারে দীনেশের বুকটা ধড়াস করে ওঠে। স্কুলে সেই আলীম স্যারের রুম থেকেই দীনেশের বুকে দুরুদুরু কাঁপন শুরু হয়েছে। এখন আর সেই দুরুদুরু কাঁপন নেই। আশঙ্কা আর আতঙ্ক তার বহুগুণ বেড়ে গেছে। জটলার লোকটার চিৎকার শোনার পর দুরুদুরু কাঁপন ধড়াস ধড়াস কম্পনে পরিণত হয়েছে। দীনেশের বেগতিক অবস্থা টের পেয়ে পিয়ন খলিলুর রহমান ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন। রিকশাটি মানুষের জটলা পার হয়ে যাওয়ার সময় জটলার ভেতর থেকে একজনের কণ্ঠ যেন তীরের ফলার মতো দীনেশের হৃৎপিন্ডটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে যায়। লোকটা বলছিল—আহারে, অনিমেষের মতো মানুষটাকে এভাবে মেরে ফেললো!
দীনেশের বুকে সাগরের এক বিশাল ঢেউ এসে যেন আছড়ে পড়ল। তার কচি বুক এত বড় ঢেউয়ের আঘাত সহ্য করতে পারছে না। বুকটা তার ভেঙে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে যেন। চোখে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। পিয়ন খলিলুর রহমানের বুকের কাছে দীনেশের মাথাটা যেন চট করে লুটিয়ে পড়েছে। কাঁচা রাস্তা দিয়ে রিকশাটা এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতরের দিকে।
বাড়ির ভেতরে মানুষের হইচই শোরগোলের মধ্যেই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে রোনাজারি। এরই মধ্যে বেশ ক’জন ছুটে এসে দীনেশকে পাঁজাকোলে করে রিকশা থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। পিয়ন খলিলুর রহমান রিকশাওয়ালাকে রিকশাটি স্কুলের দিকে ঘুরিয়ে দিতে বলে। সে রিকশাটি ঘুরিয়ে নেয়।
দীনেশের দাদি আর মা যেখানে বসে রোনাজারি করছেন লোকগুলো দীনেশকে পাঁজাকোলে করে ওখানেই নিয়ে যায়।
দীনেশকে দেখে ওর মা আর দাদি দু’জনেরই কান্নার রোল আরও প্রবল আকার ধারণ করে। কান্নার সেই রোল বাতাসকে এতটাই ভারী করে তোলে যে, উপস্থিত নারী-পুরুষ সবাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মা আর দাদি দীনেশকে জড়িয়ে ধরে এমন হাহাকার শুরু করেন যাতে উপস্থিত লোকজনের কারো মুখেই কোনো কথা সরে না।
সেই সকালে অনিমেষের লাশ পাওয়া গেছে একটি খালের ধারে। অনিমেষের লাশটা যেখানে পাওয়া গেছে সেই জায়গাটা দীনেশদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন অপরিচিত এক মানুষের লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে লাশটি নিয়ে যায়। অনিমেষের বুক পকেটে থাকা পরিচয়পত্র দেখে লাশটি শনাক্ত করে পুলিশ। তারপর বাড়িতে খবর পাঠায়। সঙ্গে সঙ্গেই গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে খবরটি। খবর চলে যায় দীনেশের স্কুলেও।

অনিমেষ থানা শহরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নাইট গার্ডের চাকরি করতেন। সন্ধ্যা নামার আগেই অনিমেষ নিজের বাড়ি থেকে বাইসাইকেলে চেপে দুই মাইল দূরে থানা শহরে চলে যেতেন। আবার সকাল হলেই ফিরে আসতেন বাড়িতে। ফজরের আজান হলেই অনিমেষের ডিউটি শেষ হয়ে যেত। তার স্থানে অন্য গার্ড এসে ডিউটি করতেন। মাঝে মাঝে অন্য গার্ডের সঙ্গে ডিউটি পরিবর্তন করে নিতেন অনিমেষ। রাতের পরিবর্তে দিনেও ডিউটি করতেন। কিন্তু তার নির্দিষ্ট ডিউটি ছিল রাতেই।
গতকালও সন্ধ্যা নামার আগেই দীনেশ আর তার ছোট বোনটিকে আদর করে বাড়ির উঠান থেকেই সাইকেলে চেপে বেরিয়ে গেছেন অনিমেষ। সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে বৃদ্ধা মাকেও একবার ডাক দিয়ে গেছেন।
—মা, মা, আমি গেলাম। সব দিকে খেয়াল রেখো।
দীনেশের দাদি বাড়ির উঠানে বসেই কিছু একটা কাটাকুটির কাজ করছিলেন। বৃদ্ধা ঘাড় তুলে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—বাবারে, সাবধান থাকিস। ভগবান তোর মঙ্গল করুন।
সেই যে গেল অনিমেষ, এখনও আর বাড়ি ফেরেনি। সকাল থেকেই তার বৃদ্ধা মা ছটফট করছিলেন। দীনেশ যখন ওর স্কুল ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে বাড়ির উঠান পার হচ্ছিল স্কুলের উদ্দেশে, তখনও বৃদ্ধা উস্খুস্ করছিলেন—তোর বাপটা এখনও ফেরেনি। সকালে তো ওর কোনো কাজ থাকে না। আজ এত দেরি করছে কেনরে?
দীনেশ জানে ওর বাবা মাঝে মাঝে স্বাভাবিক সময়ের চাইতে একটু দেরি করেই বাড়ি ফেরেন। রাস্তাঘাটে ঘনিষ্ঠ কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে চা- দোকানে বসে একটু চা-পান খেয়ে, গাল-গল্প করেই তারপর বাড়ি ফেরেন। সে কারণে দাদির কথা গায়ে না মেখেই সে স্কুলে চলে যায়।
ময়নাতদন্তের জন্য অনিমেষের লাশ নিয়ে গেছে পুলিশ। ভালো মানুষ অনিমেষের খুনের খবর ছড়িয়ে পড়লে পাড়া-প্রতিবেশী হিন্দু-মুসলমান সবাই অনিমেষদের বাড়ির ছোট্ট উঠানটাতে এসে জড়ো হয়। জীবিত অনিমেষ ফেরেনি বাড়িতে। ফিরবে না আর কোনো দিন। আজই তার লাশ নিয়ে আসবে পুলিশ। এ লাশ হস্তান্তর করা হবে অনিমেষের বৃদ্ধা মা ও তার স্ত্রীর কাছে। সে অপেক্ষায় পাড়া-প্রতিবেশীরা এখনও বসে আছেন দীনেশদের ছোট্ট বাড়িটার আঙিনা ও পাশের রাস্তায়।

অনিমেষের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসে পুলিশ। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাঈনুল ইসলাম একজন জুনিয়র কর্মকর্তা ও কয়েকজন কনস্টেবল নিয়ে লাশ হস্তান্তর করতে আসেন। পুলিশের আগমনের কিছুক্ষণ পরেই উপস্থিত লোকজনের মধ্যে নতুন গুঞ্জন শুরু হয়। পুলিশ নাকি এরই মধ্যে অনিমেষের খুনিদের শনাক্ত করতে পেরেছে। অনিমেষের পরিবার যদি মামলা করে, তাহলে অনিমেষের খুনিদের গ্রেফতার করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কে বা কারা অনিমেষকে খুন করেছে এ ব্যাপারে পুলিশ ছাড়া কারো কাছেই কোনো তথ্য নেই। পুলিশের সঙ্গে কয়েকজন সাংবাদিকও এসেছেন। তারাও এ ব্যাপারে উপস্থিত লোকজনকে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাকি সাংবাদিকদের বলেছেন—এ ব্যাপারে এখনই মুখ খোলা যাবে না। তাহলে তদন্ত কাজ ব্যাহত হতে পারে।
অনিমেষের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ মামলা করতে রাজি হয় না। অনিমেষের মা পাগলিনীর মতো রোদন করেই চলেছেন। ‘আমার অনিমেষ’, ‘আমার অনিমেষ’ ছাড়া তার মুখে আর কোনো কথাই সরতে চায় না। মাঝে মাঝে ‘হায় ভগবান, এ কী হলো’ বলে প্রবল চিৎকার করে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অনিমেষের স্ত্রী, দীনেশের মা কঙ্কনা দাস ছোট মেয়েটাকে কোলে চেপে ধরে নাকি সুরে রোদন করছে ‘ও আমার, এ কী হলো গো’। দীনেশ উদভ্রান্তের মতো বসে আছে। দীনেশকে ঘিরে বসে আছে এ পাড়ার সমবয়সী কয়েকটি ছেলে। সঙ্গে আছে দীনেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবীর ও আসল। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
সন্ধ্যা লগ্নে অনিমেষের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে। দীনেশের সহপাঠীদের অধিকাংশই মুসলমান। তারাও সঙ্গে সঙ্গে যায়। তবে শ্মশানে গিয়ে তারা একটু দূরে বসে থাকে। গোটা গ্রামে হিন্দু পরিবার মাত্র কয়েকটি। এদের মধ্যে দীনেশের নিকটাত্মীয় কেউ নেই। দীনেশের বাবা অনিমেষ ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। অনিমেষের একজন কাকা ছিলেন, যিনি বহু আগেই ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। অনিমেষদেরও তিনি ভারতে চলে যেতে বলেছেন। কিন্তু অনিমেষ রাজি হননি। জন্মভূমির মায়া কাটিয়ে, সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে ভারতে যেতে তার মন সায় দেয়নি। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে এক অন্যরকম আত্মীয়তার বন্ধন ছিল অনিমেষের। মুসলমান পরিবারগুলোতেও অনিমেষের যাতায়াত ছিল অবাধ। সরলপ্রাণ, পরোপকারী মানুষ হিসেবে অনিমেষকে সকলেই পছন্দ করতো। দীনেশও অনেকটা তার বাবার মতোই হয়েছে।
অনিমেষের লাশ দাহ করতে করতে রাত অনেক হয়ে গেছে। দীনেশকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। উদভ্রান্তের মতো বড়দের পরামর্শ মোতাবেক সবই করেছে দীনেশ। শ্মশান থেকে ফেরার পথে দীনেশের পা আর চলতে চায় না। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারিয়ে পথের ওপর লুটিয়ে পড়ে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবির ও আসল দীনেশকে কোলে তুলে নেয়। দীনেশের শরীরের অর্ধেক অংশ থাকে আবিরের হাতে, বাকি অর্ধেক আসলের হাতে। আবির ও আসল দীনেশকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। দীনেশের জ্ঞান ফিরলে আবির ও আসল বাড়ি ফেরার জন্য দীনেশের কাছ থেকে বিদায় নেয়। যাওয়ার সময় দীনেশকে ওরা সান্ত¡না দেয়। আবির খুব আন্তরিকতার সঙ্গে দীনেশকে বলে—দীনেশ, তুই একদম ভেঙে পড়বি না, তোকে শক্ত হতে হবে। তোর মা, তোর ঠাকুরমা, তোর ছোট বোনটার দিকে তাকিয়ে তোকে শক্ত হতে হবে। তোর বাবাকে তুই আর ফিরে পাবি না। এটাই সত্য। তোকে অবশ্যই শক্ত হতে হবে দীনেশ। তুই ভেঙে পড়লে সব তছনছ হয়ে যাবে।
আবিরের দরদমাখা কথাগুলো শুনতে শুনতে দীনেশের মনে আবেগের প্লাবন সৃষ্টি হয়। সেই প্লাবনকে সে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে দীনেশ। আসল দীনেশকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দিতে চায়—দীনেশ, তুই শান্ত হ, শক্ত হ। অনিমেষ কাকার এমন মৃত্যুতে আমরাও তোর মতোই কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই দীনেশ।
আসল হাত দিয়ে দীনেশের চোখের পানি মুখে দেয়। দীনেশও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। তবে আসলের কথা শুনতে শুনতে আবির কিছুটা তপ্ত হয়ে ওঠে। একটু ফাঁক পেয়ে আবির ফোঁস করে বলে ওঠে।
—আসল, তোমার কথা ঠিক না, কে বলেছে যে, আমাদের কিছুই করার নেই? অবশ্যই আমাদের অনেক কিছু করার আছে। দীনেশের পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।
অনিমেষ কাকার খুনিদের খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু এসব করতে হলে দীনেশকে শক্ত হতে হবে।
আবিরের কথা শুনে আসলের বোধ-বুদ্ধি তৈরি হয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আসল বলে ওঠে—তুই ঠিকই বলেছিস আবির। আমার শুধু নামই আসল, কিন্তু আসল কথাটা আমার মাথায় আসে না সহজে। এখন তুই-ই বল, আমরা তো ছোট মানুষ, আমরা কিভাবে কী করব?
—আমি বাড়ি ফিরে আব্বুর সঙ্গে কথা বলব। তুই বাড়ি গিয়ে চাচাজানের সঙ্গে কথা বল। আমরা কিছু করতে না পারলেও আমাদের মুরব্বিরা পারবেন। আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করব। অনিমেষ কাকার মতো মানুষ কোনো অপরাধমূলক কর্মকাÐের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। তাকে কোনো অপরাধের জন্য খুন হতে হয়নি। তার খুন হওয়াটা পুরোটাই রহস্যময়। খুনিদের উদ্দেশ্য কী, আল্লাহই জানেন। চেষ্টা করলে আমরাও জানতে পারব। আমাদের চুপ করে থাকলে চলবে না।
একনাগাড়ে কথা বলতে থাকে আবির। শেষের দিকে তার কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয়ে ওঠে। আসল আবিরের কথায় একমত হয়। দু’জনই কাল সকালে দেখা হবে বলে দীনেশের কাছ থেকে বিদায় নেয়।


তিন.
আসরের নামাজ আদায় করে মাওলানা হাসান সাহেব মসজিদে বসে আছেন। নামাজ শেষ করে মাওলানা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় মসজিদেই বসে আছে আবির ও আসল। মাওলানা হাসান ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন জায়নামাজে। তার ধ্যান ভাঙাতে কারোই ইচ্ছে করে না। তবু আবির ও আসল অনুচ্চস্বরে পরস্পর কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়, মাওলানা সাহেবের ধ্যান ভাঙাতে হবে। তার সঙ্গে এ মুহূর্তে কথা বলা জরুরি। মসজিদে আরও ক’জন মানুষ এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নামাজ আদায় করছেন। আবির মাওলানা সাহেবের নিকটবর্তী হয়ে নিচু স্বরে সালাম দিয়ে তার সঙ্গে কিছু কথা বলার অনুমতি চায়। মাওলানা সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন আবির ও আসলকে। ইশারায় ওদের বসতে বলে নিজেও ঘুরে বসেন। আবিরই কথা শুরু করে।
—হুজুর, আমরা আপনার সঙ্গে অনিমেষ কাকার বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।
মৃদু হেসে মাওলানা হাসান জানতে চান—কী কথা বলতে চাও অনিমেষকে নিয়ে? এ বিষয়ে তো তোমাদেরকেও আমার কিছু বলার আছে। আমি শুধু ভাবছি, কথাটা আমি কিভাবে প্রকাশ করব।
কথার মাঝখানে একটু বিরতি দিয়ে আবির ও আসলের দিকে সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন—আচ্ছা ঠিক আছে, আমার কথা না হয় পরেই বলা যাবে। আগে তোমাদের কথাই বল।
কথা শুরু করে আবির—হুজুর, অনিমেষ কাকার পরিবারের এখন কী হবে? ওদের তো আয়ের কোনো উৎস নেই। অনিমেষ কাকার আয় দিয়ে ওদের সংসার চলত। এখন ওরা অসহায়। ওদের ব্যাপারে আমাদের কিছু একটা করতে হবে।
মাওলানা সাহেব মাথা ঝাঁকিয়ে আবিরের কথায় সায় দিয়ে জিজ্ঞেস করেন—তুমি কি তোমার আব্বুর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছ?
—জি, বলেছি। আসলও ওর আব্বুর সঙ্গে কথা বলেছে। দু’জনই বলেছেন, ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে। ওনারাও আপনার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করবেন।
—খুবই ভালো কথা। এখন তোমরাই বল এ ব্যাপারে কী করা যায়। তোমরা ছাড়া কেউই আমার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আসেনি। আজ ক’দিন ধরে আমিও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।
মাওলানা সাহেবের কথার মাঝখানে ঢুকে পড়ে আসল—হুজুর, আপনি বলছিলেন, আপনারও কী যেন বলার আছে। কথাগুলো কি আমাদের বলা যায়? আমরা তো বুঝতেই পারছি না কেন অনিমেষ কাকাকে খুন করা হলো।
—আমার মাথায়ও কিছু ঢুকছে না। অনিমেষ আমার সমবয়সী। আমার সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা সেই ছোটবেলা থেকে। সমবয়সী হলেও সে আমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। যেকোনো ব্যাপারে আমার সঙ্গে পরামর্শ করতো। আমি সেই ছোটবেলা থেকেই মাদরাসায় পড়তাম। সেই সময় থেকেই দেখতাম, অনিমেষ কখনো আমাকে নাম ধরে ডাকে না। হুজুর, হুজুর বলেই সে আমাকে সম্বোধন করত। ও আমাকে এতটাই সম্মান করত যে, ওর বিয়েতেও আমাকে দাওয়াত করেছিল। ওর আবদার রক্ষা করতে গিয়ে ওর বিয়ের সেই ছোট্ট অনুষ্ঠানটিতেও আমার থাকতে হয়েছিল। আমি ওর কোনো শত্রæ দেখিনি কোনোদিন। কারা, কেন অনিমেষকে খুন করেছে, এ সমীকরণ আমি কোনোভাবেই মেলাতে পারছি না। তা ছাড়া আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছে…।
—হুজুর, ব্যাপারটা কি আমাদের কাছে খুলে বলা যায় না?
—তোমাদের কাছে বলতে আমার কোনোই আপত্তি নেই। কিন্তু অনিমেষের খুনের রহস্যটা জানার আগে তোমাদের কাছে ব্যাপারটি প্রকাশ করতে আমার একটু দ্বিধা হচ্ছে। তোমরা যদি আমাকে কথাটি আপাতত গোপন রাখার প্রতিশ্রæতি দাও, তাহলে ব্যাপারটি তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করে আমিও কিছুটা হালকা হতে পারি।
কথা বলতে বলতে মাওলানা হাসান মসজিদের ভেতরটা একবার দেখে নেন। আবির, আসল আর তিনি নিজে ছাড়া এ মুহূর্তে মসজিদে আর কোনো মানুষ নেই। মাওলানা সাহেবের দৃষ্টি অনুসরণ করে আবির ও আসলের চোখও মসজিদের ভেতরটা একবার দেখে নেয়। জামায়াতে শরিক হতে পারেননি এমন দু’জন মুসল্লি মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন। আবির কোনো প্রকার দ্বিধা না করে বলে ওঠে—হুজুর, আপনি জানেন, আমরা আপনার অবাধ্য নই। আমরা দু’জনই আপনার নিকট কুরআন পড়তে শিখেছি। আমরা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি। আপনি যেভাবে বলবেন, ঠিক সেভাবেই হবে।
কথা শেষ করেই আসলের দিকে তাকায় আবির। আসলেরও একই কথা—হুজুর, আপনি আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন।
মাওলানা হাসান কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েন। তার সামনে বসে থাকা এই কিশোর ছেলে দু’টির নাম রেখেছেন তিনি নিজেই। উভয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে মাওলানা হাসানকে নবজাতক দু’টির নাম রাখার অনুরোধ করা হয়েছিল। এদের জন্ম হয়েছিল খুব কাছাকাছি সময়ে। মাওলানা হাসান তাদের যে নাম প্রস্তাব করেছিলেন, উভয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে সে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। আহমদ আদনান আবির ও আদিল উদ্দীন আসল। মাওলানা হাসান মনে মনে ভাবছিলেন, জন্মলগ্ন থেকেই এদের সঙ্গে নামের ব্যাপারটা নিয়ে তার একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। অতএব এদের ওপর আস্থা রাখা যায়।
মাওলানা সাহেবকে আনমনা হতে দেখে আবির ও আসল চুপ করে থাকে। এক পর্যায়ে মাওলানা সাহেবই কথা শুরু করেন।
—দ্যাখো, তোমাদের ওপর আমার আস্থার অভাব নেই। কিন্তু তোমাদের বয়স এখনও অনেক কম। এ বয়সে বুদ্ধি-বিবেচনার চাইতে আবেগ বেশি ভর করে। সে জন্যই আমি একটু দ্বিধা করছিলাম। তোমাদের আগ্রহ দেখে আমার দ্বিধাও কেটে গেছে। তোমাদের কাছে বিষয়টি প্রকাশ না করলে আমি আর শান্তি পাবো না। এমনিতেই আমার মন বড় অশান্ত হয়ে আছে। বিষয়টি তোমরা আপাতত গোপন রাখবে। সময়মতো কথাটি আমিই প্রকাশ করব সবার নিকট।
একটু থামেন মাওলানা হাসান। এরপর যে ঘটনা তিনি বর্ণনা করেন তা শুনে আবির ও আসলের চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। দীনেশের বাবা অনিমেষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কবে, কখন, কিভাবে, সে ঘটনাই আবির ও আসলের নিকট বর্ণনা করেন মাওলানা হাসান।
—আমার সঙ্গে অনিমেষের সম্পর্ক সেই শৈশবের। চলাফেরা ও খেলাধুলাও করতাম একসঙ্গে। মাঝে কয়েক বছর আমি মাদরাসার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতাম। ফলে বাড়িতে আসা হতো কম। অনিমেষের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ হতো না তেমন একটা। মাঝে মাঝে বাড়ি এলে যখন অনিমেষের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতো, তখন দেখতাম সে আমার প্রতি শ্রদ্ধায় বিগলিত। কথা বলার মতো কিংবা আড্ডা দেয়ার মতো সময় তখন হাতে থাকতো না। আমি ভাবতাম, অনিমেষ নিজে লেখাপড়ায় অগ্রসর হতে পারেনি, আমি এগিয়ে যাচ্ছি, আলেম হয়ে যাচ্ছি সে কারণেই হয়তো সে আমার প্রতি শ্রদ্ধাভাব দেখায়। আব্বাজানের ইন্তেকালের পর আমি হোস্টেল ছেড়ে বাড়িতে চলে আসি। বাড়ি থেকেই লেখাপড়া চালিয়ে যাই। এ সময় থেকে অন্য সবার মতো অনিমেষের সঙ্গেও আমার নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হতে থাকে। প্রায়ই দেখতাম, অনিমেষ আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়, কথাবার্তা বলতে চায়। ফলে দেখা-সাক্ষাৎ হলে আমিও আর দু’চার কথায় তাকে বিদায় করি না। একটু দীর্ঘ সময় আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়। তখন থেকেই দেখতাম ইসলামের ব্যাপারে তার প্রবল আগ্রহ। তার এ আগ্রহ দেখে আমার খুবই ভালো লাগত। তার প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, তবুও কখনো বিরক্ত হতাম না। আমার বরং তার প্রশ্নের জবাব দিতে খুব ভালো লাগত। অনেক সময় অনিমেষ আমাকে এমন সব প্রশ্ন করত, যে সব প্রশ্নের জবাব আমার জানা থাকতো না। আমি বিস্মিত হয়ে অনিমেষের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বলতাম, অনিমেষ, আমি জানি না, জ্ঞানবান ব্যক্তিদের কারো কাছ থেকে জেনে তোমাকে বলব। অনিমেষের প্রশ্নগুলো নিয়ে আমি অনেক সময় চিন্তায় পড়ে যেতাম। আলেম-ওলামাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতাম কিংবা বইপত্র জোগাড় করে নিতাম। আমি আমার ছাত্রজীবনে সেসব বিষয় জানতাম না যেগুলো অনিমেষের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমাকে জানতে হয়েছে। আমি ছাত্রজীবনে এত বই পড়িনি যত বই পড়তে হয়েছে অনিমেষের প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে। অনিমেষ শুধু ইসলাম ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করতো না, নানা ধর্ম ও বিষয় নিয়ে সে আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতো। অনিমেষ আমাকে হাসান ভাই বলে ডাকতো, আমি ওকে ডাকতাম অনিমেষ বলে। আমাকে আর অনিমেষকে একসঙ্গে দেখলে কেউ কেউ বলত ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই/হাসান ছাড়া অনিমেষ নাই’। যদিও অনিমেষের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ধর্মীয় ছিল না, ছিল মানবিক। আমি কোনোদিন তার বাড়িতে কোনো পূজার অনুষ্ঠানে যোগ দিইনি, সেও আমার বাড়িতে কোনো দোয়ার মাহফিলে হাজির হয়নি।
একটানা অনেক কথা বলে মাওলানা হাসান থামলেন। বিস্মিত হয়ে শুনছিল আবির ও আসল। ওরা চুপ করেই থাকলো। মাওলানা হাসান আবার শুরু করলেন—তোমরা তো জানো, অনিমেষ সবার সঙ্গেই মিশতো। সবার সঙ্গেই তার সদ্ভাব ছিল। আড্ডা দিতেও সে পছন্দ করতো। কিন্তু আমাকে সে সবসময় একা পেতে চাইতো। সময়ের অভাবে আমি তাকে মাঝে মাঝে বই দিতাম। দিয়ে বলতাম, এটা পড়লে এটা জানতে পারবে। কিন্তু দু’দিন পরেই বইটি আমার হাতে ফেরত দিয়ে বলত, ‘বই পড়ে আমার জ্ঞান অর্জন হবে না। বই পড়ে আমি কিছু বুঝতে পারি না।’ বলতে গেলে তার কারণেই আমি এত বই পড়তে আগ্রহী হয়েছি, অথচ তাকে দিয়ে বই পড়াতে পারলাম না। বাংলা সে ভালোই পড়তে পারতো। পত্রিকার খবর পড়তো সে; কিন্তু বই তার মাথায় ঢুকতো না। ফলে আমিও তাকে দিয়ে বই পড়ানোর চেষ্টা বন্ধ করে দিয়েছি।
অনিমেষের মনে অনেক দুঃখ ও ক্ষোভ ছিল। তার দুঃখ ও ক্ষোভের কথা আমি জেনেছিলাম অনেক পরে। একদিন সবিস্তারে সে এসব বলেছিল আমাকে। অনিমেষের বাবা রমেশের মৃত্যুর পর অনিমেষের কাকা ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দেয় গোপনে। তার নিজের অংশ বিক্রি করে সে ভারতে চলে যায়। ভিটেবাড়ি বিক্রি করার জন্য অনিমেষকেও সে ফুসলিয়েছে। কিন্তু সে পথে পা বাড়ায়নি অনিমেষ। অনিমেষের কাকা পরেশ সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার পর জানা যায়, হারুন মাতবর গোপনে ওদের সব জমি কিনে নিয়েছে। পরেশ চলে যাওয়ার পর জমির দখল নেয় হারুন। এরপর থেকে হারুন মাতবর অনিমেষকে ফুসলাতে থাকেন, ‘দেখো অনিমেষ, এক বাড়িতে হিন্দু-মুসলমানের সম্পত্তি থাকা ঠিক না। নানান সমস্যা হয়। তুমি বরং তোমার অংশটা আমার কাছে বিক্রি করে দাও, নতুবা পরেশের অংশটা আমার কাছ থেকে কিনে নাও। পরেশ আমাকে বলেছিল, তোমরাও তোমাদের অংশটা বিক্রি করে চলে যাবে। সে ভরসায় আমি পরেশের সম্পত্তি কিনেছিলাম। এখন আমি মহামুশকিলে পড়ে গেছি। আমি ভেবেছিলাম আমার এক ছেলেকে এ বাড়িতে ঘরদোর তুলে দেবো। কিন্তু আমার কোনো ছেলেই হিন্দু বাড়িতে বসবাস করতে রাজি হচ্ছে না। সে কারণেই আমি তোমাকে এ প্রস্তাব দিচ্ছি।’
হারুন মাতবরের কাছ থেকে অনিমেষের পক্ষে পরেশের অংশ কিনে রাখা কোনো মতেই সম্ভব না। জমি কেনার মতো টাকা অনিমেষের হাতে নেই। জোগাড় করাও সম্ভব না। সুতরাং একটা চমৎকার টোপ ফেলে হারুন মাতবর। অনিমেষ সবই বুঝতে পারে। কিন্তু শান্তিপ্রিয় অনিমেষ হারুন মাতবরের যুক্তিকেও প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। হারুন মাতবরের চাপে পড়ে অনিমেষ একদিন ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে রাজি হয়ে যায়। বর্তমানে দীনেশদের যে ছোট বাড়িটা আছে, এ বাড়ির জন্য জমিটুকু রেখে বাকি সব জায়গা-জমি হারুন মাতবরের কাছে বিক্রি করে দেয় অনিমেষ। এ নিয়ে গ্রামে টুকটাক কানাঘুষা হলেও অনিমেষের কথায় এসব কানাঘুষা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। অনিমেষ সবাইকে জানিয়ে দেয়, নতুন বাড়ি করার জন্যই স্বেচ্ছায় সে পৈতৃক ভিটা বিক্রি করে দিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই রাস্তার পাশে অনিমেষের ছোট্ট বাড়িটা তৈরি হয়। অনিমেষ নতুন বাড়িতে উঠেছে বেশিদিন হয়নি। এটা তো তোমরাও দেখেছ। অনিমেষের নতুন বাড়িটার ওপরও হারুন মাতবরের চোখ পড়ে। এখান থেকে অনিমেষকে উচ্ছেদ করতে চায় হারুন মাতবর। চরে অনেক বেশি জমি দেয়ার লোভ দেখিয়ে এ বাড়িটাও বিক্রি করে দিতে বলে হারুন মাতবর। কিন্তু এ গ্রামের লোকদের ছেড়ে এত দূরে নতুন জায়গায় গিয়ে বাড়ি করতে রাজি হয় না অনিমেষ।
কথা বলতে বলতে আবারও থামলেন মাওলানা হাসান। এই সুযোগে আবির বলে ওঠে—হুজুর, এসব কথা তো কেউই জানতো না। তাহলে কি হারুন মাতবরের হাতেই খুন হয়েছে অনিমেষ?
—হ্যাঁ, এসব কথা কেউই জানতো না। আমিও জেনেছি খুব বেশিদিন হয়নি। তবে আমার মনে হয় না, এইটুকু বাড়ির জন্য হারুন মাতবর অনিমেষকে খুন করতে পারে। বললেন মাওলানা হাসান।
রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল আবির ও আসল। এবার আসলই প্রশ্ন করে—হুজুর, অনিমেষ কাকা মুসলমান হলেন কবে, কিভাবে?
—সে কথা বলার জন্যই এত কথা বললাম। এই কিছুদিন আগে অনিমেষ যখন আমাকে তার এসব কথা জানিয়েছে সে সময়ই সে মুসলমান হওয়ার ইচ্ছার কথা আমাকে জানায়। একদিন আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ হঠাৎ করেই বলে বসে—হাছান ভাই, আমি মুসলমান হয়ে যেতে চাই। আমার মনটা খুব ছটফট করছে মুসলমান হওয়ার জন্য। আমি আমার মা ও স্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছি। তারাও রাজি। আমার ছেলেমেয়েরাও রাজি হয়ে যাবে। আমরা সপরিবারে মুসলমান হয়ে যাবো। তুমি আমাদের মুসলমান বানানোর ব্যবস্থা করো।
আমি হতভম্ভ হয়ে কিছুক্ষণ অনিমেষের দিকে তাকিয়ে থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আমি কেঁদে ফেললাম। বেশ কিছুক্ষণ অনিমেষকে জড়িয়ে ধরে আমি ভাবছিলাম, অনিমেষকে এখনই মুসলমান বানানো ঠিক হবে না। ও আর ওর পরিবারের সদস্যরা আরও ভালোভাবে ইসলাম বুঝুক। তারপর সবাইকে জানিয়ে ওদের কালিমা পড়িয়ে মুসলমান বানানো যাবে। আমি ওকে আরও একটু সময় নিতে বলেছিলাম। এর কারণও আছে। আমাদের দেশে সপরিবারে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে, সে ঘটনাকে অনেক সময় অনেক রঙচঙ লাগানো হয়। বলা হয়, জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। অনিমেষ যাতে সবদিক বুঝে-শুনে শক্তভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে সে জন্যই আমি তাকে আরও সময় নিতে বলেছিলাম। আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যাপারটি সম্পন্ন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে সুযোগ আর হলো না। এরই মধ্যে অনিমেষ আমাকে বহুবার চাপ দিয়েছিল ব্যাপারটি সেরে ফেলার জন্য। আমি তাকে দমিয়ে রেখেছিলাম। একদিন সে আমাকে বলেছিল, ‘হাসান ভাই, তুমি আমার মনের ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না। তুমি কেবল আইনের কথা বলছ। আমি মুসলমান হতে চাইলে কে আমাকে বাধা দেবে? বাধা দিলেও আমি কিছুই মানব না। তুমি মনে রেখ, এরই মধ্যে আমি মনে মনে মুসলমান হয়ে গেছি। আমার মা ও স্ত্রীর একই অবস্থা। আমার ছেলেমেয়েদেরও আমি বোঝাতে শুরু করেছি। ওরাও কোনো আপত্তি করছে না। তাহলে কেন অপেক্ষা করব আমরা, কেন সত্য থেকে দূরে থাকব?’ অনিমেষের কথা শুনে আমার বুকে আবেগের ঢেউ উঠতো। কিন্তু বাস্তবতা বিচার করে আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি। এখন অনিমেষ নেই। এ ব্যাপারে ওর পরিবারের সদস্যদের কী মনোভাব আমি বলতে পারব না। তোমরা দীনেশের বন্ধু। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওর কাছ থেকে তোমরা ওদের মনোভাব জেনে নিতে পার।
আমি নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে করে খুব কষ্ট পাচ্ছি। অনিমেষকে দাহ করা হয়েছে। কিন্তু ও তো আমাকে সাক্ষী রেখে মনে মনে মুসলমান হয়ে গেছে। আমার হাতে কোনো প্রমাণ না থাকায় ওকে নিয়ে আমি কিছুই বলতে পারিনি, কিছুই করতে পারিনি। শুধু মনে মনে প্রার্থনা করছি—হে আল্লাহ, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, অনিমেষকে কবুল করুন, ওর পরিবারকে কবুল করুন।

বলতে বলতে অশ্রæসিক্ত হয়ে ওঠেন মাওলানা হাছান। আবির আর আসলের চোখেও পানি এসে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাওলানা হাসান বলেন, মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। এখন মুসল্লিরা চলে আসবেন। তোমরা এসব কথা এখনই কাউকে বলবে না। দীনেশদের কিভাবে সহযোগিতা করা যায়, সে ব্যাপারটা আমি দেখব। প্রয়োজন হলে তোমাদেরকে ডাকব। তোমরাও চিন্তা-ভাবনা করতে থাকো। আল্লাহ পাক আমাদের সাহায্য করবেন।

চার.
দেখতে দেখতেই কেটে যায় দিন। সময় আর ¯্রােত নাকি কারো জন্যই অপেক্ষা করে না। দীনেশের দিনও বসে থাকে না, কেটে যায়। সকালের সূর্য সন্ধ্যায় অস্তমিত হয়। একেকটা দিন পার হয়ে যায় এভাবেই। অনিমেষ খুন হওয়ার পর এক মাস পার হয়ে গেল। কিন্তু এ খুনের কোনো কারণ জানা গেল না। দীনেশ প্রায়ই অসহায়ের মতো ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে। আবির আর আসল প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দু’বার করে দীনেশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ওরা এলে দীনেশের অসহায় ভাব কিছুটা কেটে যায়। ওরা চলে গেলে আবার যেই-সেই। মা, ঠাকুরমা, এমনকি ছোট বোনটার সঙ্গেও কোনো ভাব-বিনিময় হয় না দীনেশের। আবির আর আসলের সঙ্গ ছাড়া, বাকি সময়টা দীনেশ ধ্যানের জগতেই কাটিয়ে দেয়।
গত এক মাস দীনেশের লেখাপড়া, খেলাধুলা, স্কুলে যাওয়া বন্ধ। স্কুলের শিক্ষকরা দল বেঁধে এসেছিলেন দীনেশকে দেখতে, ছাত্ররাও এসেছিল। ওরা সবাই মিলে দীনেশকে সান্ত¡না দিয়েছে, আগের মতো লেখাপড়া চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছে। শিক্ষকদের চেষ্টায় স্কুল কর্তৃপক্ষ দীনেশের টিউশন ফিও মওকুফ করে দিয়েছে। সে খবরও দীনেশকে দেয়া হয়েছে। স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকরা চাঁদা দিয়ে দীনেশের পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য একটা ফান্ড গঠন করেছে। সেই ফান্ডের যৎসামান্য টাকাও দীনেশের মায়ের হাতে দিয়ে গেছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এদিকে আবির ও আসলের প্রচেষ্টায় গ্রামের লোকজনও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দীনেশের পরিবারকে সহযোগিতার জন্য তারাও একটি ফান্ড গঠন করেছে। মাওলানা হাসানসহ গ্রামের গণ্যমান্য লোকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দীনেশের পরিবারকে নিয়মিতভাবে সাহায্য করা হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আবিরের আব্বু রাকীব উদ্দীন আহমদ এবং আসলের আব্বু আবুবকর সিদ্দিক। তারা দু’জনই বিদেশে ভালো চাকরি করেন। প্রতি বছর একই সময়ে দু’জনই দেড়-দু’মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। গ্রামের গরিব মানুষকে সহযোগিতা এবং সামাজিক উন্নয়নে এরা থাকেন সবার আগে। দীনেশের পরিবারকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
দীনেশকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে আবির ও আসলের চেষ্টার কমতি নেই। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ফজরের নামাজ আদায় করেই আবির ও আসল দীনেশদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা করে। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখা যায়, দীনেশদের বাড়ির প্রবেশমুখে রাস্তার ওপর একটি পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আবির ও আসল গাড়ির কাছাকাছি হয়। গাড়িতে কেউ নেই। সম্ভবত পুলিশের লোকেরা দীনেশের বাড়িতে এসেছে। এগিয়ে যায় আবির ও আসল। দীনেশদের বাড়ির উঠানে পৌঁছাতেই ওরা দেখতে পায় পুলিশদের। থানার একজন তদন্ত কর্মকর্তা দুইজন কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এত ভোরে এখানে পুলিশ দেখে কিছুটা অবাক হয় আবির ও আসল। গত এক মাসে পুলিশের কোনো দেখা-সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। হঠাৎ এই সাতসকালে পুলিশ কেন? দীনেশদের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কোনো মামলাও করা হয়নি। অনিমেষের যে কাকা ভারত চলে গেছেন তিনি ফোন করে অনিমেষের মাকে বলেছিলেন থানায় মামলা করার জন্য। অনিমেষের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘মামলা করে কী হবে, আমি কি আমার অনিমেষকে ফিরে পাবো? মামলা করে যদি আমার অনিমেষকে আমি ফিরে পেতাম, তাহলে অবশ্যই আমি মামলা করতাম। না, আমি মামলা করব না। ভগবান আমার অনিমেষকে ভালো রাখুন, আমি শুধু এই কামনাই করব?’
তাহলে আবার পুলিশ কেন? ভাববার সুযোগ পায় না আবির ও আসল। দীনেশ, দীনেশের মা ও ঠাকুরমার সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে যাবে এমন সময় আবির ও আসলকে দেখতে পান পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি দীনেশকে জিজ্ঞেস করেন—এরা কারা?
—আমার বন্ধু। সংক্ষেপে জবাব দেয় দীনেশ।
—ওরা কি তোমার খুব কাছের বন্ধু? তোমরা কি একই ক্লাসে পড়? জানতে চান তদন্ত কর্মকর্তা।
—জি, ওরা আমার খুব কাছের বন্ধু। আমরা একই ক্লাসে পড়ি। জবাব দেয় দীনেশ।
তদন্ত কর্মকর্তা আবির ও আসলকে ভালো করে দেখে নেন। একটু উসখুস করে বলেন—তাহলে তো ওদের সঙ্গেও একটু কথা বলতে হয়।
—জি, বলতে পারেন। বলেই দীনেশ আবির ও আসলের দিকে তাকায়।
ওরা দু’জন তদন্ত কর্মকর্তাকে সালাম দিয়ে তার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। তদন্ত কর্মকর্তা আবির ও আসলের পরিচয় জেনে নিয়ে তাদেরকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেন। খুবই সাদামাটা প্রশ্ন। ওরাও একে একে সব প্রশ্নের জবাব দেয়। তদন্ত কর্মকর্তার হাবভাব কিছুই বোঝা যায় না। তবুও ওরা তদন্ত কর্মকর্তাকে দু’একটি পাল্টা প্রশ্ন করে। ওদের পাল্টা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই তদন্ত কর্মকর্তা জানান, অনিমেষের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা না হলেও পুলিশ বাদি হয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে। এ মামলার তদন্ত কাজেই এসেছেন তিনি। প্রয়োজন হলে আবারও আসবেন। আবির ও আসলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য মোবাইল নাম্বার নেন তিনি। নিজের নাম্বারও দেন ওদেরকে। কোনো ব্যাপারে ওদের কোনো সন্দেহ জাগলে কিংবা কোনো তথ্য পেলে যেন তাকে জানানো হয়, এ অনুরোধও করেন তিনি। যাওয়ার সময় বলে যান, প্রয়োজন হলে আমি আবারও আসবো।

তদন্ত কর্মকর্তা বিদায় নেয়ার পর আবির ও আসল দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। ভোরের বাতাস সেবন করতে করতে তিনজনই হাঁটতে থাকে।
—এভাবে আর কতদিন যাবে দীনেশ? তুই এবার স্কুলে যাওয়া শুরু করে দে। এভাবে মনমরা হয়ে শুয়ে বসে থাকলে তো তুইও অসুস্থ হয়ে পড়বি।
—কারো মুখের দিকে তাকাতে পারি না রে। বুকের ভেতরটা কেবল হু-হু করতে থাকে। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না, কিচ্ছু ভাল্লাগে না । আমি কী করব বল?
আবিরের কথার জবাব দিতে গিয়ে দীনেশের চোখ পানিতে ভরে যায়। জামার হাতার প্রান্ত দিয়ে সে চোখ মোছে।
—পুলিশ দেখছি হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠেছে। অনিমেষ কাকার খুনিদের কি ওরা খুঁজে বের করতে পারবে? নাকি শুধু শুধু নিয়ম রক্ষার জন্যই এসব করছে পুলিশ?
আসলের মন্তব্যধর্মী প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না আবির। সেও পুলিশের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। ভেবে কোনো ক‚লকিনারা পাচ্ছে না। ব্যাপারটা নিয়ে হাসান হুজুরের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত মনে মনে পাকা করে নেয় আবির।
—পুলিশ কী করবে জানি না রে। পুলিশের ব্যাপারটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। পুলিশের ওপর আমার কোনো আস্থাও নেই। নেপাল কাকার মেয়েটা যে খুন হয়ে গেল, ধানক্ষেতের মাঝখানে লাশ পাওয়া গেল, কই, সে ব্যাপারেও তো পুলিশ কোনো ক‚লকিনারা করতে পারল না। নেপাল কাকা তো কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলাও করেছিলেন। কিচ্ছু হয়নি। উল্টো নেপাল কাকাই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।
অনেক দিন পর স্বতঃস্ফ‚র্ত কণ্ঠে কথা বলছে দীনেশ। নেপাল কাকার করুণ কাহিনী মনটাকে বিষাদাক্রান্ত করে তুললেও দীনেশের কণ্ঠস্বর শুনে খুবই খুশি হয় আবির ও আসল। দীনেশকে আজই অনেকটা স্বাভাবিক লাগছে। এতদিন দীনেশের মুখ থেকে কথা বেরুত চাইতো না। আজ নিজে নিজেই অনেক কথা বলছে। দীনেশকে নিয়ে এতদিনের দুশ্চিন্তার বোঝা কিছুটা হালকা হয় আবির ও আসলের।


পাঁচ.
গ্রামে পুলিশের আনাগোনা বাড়তে থাকে। পুলিশ নাকি অনিমেষের খুনের ঘটনা তদন্ত করছে। মাঝে মাঝেই জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে দু’একজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। দু’একদিনের মধ্যে তারা আবার ছাড়াও পেয়ে যায়। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ছাড়াতে হয়। নির্দোষ লোকদের হয়রানিতে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে গ্রামবাসী। গ্রামে পুলিশ এলেই সবার মধ্যে পালাই পালাই ভাব তৈরি হয়ে যায়।
এরই মধ্যে একদিন ভোরবেলা মাওলানা হাসানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ফজরের অনেক আগে নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ফজরের নামাজের সময় এলাকাবাসী জানতে পারেন, মাওলানা হাসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাওলানা হাসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে, অনিমেষকে খুন করার অভিযোগে। কেন মাওলানা হাসান অনিমেষকে খুন করতে যাবেন? গ্রামের লোকেরা কিছুতেই এ ঘটনা বিশ্বাস করে না। তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। পুলিশের পক্ষ থেকেও পাল্টা হুমকি আসে। যারা একজন খুনিকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ করবে, তাদেরকেও এ খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হবে। পুলিশের ভয়ে প্রতিবাদ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লেও তলে তলে এলাকাবাসী ফুঁসতে থাকেন। ষড়যন্ত্রের গোড়া অনেক শক্ত, এটা টের পেতে কারোরই দেরি হয় না। অনিমেষের কোনো শত্রæ না থাকলেও মাওলানা হাসানের শত্রæ সংখ্যা কম নয়। মাদক ব্যবসায়ী, জুয়াড়ি ও চাঁদাবাজ চক্রের হোতারা মাওলানা হাসানকে তাদের শত্রæ মনে করে। তাকে ফাঁসানোর জন্যই অনিমেষকে খুন করা হতে পারে। এমনটাই ভাবতে শুরু করেন এলাকাবাসী।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আদালতে মাওলানা হাসানের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ। পুলিশের এই তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনিমেষের নতুন বাড়ির পাশের একটি ওয়াকফকৃত জমিতে মাওলানা হাসান একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাদরাসার সীমানা ও অনিমেষের বাড়ি পাশাপাশি। মাদরাসার পাশেই একটা হিন্দু বাড়ি নাকি মাওলানা হাসান মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি নাকি অনিমেষকে প্রস্তাব দিয়েছেন বাড়িটি মাদরাসার কাছে বিক্রি করে দেয়ার জন্য নতুবা সপরিবারের মুসলমান হওয়ার জন্য। অনিমেষ রাজি না হওয়ায় মাওলানা হাসানই তাকে খুন করিয়েছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এলাকার কোনো মানুষই এ তদন্ত প্রতিবেদনটিকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করে না। তারপরও এলাকাবাসীর কিছু করার থাকে না। নাম করা আইনজীবীরাও আদালত থেকে মাওলানা হাসানের জামিন নিতে ব্যর্থ হন। উল্টো দিনের পর দিন রিমান্ডে রেখে মাওলানা হাসানের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।

দীনেশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দীনেশ ও তার পরিবারের কোনো সদস্যই মাওলানা হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেনি। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনও তারা বিশ্বাস করে না। অথচ এ ব্যাপারে তাদের কারোই কিছু করার নেই। মাওলানা হাসানকে যেদিন গ্রেফতার করা হয় সেদিন থেকেই দীনেশদের বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসানো হয়। পুলিশের ভয়ে কেউ সে বাড়ির আশেপাশেও যেতে পারে না। মাওলানা হাসানের সহযোগী হিসেবে এলাকার আরও কয়েকজনের পাশাপাশি আবির ও আসলকে খুঁজতে থাকে পুলিশ। তারাও গা ঢাকা দেয়। একা একা বাড়িতে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজই খুঁজে পায় না দীনেশ।
কয়েকদিন এভাবে কাটানোর পর একদিন গভীর রাতে দীনেশ বাড়ি থেকে গোপনে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কাউকে কিছু না বলে রাতের অন্ধকারে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায় দীনেশ। দুরু দুরু বুকে কারো ক্ষেত, কারো বাড়ির উঠান, জলাশয়, নর্দমা পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠে হাঁফ ছাড়ে দীনেশ। এখন কোথায় যাওয়া যায়? হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে মাওলানা হাসানের স্ত্রীর কথা। চাচীর সাথে দেখা করা দরকার। হাসান চাচার বিরুদ্ধে যে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, এটা আগে তাকে জানানো দরকার। তারপর আবির ও আসলের সাথে দেখা করে যা হোক কিছু একটা করা যাবে। কিন্তু এত রাতে ও বাড়িতে যাওয়া কতটা নিরাপদ? সেখানেও পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে কিনা কে জানে। তারপরও দুরু দুরু বুকে মাওলানা হাসানের বাড়ির দিকে রওনা করে দীনেশ। অনেক পথ ঘুরে যেতে হবে তাকে। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বের হওয়ার কারণে অনেক দূরে এসে পড়েছে দীনেশ। এখন অনেক পথ ঘুরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। মনে মনে সাহস সঞ্চার করার চেষ্টা করে সে, কিন্তু বুকটা তার দুরু দুরু করে কাঁপতেই থাকে।

প্রায় আধ ঘণ্টা পর মাওলানা হাসানের বাড়ির অদূরে এসে থামে দীনেশ। বোঝার চেষ্টা করে এখানে কেউ আছে কিনা। এক পর্যায়ে সে নিশ্চিত হয়—না, এখানে কোনো পুলিশ পাহারা নেই। দুরু দুরু বুকে মাওলানা হাসানের ঘরের দরজায় টোকা দেয় দীনেশ।
—চাচীমা, জেগে আছেন?
জেগেই ছিলেন মাওলানা হাসানের স্ত্রী। একটি ছোট্ট ল্যাম্প জ্বালিয়ে জায়নামাজে বসে কুরআন তেলওয়াত করছিলেন। কিছুটা শঙ্কিত কণ্ঠে তিনি জবাব দেন—কে?
—আমি দীনেশ চাচীমা, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। দরজাটা একটু খুলুন।
—এত রাতে! দীনেশ, তুমি কি একা, না সঙ্গে কেউ আছে?
—কেউ নেই চাচীমা, আমি একা একা পালিয়ে এসেছি।
মাওলানা হাসানের স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাব-গতিক বোঝার চেষ্টা করেন। কুরআন শরিফটি বন্ধ করে তিনি জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়ান। তারপর কিছুটা নিশ্চিত হয়ে দরজা খুলে দেখেন, দীনেশ একাই এসেছে।
—কিভাবে এলে দীনেশ, তোমাদের বাড়িতে না পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে?
—আমি বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছি চাচীমা।
—ওরা টের পায়নি?
মাওলানা হাসানের স্ত্রী হাতের চার্জার ল্যাম্পটি উঁচু করে দীনেশকে দেখেন আপাদমস্তক। দীনেশের প্যান্ট প্রায় হাঁটু পর্যন্ত গুটানো। পায়ে কাদাময়লা মাখা। তিনি স্নেহের সুরে বলেন—দীনেশ, এতটা রিস্ক নেয়া তোমার ঠিক হয়নি। তুমি দিনের বেলা পুলিশের অনুমতি নিয়েই বের হতে পারতে।
—পারতাম না চাচীমা, ওরা আমাকে কোথাও বের হতে দিচ্ছে না। বাবাকে হারিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে আমাদেরও পালিয়ে যেতে হবে।
—না দীনেশ, এতটা হতাশ হয়ো না। হাত-পা ধুয়ে তুমি ঘরে এসে বস।
—না চাচীমা, আমি এখন ঘরে আসব না। আবির আর আসলের সাথে আমার দেখা করা দরকার। আমি শুধু আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি। আমি এখনই চলে যাবো।
—আবির আর আসলকে তুমি কোথায় পাবে দীনেশ? গ্রামের আরও অনেকের মতো ওরাও পুলিশের ভয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে। শুধু তোমার চাচা না, আরও অনেকে মিলেই নাকি তোমার বাপকে খুন করেছে।
মাওলানা হাসানের স্ত্রীর কণ্ঠ থেকে শেষ শব্দটি মিলিয়ে যেতে না যেতেই চাপা কণ্ঠে প্রায় চিৎকার করে ওঠে দীনেশ।
—আমি বিশ্বাস করি না চাচীমা, এটা বড় ধরনের একটা ষড়যন্ত্র। হাসান চাচাকে ফাঁসানোর জন্যই আমার বাবাকে খুন করা হয়েছে। আমার বাবা তো অনেক দিন ধরেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সপরিবারে মুসলমান হতে চেয়েছেন। এসব কথা তো আমি, আমার মা আর দাদিমা ভালো করেই জানি। আমরা তো সবাই মুসলমান হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন পুলিশ বলছে উল্টো কথা। আমাদের বলছে হাসান চাচার বিরুদ্ধে সাক্ষি দেয়ার জন্য। আমরা মামলাও করিনি, সাক্ষিও দেবো না। সাক্ষি দিতে হলে হাসান চাচার পক্ষেই দেবো, বিপক্ষে নয় ।
একটানা কথা বলে থামল দীনেশ। তার ভেতরের উত্তেজনা টের পেলেন মাওলানা হাসানের স্ত্রী। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে শুনলেন দীনেশের কথা।
—আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। তুমি সত্যি বলছো দীনেশ? তোমার চাচা তো কোনোদিন এসব কথা আমাকে বলেননি।
—সত্যি বলছি চাচীমা। আমরা এখনও মুসলমান হতে চাই। অনেক আগে থেকে আমার বাবা আমাদের সবাইকে প্রস্তুত করেছেন মুসলমান হওয়ার জন্য। কিন্তু চাচা আমাদের আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে বলেছেন। গোটা একটা পরিবার মুসলমান হয়ে গেলে বিষয়টা নিয়ে নাকি দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় অপপ্রচার হতে পারে। জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে—এ ধরনের কথা উঠতে পারে। এ জন্য তিনি বলেছেন, আরও ভালো করে ইসলাম বোঝার জন্য, যেন কোনো বিবাদ-বাধা এলেও আমরা শান্তভাবে মোকাবেলা করে ইসলামের ওপর থাকতে পারি।
—তোমার চাচা সত্যি কথাই বলেছেন দীনেশ। কিন্তু এত বড় অঘটন ঘটবে কে জানতো?
—চাচীমা, আমি শুধু এ কথা জানানোর জন্যই এসেছি। এখন আমি যাই।
—তুমি এখন কোথায় যেতে চাও দীনেশ? আবির ও আসলকে তো তুমি এখন খুঁজে পাবে না।
—ওদেরকে না পাওয়া পর্যন্ত আমার আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই চাচীমা। পুলিশ প্রতিদিন আমাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। বাড়িতে এভাবে বসে থাকতে আমার আর ভালো লাগছে না। আপনি দোয়া করুন, আমি ওদেরকে খুঁজে বের করব।
—এভাবে তুমি ওদেরকে খুঁজে পাবে না দীনেশ। তোমার কাছে কি টাকা-পয়সা কিছু আছে?
—না চাচীমা, আমার কাছে কিছুই নাই। আমি…।
দীনেশের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাওলানা হাসানের স্ত্রী বললেন—তুমি একটু দাঁড়াও বাবা। আমি একটা ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। তুমি আগে ওখানে যাও। তারপর আবির ও আসলকে খোঁজা যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মাওলানা হাসানের স্ত্রী এক টুকরো কাগজে একটি ঠিকানা লিখে দীনেশের হাতে দিলেন। সঙ্গে কিছু নগদ টাকা। টাকাটা হাতে নিতে দীনেশ ইতস্তত করছিল। মাওলানা হাসানের স্ত্রী বললেন—এই ঠিকানায় পৌঁছাতে হলে তোমার টাকা লাগবে। এখন এটা নাও। ভোর হওয়ার আগেই তোমাকে গ্রাম ছাড়তে হবে। সাবধানে যেও।
দীনেশ আর একটি কথাও না বলে ঠিকানা লেখা কাগজের টুকরো আর টাকাগুলো হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
মাওলানা হাসানের স্ত্রী চার্জার ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। হঠাৎ তার চোখে পানি এসে যায়। ওড়নার একটি প্রান্ত হাতে তুলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তিনি দরজা বন্ধ করেন।

ছয়.
এক নামে তাকে সবাই চেনে খুনি মাজেদ। এই অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে মায়েরা খুনি মাজেদের ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ান। হঠাৎ করেই পাগল হয়ে গেল সেই খুনি মাজেদ। ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে খুনি মাজেদের স্ত্রীর কাছে। এক রাতে মাজেদ খুব বিধ্বস্ত হয়ে ঘরে ফেরে। স্বামীর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মাজেদের স্ত্রী চমকে ওঠে। স্বামীকে সে খুব ভয় পায়। কখন কী করে বসে ঠিক নেই। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে মাজেদের মেজাজ-মর্জি। সারাদিন থাকে নেশার ঘোরে। রাতে বেরিয়ে যায় কাজে। স্বামী যে খুন-খারাবি করে বেড়ায় সে খবর স্ত্রী হিসেবে তার অজানা নয়। কিন্তু লাখো মানুষের আতঙ্ক খুনি মাজেদের আজ এ কী অবস্থা! খুনি মাজেদ যেন আজ অন্য কেউ হয়ে গেছে। প্রতিদিনের মতো ঠাট দেখিয়ে স্ত্রীর সাথে সে কোনো কথা বলল না। বড় ঠান্ডা চোখে স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে সে মুখে বিড়বিড় করতে করতে ঘরে ঢুকে সটান শুয়ে পড়ল খাটিয়ায়। শুয়ে শুয়েও বিড় বিড় করতে লাগল মাজেদ। অনেক চেষ্টা করেও স্ত্রী বুঝতে পারল না, খুনি মাজেদ বিড়বিড় করে কী বলছে। সারারাত ঘুমায়নি মাজেদ। ঘুমায়নি তার স্ত্রীও। খাটের এক পাশে একটি চেয়ার পেতে স্বামীর কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় বসে ছিল মাজেদের স্ত্রী। কিন্তু সারারাত মাজেদের কাছ থেকে কোনো সাড়া আসেনি। খুব ভোরে, ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই মাজেদ চিৎকার করে বিছানায় উঠে বসে। চতুর্দিক থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনিতে তলিয়ে যায় মাজেদের চিৎকার। থমকে যায় খুনি মাজেদ। আজানের মধ্যে যেন সে হারিয়ে যায়। আজান শেষ হতে না হতেই লাফিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ে মাজেদ। তারপর দৌড়াতে থাকে রাস্তার দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করে বলে—খুনি মাজেদ, আমি খুনি মাজেদ। এবার আমি আমারেই খুন কইরা ফালামু। আমি সব ফাঁস কইরা দিমু। এবার আমি আমারেই খুন কইরা ফালামু। অনিমেষরে আমিই খুন করেছি। এবার আমি আমারেই খুন কইরা ফালামু।
খুনি মাজেদ দৌড়াতে থাকে আর এসব কথা বলতে থাকে। ‘এবার আমি আমারেই খুন কইরা ফালামু’ কথাটি সে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে বলে। পাড়ার লোকজন, যারা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে এবং যারা এখনও উঠি উঠি করছিল, তারা সবাই মাজেদের চিৎকারে ছুটে আসে। মাজেদ একেকবার একেক দিকে ছুটতে থাকে আর নানান কথা বলতে থাকে। মুহূর্তে মাজেদের পাগলামির কথা এপাড়া থেকে ওপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মানুষই মাজেদকে ভয় পায়। মাজেদের দু’চারজন ঘনিষ্ঠ মানুষ তাকে এ পাগলামি থেকে বিরত রাখতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে—খুনি মাজেদ পাগল হয়ে গেছে। খুনি মাজেদের পাগল হয়ে যাওয়ার চেয়েও বেশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে অনিমেষের খুনের কাহিনী। মাজেদের মুখ থেকেই ছড়িয়ে পড়ে এসব কথা।

অত্র অঞ্চলের মাদক ব্যবসায়ী চক্রের গুরু স্বপন সাধু মাজেদকে ভাড়া খাটিয়ে অনিমেষকে খুন করিয়েছে। স্বপন সাধু সুকৌশলে মাওলানা হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য অনিমেষের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল অনিমেষ। সে বিস্মিত হয়ে বলেছিল, হাসান ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করব আমি? জমি দখলের অভিযোগে? মাদরাসার জন্য সে আমার এক ইঞ্চি জমিও দখল করেনি। তাহলে কেন আমি মিছামিছি মামলা করতে যাবো?
অনিমেষকে প্রথমে লোভ দেখানো হয়। মাওলানা হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করলে অনিমেষ আরও অনেক জায়গা পাবে। অনিমেষের সরলতার সুযোগে এবং মাওলানা হাসানের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে অনিমেষের অনেকখানি জমি মাদরাসার নামে দখল করে নিয়েছে মাওলানা হাসান—এ কথা অনিমেষকে বোঝানো হয়। অনিমেষকে আরও বোঝানো হয়, মাদরাসার নামে সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের জায়গা দখল হয়েছে বলে মামলা করলে অনিমেষ প্রশাসনের কাছে সুযোগ-সুবিধা পাবে। সে ক্ষেত্রে মাদরাসার পুরো জমিটাই অনিমেষ পেয়ে যেতে পারে। ওয়াকফকৃত এ জমিটি এককালে অনিমেষের পূর্বপুরুষদের ছিল। যিনি ওয়াকফ করেছেন তিনি অনেক আগেই এ জমি অনিমেষের পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে কিনে নিয়েছেন। এ তথ্য অনিমেষের খুনিরা জানতো। কিন্তু অনিমেষকে তারা কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারেনি। তাকে অনেক অর্থবিত্তের মালিক বানানোরও লোভ দেখিয়েছে তারা। কিন্তু টলেনি অনিমেষ। শেষ পর্যন্ত লোভের অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে তারা হাতে তুলে নিল ভয়ের অস্ত্র। অনিমেষকে ভয় দেখাল তারা। মাওলানা হাসানের বিরুদ্ধে মামলা না করলে মেরে ফেলারও হুমকি দিল তারা। মাওলানা হাসান বা কারো কাছে এসব কথা প্রকাশ করলে তার দুই সন্তানকে চিরতরে হারাতে হবে বলেও হুমকি দিল তারা। অনিমেষ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিল যে, ব্যাপারটি সে কাউকে জানাবে না। কিন্তু মাওলানা হাসানের বিরুদ্ধে সে কোনোভাবেই মামলা করবে না। স্বপন সাধু অনিমেষকে আর সুযোগ দিতে চাইলো না। অনিমেষকে বিশ্বাস করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে সে মনে করল না। সুতরাং সিদ্ধান্ত হলো অনিমেষকে দিয়ে যেহেতু কাজ হয়নি অতএব ওকে আর বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না। সে মোতাবেক ভাড়া করা হয় খুনি মাজেদকে। মাজেদ তার পরিকল্পনা মোতাবেক অনিমেষের চোখ-মুখ, হাত-পা বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে যায়। যেখানে মাজেদ অনিমেষকে হত্যা করে, সেখানে নিয়ে প্রথমে অনিমেষের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয় মাজেদ। তারপর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উপর্যুপরি গুলি করে অনিমেষের বুকে। কাটা বৃক্ষের মতো ঢলে পড়ে যায় অনিমেষ। গোঙাতে গোঙাতে অনিমেষ বলতে থাকে, আমি মুসলমান হয়ে গেছি এ কথাটা সবাইকে জানায়া দিও। এ কথা বলেই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ উচ্চারণ করতে করতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে অনিমেষ।
অনিমেষ খুনের এ কাহিনী খুনি মাজেদই চিৎকার করে করে লোকদের জানিয়ে দেয়। স্বপন সাধুর নামও জানিয়ে দেয় খুনি মাজেদই। স্বপন সাধু মাদকের সাম্রাজ্য পরিচালনা করে। তার মাদক সাম্রাজ্য পরিচালনায় বিরাট এক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন মাওলানা হাসান। মদ-গাঁজা-ইয়াবা-ফেনসিডিলের প্লাবন বয়ে যাচ্ছে এলাকায়। একটা নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে প্লাবন। দেখতে না দেখতে অনেক তরতাজা তরুণ সব ঝুঁকে পড়েছে নেশার দিকে।
মাওলানা হাসান এর বিরুদ্ধে শুরু করেছেন সামাজিক প্রতিরোধ। নানামুখী প্রচেষ্টার ফলে অন্তত এ অঞ্চলে এসব নেশাদ্রব্যের প্রবাহ অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। কিছু সংখ্যক তরুণ মাওলানা হাসানের প্রচেষ্টায় নেশার জগৎ থেকে ফিরে এসে নেশার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নেয়ায় স্বপন সাধুর ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। যেসব তরুণ একসময় স্বপন সাধুর আস্তানা থেকে মদ-গাঁজা-ইয়াবা-ফেনসিডিল কিনে এনে নিজেরা খেত এবং বিক্রি করতো ওরা যদি এখন এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এটা তার মতো কোনো লোকের কিভাবে সহ্য হবে? এসবের জন্য মাওলানা হাসানকেই দায়ী করে স্বপন সাধু। পুলিশ প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের নিয়মিত বখরা দিয়ে স্বপন সাধু তার মাদক সাম্রাজ্য পরিচালনা করে। মাওলানা হাসানের তৎপরতার কারণেই পাশাপাশি কয়েকটি গ্রাম থেকে সাধু তার মাদক সাম্রাজ্য গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এসব এলাকায় সে আবারও ব্যবসায়িক আস্তানা গাড়তে চায়। এ পথে মাওলানা হাসানই তার জন্য বড় বাধা। সুতরাং যে কোনোভাবে তাকে ফাঁসাতে পারলে এসব গ্রামে আবারও সাধুর ব্যবসায়িক আস্তানা খোলা সহজ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক উচ্চমহলেরও ইন্ধন আছে। কেননা, কয়েকটি গ্রামে মাদক ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারাও বখরা পাচ্ছে কম। অতএব স্বপন সাধু তার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে দেরি করে না। মাওলানা হাসানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকায় স্বপন সাধু তাকে ভিন্নভাবে ফাঁসানোর আয়োজন করে।
এরই মধ্যে সব গোলমাল পাকিয়ে ফেলে খুনি মাজেদ। ‘শালা পাগল হওয়ার আর সময় পেল না’ বলে বাতাসে থু থু নিক্ষেপ করে স্বপন সাধু।

পাগল হওয়ার তিনদিনের মাথায় র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় খুনি মাজেদ। তার পাগলামি ক্রমাগত বাড়ছিল। হয় কোথাও বসে বসে সে বিড়বিড় করত, না হয় হাতের কাছে যা পেত তাই নিয়ে ছুটতো আর চিৎকার করে বর্ণনা করতো অনিমেষ হত্যার কাহিনী। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরও সে পাগলামি করতে থাকে। র‌্যাবের সঙ্গে ধস্তাধস্তির কারণে শক্ত করে হাত-পা বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় খুনি মাজেদকে। মহা কৃতিত্বের পরিচয় দেয় র‌্যাব। ফলাও করে প্রচার করা হয় তাদের এ কৃতিত্বের কাহিনী। ভয়ঙ্কর খুনি মাজেদ ধরা পড়েছে র‌্যাবের হাতে। কিন্তু কোনো গণমাধ্যমেই উঠে আসে না অনিমেষ হত্যার কাহিনী—যে কাহিনী খুনি মাজেদ পাগল হওয়া কিংবা গ্রেফতার হওয়ার চেয়েও বেশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে গ্রামগুলোতে। পাগলের কথা আমলযোগ্য নয়, এই বিবেচনায় দু-একটি কাগজ ছাড়া কেউই অনিমেষ খুনের ব্যাপারে খুনি মাজেদের স্বীকারোক্তি প্রকাশ করে না। অথচ খুনি মাজেদ যে পাগল হয়ে গেছে সে কথাও তারা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে না।
দু’দিন পর দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জানা যায়, র‌্যাবের ক্রসফায়ারে মারা গেছে খুনি মাজেদ। অস্ত্র উদ্ধার করতে গেলে র‌্যাবের সঙ্গে তার সহযোগীদের বন্দুকযুদ্ধে কেবলমাত্র খুনি মাজেদই প্রাণে মারা পড়ে। তার সহযোগীরা সকলেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।


সাত.
মাওলানা হাসানের স্ত্রীর দেয়া ঠিকানাটি হাতে নিয়ে যাত্রা করার পর হঠাৎ দীনেশের মনে হলো সে বড় হয়ে গেছে। সে এখন আর নগণ্য কোনো কিশোর নয়। একটা সংসারের দায়িত্ব এখন তার ওপর। তাকে এখন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। যেভাবেই হোক আবির আর আসলকে খুঁজে বের করতে হবে। মাওলানা হাসান যখন কারাগারে তখন আবির আর আসলের চাইতে বড় কোনো শুভাকাক্সক্ষী নেই দীনেশের। অন্তত তার জানা মতে আর কেউ তাকে এতটা দরদ দিয়ে সাহায্য করবে না। নতুন সাহস বুকে নিয়ে অন্ধকার পথের ওপর সতর্ক নজর ফেলে এগিয়ে যায় দীনেশ। ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পর পরই সে পৌঁছায় থানা শহরের বাসস্ট্যান্ডে। এখান থেকে তাকে যেতে হবে জেলা সদরে।
বাসের অপেক্ষায় বসে থেকে দীনেশ তার কর্মপরিকল্পনা গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। মাওলানা হাসানের স্ত্রীর দেয়া ঠিকানার লোকটাকে খুঁজে পেলে আবির আর আসলকে খুঁজে পাওয়া যাবে। তারপর তার প্রথম কাজটি হবে তার আর পরিবারের অন্যদের ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হওয়ার ব্যাপারটা। তার বাবা অনিমেষের শেষ ইচ্ছাটা পূরণই শুধু নয়, বরং মুসলমান হয়ে নিজের জীবনকে সার্থক করাই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দীনেশের ভাবনার জগতে বিষয়টি এভাবেই ধরা পড়ে। তারপর দীনেশ তার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবে। এখন সংসার চালাতে হবে তাকেই। বয়স নয়, বাস্তবতাই মুখ্য। মা, ঠাকুরমা আর ছোট বোনটার জন্য তাকেই করতে হবে অন্নসংস্থান। মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে তো আর বেশি দিন চলা যাবে না। কিছু একটা তাকে করতে হবে। তার বয়সী অনেক ছেলেই আয়-রোজগার করে সংসার চালায়। সুতরাং তাকেও তাই করতে হবে। জেলা সদরেই কোনো একটা কাজ জোগাড় করার চেষ্টা করতে হবে। ঠিকানার লোকটা এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন হয়তো। লেখাপড়া চালিয়ে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না বলে স্থির করে দীনেশ। কিছু একটা কাজের জোগাড় তাকে করতেই হবে।
বাস হেলপারের ডাক শুনে চিন্তার জগৎ থেকে ফিরে আসে দীনেশ। তড়িঘড়ি করে বাসে ওঠে সে। বাস ছেড়ে দেয় জেলা সদরের উদ্দেশে। সকালবেলার প্রথম ট্রিপ হওয়ায় বাসে কোনো ভিড় নেই। কয়েকজন মাত্র যাত্রী এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। দীনেশ বাসের নির্জন কোণে একটি ডাবল সিট একাই দখল করে বসে পড়ে। চলতি বাসের মধ্যে দীনেশ আবারও ভাবনার জগতে ঢুকে পড়ে। বাসটি জেলা সদরে পৌঁছতে সময় লেগে যায় ঘণ্টা খানেক। বাস থেকে নেমেই দীনেশ এক দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে ঠিকানাটির লোকেশন জেনে নেয়। ঠিকানার সঙ্গে একটি মোবাইল নাম্বার থাকলেও দীনেশ মোবাইলে ফোন করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তার হাতে কোনো মোবাইল নেই। ইচ্ছ করলেই দু’টাকা দিয়ে যে কোনো মোবাইল ফোনের দোকান থেকে ফোন করা যায়। কিন্তু ফোন না করে দীনেশ সরাসরি ওই ঠিকানার উদ্দেশে যাত্রা করে। বাসস্ট্যান্ড থেকে খুব বেশি দূর যেতে হয় না দীনেশকে। খুব সহজেই সে ওই ঠিকানায় পৌঁছে যায়। দরজার পাল্লায় আস্তে আস্তে টোকা দেয় দীনেশ। কয়েকবার টোকা দেয়ার পর দরজা খুলে যায়। মধ্য বয়সী ক্লিনশেভ করা এক ভদ্রলোক দরজা খুলে দীনেশের দিকে তাকান। ভদ্রলোকের পরনে অফিসের পোশাক। মনে হচ্ছে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে কারো অপেক্ষায় বসে ছিলেন। দীনেশ আস্তে করে সালাম দিয়ে ঠিকানা লেখা কাগজটি এগিয়ে দেয় ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক কাগজটি হাতে নিতে নিতেই বলে ওঠেন—তুমিই দীনেশ? তারপর নজর বুলান কাগজটির দিকে।
দীনেশ আস্তে করে জবাব দেয়—জি, আমিই দীনেশ। আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন…।
দীনেশ কথা শেষ করতে পারে না। হাত তুলে থামিয়ে দেন ভদ্রলোক। আমি সবই জানি। তুমি ভেতরে এসো। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। অফিসে যাওয়ার আগে আমাকে কয়েক জায়গায় যেতে হবে। তুমি থাকবে আমার সাথে। এসো, একসঙ্গে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ি। একটানা কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক ঘরের ভেতরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। দীনেশ কাদামাখা পা নিয়ে ঘরে ঢুকতে ইতস্তত করছিল। ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে দীনেশের ইতস্ততভাব লক্ষ্য করে বললেন, ঢুকে পড়। ঢুকে পড়। বাম দিকে ইশারা করে বললেন, ওদিকে ওয়াশরুম আছে। তুমি ভালো করে মুখ-হাত ধুয়ে এসো। তাড়াহুড়ার দরকার নেই। আমি অপেক্ষা করছি।
সারারাতের নির্ঘুম, ক্লান্ত-শ্রান্ত দীনেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে পরিষ্কার হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। ভদ্রলোক একটি টাওয়াল হাতে দাঁড়িয়েছিলেন। ওটা দীনেশের দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসেন। দীনেশ ভদ্রলোকের সহজিয়া আচরণে নিজেও সহজ হয়ে ওঠে। হাত-মুখ মুছতে মুছতে সেও বসে পড়ে নাস্তার টেবিলে। ক্ষুধার্ত দীনেশের কাছে নাস্তার এই আন্তরিকতাপূর্ণ আয়োজন খুবই ভালো লাগে। সহজ স্বচ্ছন্দে সে পেটপুরে নাস্তা করে। খাবার টেবিলে তেমন কোনো কথাই হয় না দু’জনের মধ্যে। নাস্তা শেষে দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ভদ্রলোক।
এই ভদ্রলোক হচ্ছেন জেলা শহরের নামকরা উকিল অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান। তিনি মাওলানা হাসানের আপন মামাতো ভাই। মাওলানা হাসানের পক্ষে তিনি সহযোগী উকিলদের নিয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ফজরের পরপরই দীনেশের ব্যাপারে অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানকে সব কথা মোবাইল ফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন মাওলানা হাসানের স্ত্রী। সব কথা জানতে পেরে অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান নিজেও বিস্মিত হয়েছেন। আজই মাওলানা হাসানের সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করে সব কথা জানিয়ে দেবেন বলে মাওলানা হাসানের স্ত্রীকে জানান অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান।
এদিকে যে রাতে দীনেশ বাড়ি থেকে গোপনে বেরিয়ে যায় সে রাতেই খুনি মাজেদ পাগল হয়ে যায়। পরদিন সকালে খুনি মাজেদের পাগলামির কথা এলাকাবাসী জানলেও দীনেশের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি জানতে পারে সন্ধ্যায়। পুলিশের ভয়ে ওই বাড়িতে কারো যাতায়াত না থাকায় ব্যাপারটি সকাল থেকে কেউ জানতে পারেনি। বিকেলের দিকে যখন থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এসে দীনেশের খোঁজে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে, তখনই এলাকাবাসী ব্যাপারটি টের পায়। প্রকৃত ঘটনা মাওলানা হাসানের স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ না জানার কারণে এ নিয়ে গ্রামে নানান কথা ছড়াতে থাকে। কেউ বলে, বাপের মতো ছেলেকেও মনে হয় ওরা গুম করে মেরে ফেলেছে। পুলিশি পাহারা থাকার পরও এই অবিশ্বাস্য ঘটনা কিভাবে ঘটল, এ নিয়ে এলাকায় সৃষ্টি হয় আরেক চাঞ্চল্য। অনেকে আবার মনে করে আবির ও আসলের সহযোগিতায় দীনেশ বাড়ি ছেড়ে কোথাও পালিয়ে গেছে। মাওলানা হাসানের স্ত্রীও কারো কাছে বিষয়টি প্রকাশ করেন না। পুলিশ প্রশাসন থেকে গ্রামের লোকদের হুমকি দেয়া হয়। আবির ও আসলকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার জন্য গ্রামের লোকদের দায়ী করে তারা। মাওলানা হাসানের সহযোগী আবির ও আসলই দীনেশকে গুম করেছে বলে অভিযোগ করে পুলিশ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আবির, আসল আর দীনেশকে খুঁজে বের করে দিতে না পারলে এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করবে তারা। দু’চার-পাঁচ হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করতেও দ্বিধা করবে না তারা। এতে তাদের সুবিধাই হবে। যাকে-তাকে ধরে নিয়ে টাকা আদায় করতে পারবে। টাকা না পেলে সোজা হাজতখানায়।
দীনেশের হারিয়ে যাওয়ার পর গ্রামের লোকেরা আরও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। লাখো মানুষের আতঙ্ক খুনি মাজেদ ক্রসফায়ারে মারা গেলেও তার চেয়ে অনেক বড় আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয় পুলিশ প্রশাসন আর মাদকচক্র। দ্রæতই মাদকের চালান আসতে শুরু করে গ্রামে। সচেতন মহল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আগের মতো আর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। দীনেশের বাড়ি থেকে পুলিশ পাহারা তুলে নেয়া হয়। কিন্তু এলাকায় যখন তখন টহল দিতে শুরু করে পুলিশ। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের দহরম মহরম সম্পর্ক। এলাকার কয়েকজন পুরনো মাদক ব্যবসায়ী আবার তাদের ব্যবসা খুলে বসে। পুলিশ নিয়মিত এসে বখরা নিয়ে যায়। আবির ও আসলসহ কয়েকজন তথাকথিত সহযোগীর বিরুদ্ধে দীনেশকে অপহরণের মামলা করে পুলিশ।
স্বপন সাধুও হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। সেও তার নিজস্ব বাহিনী লাগিয়ে আবির, আসল আর দীনেশকে খুঁজতে থাকে। সহযোগীদের নির্দেশ দিয়ে রাখে সে—ওদের যাকে যেখানে পাওয়া যাবে তাকেই অপহরণ করে নিয়ে যেতে হবে আসল ঠিকানায়।

আট.
দুপুরের মধ্যেই খুনি মাজেদের পাগল হয়ে যাওয়ার ঘটনা জানতে পারে জেলা সদরে অবস্থানরত আবির, আসল ও দীনেশ। অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানই তাদেরকে ঘটনাটি জানায়। শ্রান্ত-ক্লান্ত দীনেশ তখন অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের এক বন্ধুর বাসায় ঘুমিয়ে ছিল। আবির ও আসল সেখানে গিয়ে দীনেশকে ঘুম থেকে জাগিয়ে গোটা ঘটনাটি তার কাছে বর্ণনা করে। সব শুনে দীনেশ গুম হয়ে বসে থাকে। তার মুখ ফুটে কোনো কথাই বের হয় না। আসল ফোঁস করে বলে ওঠে—দীনেশ, স্বপন সাধুকে আমরা ছাড়ব না। ছাড়তে হলে দাদ নিয়েই তবে ছাড়ব।
আসলের এই ফোঁসফোঁসানিতে বিরক্ত হয় আবির—আমরাই যেখানে ঘরছাড়া সেখানে স্বপন সাধুকে ছাড়া না ছাড়ার ব্যাপারটাই অবান্তর। আগে আমাদের সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে। স্বপন সাধুর চক্রান্তের জাল কতদূর পর্যন্ত বিস্তারিত হয়েছে সেটাও তো আমরা জানি না। সুতরাং পরের চিন্তা আগে করিস না আসল, আগের চিন্তা আগে কর।
আসলের মাথায় রক্ত টগবগ করে ফুটে ওঠে আবিরের কথায়—না আবির, আগে আমরা স্বপন সাধুকে খুন করব। তারপর পরের চিন্তা পরে করব।
আসলের কথায় আবিরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে—তুই সুষ্ঠুভাবে কাজ করার পক্ষে না অসুষ্ঠুভাবে? আমরা প্রচলিত আইনের বাইরে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করব না। স্বপন সাধুর মতো ধুরন্ধর মাদক ব্যবসায়ীকে তার নিজের জালেই জড়াতে হবে। পুলিশ প্রশাসনের ভালো কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করতে হবে। তাদের মাধ্যমেই আমরা যা করার করব।
আবিরের কথা শুনে নাক সিটকায় আসল—আরে বাব্বা, পুলিশ প্রশাসনে আবার ভালো! আরে গাধা, ভালো মানুষদের কখনো পুলিশে চাকরি করতে শুনেছিস তুই? সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আমি তো কোনো ভালো মানুষকে পুলিশে চাকরি করতে শুনিনি।
আসলের বক্রোক্তির ঢঙে হেসে ফেলে আবির, হেসে ওঠে দীনেশও। আসলের কথা শুনে হাসলেও জবাব দিতে ছাড়ে না আবির—শোন আসল, তোরে আমি তথ্য-প্রমাণসহ বলে দিতে পারব পুলিশের সততার কারণে কত কত ভালো কাজ হয়েছে। সুতরাং এ বিষয় নিয়ে প্যাঁচাল না করে তুই চুপ যা। ফজলু আংকেল যেভাবে বলে এখন আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হবে। বোকামি করা যাবে না।
অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানই ওদের ফজলু আংকেল।
বিকেলে ফজলু আংকেলের সাথে বসে আবির, আসল আর দীনেশ যখন কর্মপরিকল্পনা করছিল ঠিক সে সময়ই ফজলু আংকেলের মোবাইল ফোনে সংবাদ আসে—দীনেশকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। সংবাদটি সবাইকে জানিয়ে ফজলু আংকেল বলেন—শুধু দীনেশ নয়, তোমরাও এখন মারাত্মক রিস্কের মধ্যে আছো। স্বপন সাধুও তোমাদের পেছনে লোক লাগিয়ে দিতে পারে। সুতরাং আমি ভাবছি তোমাদের তিনজনকেই ঢাকায় পাঠিয়ে দেবো। এই শহরের আদালতকে মনে হয় না ন্যায়ের পক্ষে থাকতে দেয়া হবে। কায়েমি স্বার্থবাদীরা সবকিছু উল্টে-পাল্টে দেবে। সুতরাং আমাদের সব ব্যবস্থা করতে হবে ঢাকায় গিয়ে। তোমরা যদি রাজি থাক, তাহলে দু-একদিনের মধ্যেই আমি সে ব্যবস্থা করব। আবির, আসল ও দীনেশ বিকল্প কোনো পথ নেই দেখে ফজলু আংকেলের প্রস্তাবই সমর্থন করে একবাক্যে।
জেলা শহরে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আরও তিনদিন কেটে যায় ওদের। এই তিনদিনের মধ্যে কোনো না কোনো কৌশলে দীনেশের মা, ঠাকুরমা আর ছোট বোনকে জেলা সদরে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পুলিশ ও সাধু বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে এ কাজ করা সম্ভব হয় না। দীনেশদের বাড়ির ওপরে গোপনে গোপনে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি করা হয়। আবির, আসল ও দীনেশ এত কিছুর পরও রিস্ক নিতে চেয়েছে। কিন্তু সবার নিরাপত্তা একযোগে বিঘিœত হওয়ার ভয়ে অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান ওদেরকে এই রিস্ক নেয়া থেকে নিরস্ত করেন। প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি সেরে অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান আবির, আসল আর দীনেশকে নিয়ে রাতের গাড়িতে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা করেন। উচ্চ আদালতের বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে গোটা ব্যাপারটা নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা করেছেন তিনি। সে মোতাবেকই আবির, আসল ও দীনেশের সঙ্গে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন। ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার পূর্বমুহূর্তে জেলা সদরের বড় মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে কালেমা পাঠ করে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমান হয়েছে দীনেশ। এশার নামাজের জামাত শেষ হওয়ার অনেকক্ষণ পরে মসজিদে বসেই দীনেশকে কালেমা পাঠ করান ইমাম সাহেব। অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, আবির ও আসল কেউই তখন পর্যন্ত এশার সালাত আদায় করেনি। দীনেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হওয়ার পর অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের ইমামতিতে সানি জামাতে নও মুসলিম দীন মুহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে এশার সালাত আদায় করে আবির ও আসল। ওদের এশার সালাত শেষ হলে ইমাম সাহেবের ইমামতিতে সকলে মিলে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় শেষে দীনেশের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করা হয়। সালাত আদায় করে দীনেশ যখন মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসে তখন তার চোখে-মুখে নতুন ঔজ্জ্বল্য। প্রশান্তিতে ভরপুর হয়ে ওঠে দীনেশের হৃদয়টা। মনে হয় কোনো শান্ত-স্নিগ্ধ সরোবরের বুকে পরম প্রশান্তিতে ফুটে আছে একটি পদ্মফুল। সেই পদ্মফুলটিই যেন দীনেশের হৃদয়। দীনেশ এক পরম নির্ভরতা লাভ করে নিজের ভেতরে। ইমাম সাহেবের বুকের উষ্ণতা লেগে আছে দীনেশের বুকে। সালাত শেষে সবাই কোলাকুলি করেছে দীনেশের সঙ্গে। ইমাম সাহেব অনেকক্ষণ দীনেশকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। একটি স্মার্টফোনে সকল দৃশ্যই ক্যামেরাবন্দী করেছে আসল। ইমাম সাহেব বেশ কিছু উপদেশ দিয়েছেন দীনেশকে। সবগুলো উপদেশই দীনেশের ভালো লেগেছে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের এক বন্ধুর বাসায় রাতের খাবার খেয়েছে সবাই। সেখানেও অভিভূত হয়েছে দীনেশ। মানুষ মানুষকে এতটা আপন করে নিতে পারে রক্তের বন্ধন কিংবা আত্মীয়তার কোনো বন্ধন ছাড়াই, এতটা আগে কখনোই বুঝতে পারেনি দীনেশ। ইমাম সাহেব তার নামটি পরিবর্তন না করে নামের আগে দু’টি শব্দ জুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখন থেকে তুমি দীন মুহম্মদ দীনেশ। এতেও দীনেশ অভিভূত হয়েছে। তার নামের দীনেশ শব্দটি যদি সম্পূর্ণ বাদও দিয়ে দিতেন ইমাম সাহেব তাহলেও দীনেশ কিছু মনে করত না। বরং তার নাম পুরো পরিবর্তন করে ফেলার মানসিক প্রস্তুতি ছিল তার। দীনেশ নামটি তার নামের সাথে থেকে যাবে এমনটা সে কখনও ভাবেনি। মহাসত্যের সন্ধান পেয়ে মনে মনে সে বারবার আল্লাহ তায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
রাতে গাড়িতে ওঠার আগেই অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান মাওলানা হাসানের স্ত্রীকে ফোনে সব ঘটনা জানিয়ে দেন। রাতের গাড়িতে ঢাকা যাত্রার কথাও জানান তিনি। নিজের স্ত্রীকেও ফোন করে তিনি সব জানিয়ে দেন। বিশ্বস্ত বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষী মহলকে তিনি সবিস্তারে সব জানান। কিন্তু অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান আঁচই করতে পারেননি যে, তিনি তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মস্তবড় এক বিপদে পড়তে যাচ্ছেন। তাদের নাইটকোচটি নিয়ম মোতাবেক চা বিরতির জন্য একটি হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে থামে। অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান আবির, আসল আর দীনেশকে নিয়ে চা খাওয়া এবং আড়মোড়া ভাঙার জন্য অন্যান্য যাত্রীর সাথে নেমে আসেন কোচটি থেকে।
ওরা চারজন বাস থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই চতুর্দিক থেকে একদল অস্ত্রধারী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে জনসম্মুখে ওরা পিছমোড় করে চারজনের হাত বাঁধে, পা বাঁধে, নাক খোলা রেখে ওদের মুখও বেঁধে ফেলা হয়। ওদের চারজনের সবগুলো ব্যাগ, ব্রিফকেস গাড়ি থেকে নামিয়ে দু’টি বড় মাইক্রোবাসে করে ওদেরকে তুলে নিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা। রেস্টুরেন্টের সামনে ভিড় করা নাইটকোচের যাত্রীরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
পরদিন সকালে ওদের খোঁজ না পেয়ে ঢাকা থেকে শুভাকাক্সক্ষীরা ব্যাপক খোঁজাখুঁজি করে জানতে পারে এ ঘটনা। তারপরই এ খবর চলে যায় গ্রামে। আবিরদের গ্রামজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। দীনেশের বাড়িতে আবার ওঠে ক্রন্দনরোল। গ্রামের অসহায় শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর চোখের সামনে আলো নিভে যায়, নেমে আসে অন্ধকার।
তারপর পার হয়ে গেছে একটি বছর, সন্ধান মেলেনি কারো। শীতের এক গভীর রাতে আগুন লেগে গেছে দীনেশদের ছোট ঘরটিতে। সে আগুনে পুড়ে মারা গেছে দীনেশের মা, ঠাকুরমা ও ছোট বোনটি। যাবজ্জীবন কারাদÐ হয়েছে মাওলানা হাসানের। গ্রামে নেশার সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিদায় নিয়েছে নীতি-নৈতিকতা। এখন ঘরে ঘরে নেশাগ্রস্ত তরুণ, জুয়াড়ির দল, সকাল-বিকাল মারপিট ছাড়া তেমন কিছুই না। খুন মাঝে মাঝেই হচ্ছে। ধর্ষণ, অপহরণ নিয়মিত। চাঁদাবাজি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সর্বক্ষণই গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত অশান্তির বাতাস। অনিমেষ, দীনেশ, আবির, আসল আর অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের কথা প্রকাশ্যে কেউ মুখে আনছে না। বিপদের সমূহ সম্ভাবনা দেখে সাধারণ মানুষ মুখে কুলুপ এঁটেছে। তবে কেউ কেউ এখনো আশাবাদী হতে চায়। তারা মনে করে আবির, আসল, দীনেশ—ওরা আবার ফিরে আসবে। মাওলানা হাসান মুক্তি পাবেন। অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানও ফিরে আসবেন। এ বিষাক্ত বাতাস দূর হয়ে যাবে। এটা কি সত্যিই আশা, নাকি আশার মরীচিকা—কেউ বলতে পারে না।

সুখ অদ্ভুত / সাইফ আলি

০১
:কয়টা বাজে?
:কি জানি, তিনটা চারটা বাজবে হয়তো।
:ঘড়িটা দেখনা-
:ওটা দেখার জন্য না, দেখানোর জন্য।
:ও আচ্ছা, তোর এই ব্যপারটা আমার ঠিক মাথায় আসে না।
:কোনটা?
:এইযে, নষ্ট ঘড়ি পরে আছিস, লোকদেখানোর মধ্যে এতো মজা পাস তুই…
:তুই পাস না।
:না।
:মিথ্যা বলিস না, তুইও পাস; অন্যভাবে। রাখ সে কথা, তোর দিনকাল যাচ্ছে কেমন? অফিস কি এখনো তেমন চাপে রাখে।
:আগের চেয়ে বেশি। বেতন দেয়ার খোঁজ নেই, কাজের বেলায় মন ভরে না।
:কি করবি বল, সর্বচ্চ এতটুকু করতে পারিস; ভালো কোনো অফার থাকলে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে যাস।
:দু’মাসের বেতন আটকে রেখেছে। ইচ্ছে করে…

বহুদিন পর ওদের দেখা, চাচাতো ভাই না বলে বন্ধু বলাটাই ভালো হবে। পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছে শাওন। আর সরল এখনো কিছু করে না। লোকে বেকার বলে তবে তাতে ওর কিছু যায় আসে না। বেকার তো আর গালি না। আর জীবনের একটা সময় সবাইকেই এই উপাধিটা নিতে হয়। বিলের এদিকটা শান্ত। লোকজনের বিশেষ যাতায়াত নেই। এটা এখন মৌসুমী বিল। শুধুমাত্র বর্ষাকালেই পানি হয়। বাদবাকি সময় ধান চাষ হয়। এখন ধানের সময়, সবুজ ধানখেতগুলো বাতাসে দুলছে। সেদিকে তাকিয়ে শাওন বললো, মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরি-বাকরি ছেড়ে এখানে চলে আসি। এই খোলামেলা মাঠ, নীল আকাশ, পাখিদের ডাকাডাকি; কে চাই এসব ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমাতে। একটা বিষয় লক্ষ করেছিস, আমরা কেমন হঠাৎ করেই বদলে গেছি। ঘুম থেকে উঠে অফিস আর অফিস থেকে ফিরে কোনোরকমে বিছানায় পিঠ রাখতে পারলে হয়।
:হুমম, তোর ভেতরে কাব্য প্রতিভা জাগ্রত হচ্ছে।
:সেটা আমার থেকে তোর ভেতরে বহুগুণ বেশি। ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?
:না, লেখি মাঝে মাঝে, কিন্তু লেখে কি হবে, কেউ কি ওসব পড়ে?
:না পড়ুক, তুই তোর মতো লেখতে থাক। নিজের জন্য লেখ, সবকিছু অন্যের জন্য করে লাভ কি?
:এ জন্যই তোকে আমার এতো ভালো লাগে। তাহলে এই সুযোগে তোকে একটা কবিতা শুনিয়ে দিই, কি বলিস।
:এটার জন্য তুই কখনো অনুমতির তোয়াক্কা করেছিস বলে তো মনে পড়ে না। বল শুনি-

:আমি এক অদ্ভুত সুখে আছি জানো
সময়ের রঙড়ঙা পরিচয় নেই
ব্যথা আছে, কিন্তু কোনো দুঃখ আমাকে স্পর্শ করে না
স্বপ্ন আছে, কিন্তু কোনো ব্যস্ততা আমাকে তাড়া করছে না
আমি এক অদ্ভুত সুখে আছি বেঁচে!

বৃক্ষকে দেখো অভিযোগ ছাড়া
কি দারুণ আকাশের দিকে উঠে যায়
যেনো তার ওটাই ঠিকানা!

আমি এক অদ্ভুত স্রোতে ভেসে আছি
যেই স্রোত কোনোদিন ভাসায়নি আমাকে
অদ্ভুত নদী, সাগরের দিকে তার গতী নেই!

আমি এক অদ্ভুত সুখে আছি জানো…

:বাহ কথাগুলো দারুণ। অদ্ভুত সুখ তাই না, আসলেই কবিতাটা আমার জন্যেও খাটে। আসলে সবার জন্যেই খাটে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
:তাতে কি, জ্বিন-ভূতের ভয় আছে নাকি।
:তা যে একেবারেই নেই বলবো না। তবে…
:তবে?
:তোর মতো একটা ভূত পাশে থাকতে জ্বীন ভুতের ভয় কোত্থেকে আসবে।
:হা হা হা… ভালো বলেছিস।

০২ (চলবে)

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: