১. ৫. বাইবেলের বাংলা অনুবাদের সমস্যা
সুপ্রিয় পাঠক, নাম সমস্যার চেয়েও কঠিন অনুবাদ সমস্যা। বাইবেলের একই পুস্তকের অনুবাদে বিভিন্ন বাংলা বাইবেলের মধ্যে তথ্যের ব্যাপক ভিন্নতা লক্ষণীয়। ইংরেজি পাঠের সাথে তুলনা করলে অনেক অনুবাদই বিকৃত বা পরিবর্তিত বলে দেখা যায়।
১. ৫. ১. হিব্রু, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা বনাম ইংরেজি ভাষা
বাইবেলের মূল ভাষা হিব্রু ও গ্রিক। এ ভাষাদ্বয়ে রচিত বাইবেল সহজপ্রাপ্য নয় এবং ভাষা দুটোও অত্যন্ত কঠিন। মধ্যযুগে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় গ্রিকভাষা থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত বাইবেলের উপরেই নির্ভর করত। ল্যাটিন ভাষা কারো মাতৃভাষা ছিল না। শুধু ধর্মগুরুরা এ ভাষা চর্চা করতেন। ফলে বাইবেল সম্পর্কে খ্রিষ্টান জনগণ কিছুই জানত না। ধর্মগুরুরা জনগণের ভাষায় বাইবেল অনুবাদের ঘোর বিরোধিতা করতেন। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতকের শেষদিকে প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু ‘John Wycliffe’- জন উইকলিফ (১৩৩০-১৩৮৮) সর্বপ্রথম বাইবেলকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। এ অপরাধে খ্রিষ্টান চার্চের পক্ষ থেকে তাঁকে এবং তাঁর অনূদিত বাইবেলের পাঠকদেরকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার শাস্তি প্রদান করা হয়। উইকলিফের মৃত্যু হওয়ার কারণে চার্চের নির্দেশে তাঁর মৃতদেহ কবর থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়ে ছাইগুলো নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
ক্যাথলিক চার্চ ও পোপ সাধারণের মধ্যে প্রচলিত কোনো ভাষায় বাইবেল অনুবাদের ঘোর বিরোধিতা করলেও খ্রিষ্টীয় ১৬শ শতকে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মমত জোরালো হয় এবং তারা মাতৃভাষায় বাইবেল অনুবাদের পক্ষে ছিলেন। ইংল্যান্ডের প্রটেস্ট্যাস্ট রাজা জেমস ইংরেজিতে বাইবেল অনুবাদের জন্য খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে একটা কমিটি গঠন করেন। তাদের অনূদিত ও সম্পদিত বাইবেলটা ‘কিং জেমস বাইবেল’ বা কিং জেমস ভার্শন নামে প্রসিদ্ধ। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে তা প্রকাশিত হয়।
এটা ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্তমান শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ৪ শত বছর ‘অথোরাইজড ভার্শন’ অর্থাৎ অনুমোদিত, স্বীকৃত বা নির্ভরযোগ্য সংস্করণ বলে গৃহীত। আমেরিকার খ্রিষ্টীয় চার্চ সম্মেলনী (the Division of Christian Education of the National Council of the Churches of Christ in the USA) ১৯৫২-১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিগুলোর উপর নির্ভর করে রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শন (The Revised Standard Version: RSV) প্রকাশ করে। এরপর এ সংস্করণের উপর নির্ভর করে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে নিউ রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শন (the New Revised Standard Version: NRSV) এবং ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ইংলিশ স্টান্ডার্ড ভার্শন (the English Standard Version: ESV) প্রকাশ করা হয়। ইহুদি ও খ্রিষ্টান বাইবেল গবেষকরা এ ভার্শনগুলোকে নির্ভরযোগ্য ও প্রাচীন পাণ্ডুলিপি নির্ভর বলে উল্লেখ করেছেন।
ইংরেজি অনুবাদ কতটুকু মূলাশ্রয়ী আমরা তা জানি না। ইংরেজি অনুবাদ বিষয়ক আপত্তি ও পর্যালোচনা সম্পর্কিত কিছু তথ্যের জন্য পাঠক নিম্নের ওয়েবসাইটটা দেখতে পারেন: http://www.rejectionofpascalswager.net/versions.html। তবে আমরা যেহেতু মূল হিব্রু বা গ্রিক ভাষা জানি না সেহেতু আমরা এ সকল ইংরেজি ভার্শনকেই মূল হিসেবে গণ্য করছি। আমরা দেখব যে, বাইবেলের হাজার হাজার পাণ্ডুলিপির একটার সাথে আরেকটার মিল নেই। বিশেষত নতুন নিয়মের একটা শ্লোকও দুটো পাণ্ডুলিপিতে অবিকল একরকম নয়। প্রতিটা শ্লোকেই পাণ্ডুলিপিগত বৈপরীত্য বিদ্যমান। আমরা আশা করি এ সমস্যার মধ্য থেকেই এ সকল স্বীকৃত ইংরেজি ভার্শনে মূল পাঠ যথাসম্ভব সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
১. ৫. ২. ইংরেজি অনুবাদের সমস্যা
১. ৫. ২. ১. ঈশ্বরগণ বনাম ঈশ্বর
ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদের পরিমার্জন, পরিবর্তন বা কারচুপির একটা নমুনা উল্লেখ করা যায়। পবিত্র বাইবেলের প্রথম বাক্য “In the beginning God created the heaven and the earth”। কেরি: “আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন।” জুবিলী: “আদিতে যখন পরমেশ্বর আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকাজ শুরু করলেন।” বা-২০০০ ও মো.-০৬: “সৃষ্টির শুরুতেই ঈশ্বর/ আল্লাহ মহাকাশ ও পৃথিবী/ আসমান ও জমীন সৃষ্টি করলেন।” (আদিপুস্তক/ পয়দাশে ১/১)
এখানে ইংরেজি ‘গড’ শব্দকে বাংলায় ঈশ্বর, পরমেশ্বর ও আল্লাহ বলা হয়েছে। মূল হিব্রুতে শব্দটা ‘এলোহিম’ (Elohim)। এলোহিম শব্দটা বহুবচন, এর অর্থ ঈশ্বরগণ। এর একবচন: ‘এল’ (ঊষ), যার অর্থ ঈশ্বর। একজনকে বোঝাতে বহুবচনের সর্বনামের ব্যবহার বিভিন্ন ভাষায় দেখা যায়। যেমন রাষ্ট্রপতির ঘোষণায় তিনি বলেন ‘আমরা, প্রেসিডেন্ট…’। অনেক সময় লেখক নিজের বক্তব্য বা মত বুঝাতে ‘আমি’ না বলে ‘আমরা’ বলেন। এভাবে যে কোনো ভাষায় ব্যক্তি নিজেকে বুঝাতে অনেক সময়ই বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহার করে। তবে এক ব্যক্তিকে বুঝাতে নিজ নাম (proper noun) বা সাধারণ বিশেষ্য (common noun)-এর বহুবচন ব্যবহার কোনো ভাষাতেই পাওয়া যায় না। এখানে মূল অনুবাদ হওয়া দরকার ছিল: আদিতে ঈশ্বরগণ, পরমেশ্বরগণ….!
ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করেন। কেউ বলেন, সৃষ্টিকর্তার মর্যাদা বুঝাতে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো কোনো খ্রিষ্টান প্রচারক দাবি করেন, ঈশ্বরের ত্রিত্ব বা ত্রিত্ববাদ বুঝাতে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। বিরুদ্ধবাদীরা দাবি করেন যে, বহুবচন কখনোই ‘তিন’ বুঝায় না; বরং তেত্রিশ কোটিও বুঝাতে পারে। কাজেই বহুবচন দ্বারা তিন দাবি করা একেবারেই ভিত্তিহীন। এছাড়া ‘ত্রিত্ববাদে’ ঈশ্বর বহুজন বা তিনজন নন; বরং একজন। তাঁকে Gods, ঈশ্বরগণ, পরমেশ্বরগণ ইত্যাদি বলা যায় না। ঈশ্বর একাধিক বলে ধারণা করা খ্রিষ্টধর্মে কুফরী বলে গণ্য। কাজেই বাইবেলের এ ব্যবহার দ্বারা ত্রিত্ববাদ প্রমাণ করা যায় না; বরং ত্রিত্ববাদ খণ্ডন করা যায় এবং বহু-ঈশ্বরবাদ প্রমাণ করা যায়। সর্বাবস্থায় এক্ষেত্রে অনুবাদের সঙ্গতিপূর্ণ (Consistent) হবার দাবি ছিল, অনুবাদেও বহুবচন ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ব্যাখা বা টীকা লেখা।
১. ৫. ২. ২. বাইবেলে থেকে Hell (নরক) চিরবিদায় নিচ্ছে!
আমরা দেখেছি যে, কিং জেমস ভার্শনটা অথোরাইজড বা ‘অনুমোদিত’ সংস্করণ বলে গণ্য। বর্তমানে ইংরেজিতে আরো অনেক অনুবাদ বিদ্যমান। এ সকল অনুবাদে অনেক পরিবর্তনও করা হচ্ছে। একটা নমুনা ‘হেল’ (Hell) অর্থাৎ নরক, দোজখ বা জাহান্নাম। কিং জেমস বাইবেলের মধ্যে এ শব্দটা ৫৪ স্থানে বিদ্যমান। এর বিপরীতে আধুনিক অনেক ইংরেজি বাইবেলে শব্দটা একবারও উল্লেখ করা হয়নি। এ থেকে জানা যায় যে, কোনো অনুবাদই ঈশ্বরের মূল কথাটা পাঠককে প্রদান করছে না। বরং অনুবাদক বা সম্পাদকের নিজস্ব মতের আলোকেই ঈশ্বরের কথা সাজানো হচ্ছে। Tentmaker নামক যাজক সম্প্রদায়ের ওয়েবসাইটে গ্যারি অ্যামিরল্ট (Gary Amirault) বিভিন্ন অনুদিত বাইবেলের মধ্যে নরক শব্দের উপস্থিতির নিম্নরূপ একটা তালিকা উল্লেখ করছেন [19]:
Number of times “Hell” appears in the text in English Bible Translations | |||
Bible Translations | Old Test | New Test | Total |
“Authorized” King James Version | 31 | 23 | 54 |
New King James Version | 19 | 13 | 32 |
American Standard Version | 0 | 13 | 13 |
New American Standard Bible | 0 | 13 | 13 |
Revised Standard Version | 0 | 12 | 12 |
New Revised Standard Version | 0 | 12 | 12 |
Revised English Bible | 0 | 13 | 13 |
New Living Translation | 0 | 13 | 13 |
Amplified | 0 | 13 | 13 |
New International Version | 0 | 14 | 14 |
Darby | 0 | 12 | 12 |
New Century Version | 0 | 12 | 12 |
Wesley’s New Testament (1755) | 0 | 0 | |
Scarlett’s N.T. (1798) | 0 | 0 | |
The New Testament in Greek and English (Kneeland, 1823) | 0 | 0 | |
Young’s Literal Translation (1891) | 0 | 0 | 0 |
Twentieth Century New Testament (1900) | 0 | 0 | |
Rotherham’s Emphasized Bible (reprinted, 1902) | 0 | 0 | 0 |
Fenton’s Holy Bible in Modern English (1903) | 0 | 0 | 0 |
Weymouth’s New Testament in Modern Speech (1903) | 0 | 0 | |
Jewish Publication Society Bible Old Testament (1917) | 0 | 0 | |
Panin’s Numeric English New Testament (1914) | 0 | 0 | |
The People’s New Covenant (Overbury, 1925) | 0 | 0 | |
Hanson’s New Covenant (1884) | 0 | 0 | |
Western N.T. (1926) | 0 | 0 | |
NT of our Lord and Savior Anointed (Tomanek, 1958) | 0 | 0 | |
Concordant Literal NT (1983) | 0 | 0 | |
The N.T., A Translation (Clementson, 1938) | 0 | 0 | |
Emphatic Diaglott, Greek/English Interlinear (Wilson, 1942) | 0 | 0 | |
New American Bible (1970) | 0 | 0 | 0 |
Restoration of Original Sacred Name Bible (1976) | 0 | 0 | 0 |
Tanakh, The Holy Scriptures, Old Testament (1985) | 0 | 0 | |
The New Testament, A New Translation (Greber, 1980) | 0 | 0 | |
Christian Bible (1991) | 0 | 0 | 0 |
World English Bible (in progress) | 0 | 0 | 0 |
Orthodox Jewish Brit Chadasha [NT Only] | 0 | 0 | |
Zondervan Parallel N.T. in Greek and English (1975) | 0 | 0 | |
Int. NASB-NIV Parallel N.T. in Greek and English (1993) | 0 | 0 |
১. ৫. ৩. বাংলা ভাষায় বাইবেল ও অনুবাদের হেরফের
পলাশির যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয়ের পরে ইংল্যান্ডের প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানরা বাংলায় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য মিশনারি প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রসিদ্ধ ব্যাপটিস্ট খ্রিষ্টান মিশনারি William Carey: উইলিয়াম কেরি (১৭৬১-১৮৩৪) সর্বপ্রথম ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাভাষায় পূর্ণ বাইবেলের অনুবাদ প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে ভারতে ও বাংলাদেশে বাংলা বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
কাফিরদের-অর্থাৎ খ্রিষ্টধর্ম ছাড়া অন্য সকল ধর্মের মানুষদের- খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরের চেতনা থেকেই বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করা হয়। উইলিয়াম কেরি এ প্রসঙ্গে একটা পুস্তক রচনা করেন। পুস্তকটার নাম: (An Enquiry into the Obligations of Christians to Use Means for the Conversion of the Heathens) ‘কাফিরদের ধর্মান্তর করার জন্য উপকরণাদির ব্যবহার বিষয়ে খ্রিষ্টানদের দায়বদ্ধতা-বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে এক অনুসন্ধান।”[1]
ধর্মান্তরের এ উদ্দেশ্যের কারণেই সম্ভবত এ সকল অনুবাদে আমরা বিভিন্ন প্রকারের অস্পষ্টতা, পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজন দেখতে পাই। এখানে সামান্য কয়েকটা উদাহরণ পেশ করছি:
১. ৫. ৪. worship অনুবাদের হেরফের
বাইবেলের বাংলা অনুবাদের বিকৃতির একটা দিক হচ্ছে বিভিন্ন শব্দের অনুবাদে হেরফের করা। এখানে ইংরেজি ওয়র্শিপ (worship) ও ওয়াইন (wine) শব্দ দুটোর অনুবাদে বাংলা বাইবেলে, বিশেষত বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি কর্তৃক ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ নামক বাইবেলের বিকৃতি আলোচনা করব।
১. ৫. ৪. ১. worship শব্দটার আভিধানিক অর্থ
গুগলের অনলাইন অভিধানসহ যে কোনো অভিধানে পাঠক দেখবেন যে, worship শব্দটার অর্থ পূজা, উপাসনা, ভজনা, বন্দনা, অর্চনা, আরাধনা ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় ‘ইবাদত’ শব্দটাকে ইংরেজিতে ‘ওয়র্শিপ’ বলা হয়। শব্দটার মূল অর্থ ঈশ্বর বা দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। কোনো বিশ্বাসী ব্যক্তি যার মধ্যে ‘দেবত্ব’ বিদ্যমান বলে বিশ্বাস করেন তার প্রতি যে বিশেষ ভক্তি নিবেদন করেন সেই বিশেষ ভক্তি বা ভক্তির প্রকাশকে ‘ওয়র্শিপ ’ বা ‘ইবাদত’ বলা হয়।
১. ৫. ৪. ২. worship শব্দটার বাইবেলীয় অর্থ সাজদা করা
বাইবেলের ব্যবহার থেকে প্রতীয়মান যে, ওয়র্শিপ বলতে ‘সাজদা’ করা বুঝানো হয়েছে। আরবি বাইবেলে ‘ওয়র্শিপ ’ শব্দটার প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সাজদা’ লেখা হয়েছে এবং ‘সার্ভ’ (serve) শব্দটার প্রতিশব্দ ‘ইবাদত’ বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে মূল হিব্রু শব্দটা আমরা জানতে পারছি না। তবে হিব্রু ও আরবি উভয়ই সেমিটিক ভাষা এবং প্রায় একই শব্দ ও বাক্যরীতি ব্যবহার করে। এতে প্রতীয়মান যে, মূল হিব্রু ভাষার ‘সাজদা’ বা তদর্থক শব্দকেই ইংরেজিতে ‘ ওয়র্শিপ ’ শব্দে অনুবাদ করা হয়েছে। বাংলা কেরির অনুবাদে শব্দটার অর্থ ‘প্রণিপাত’ লেখা হয়েছে। এতেও প্রতীয়মান হয় যে, মূল শব্দটা ‘সাজদা’ বা ‘প্রণিপাত’। এছাড়া বাইবেলে বিভিন্ন স্থানে bow down অর্থাৎ মাথা নোয়ানো বা সাজদা করা এবং ওয়র্শিপ বা ইবাদত করাকে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে জানা যায় যে, বাইবেলের পরিভাষায় ওয়র্শিপ অর্থ সাজদা করা।
যাত্রাপুস্তক/হিজরত ২০/৫ শ্লোকে ঈশ্বর ভিন্ন অন্য দেবতা বা প্রতিমার ইবাদত নিষেধ করে ঈশ্বর বলছেন: “Thou shalt not bow down thyself to them, nor serve them”। কেরির অনুবাদ: “তুমি তাহাদের কাছে প্রণিপাত করিও না, এবং তাহাদের সেবা করিও না।” কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “তোমরা তাদের পুজাও করবে না, তাদের সেবাও করবে না।” আরবি বাইবেল: “لا تسجد لهن ولا تعبدهن”, অর্থাৎ “তোমরা তাদের সাজদাও করবে না, তাদের ইবাদতও করবে না।” একই কথা বলেছেন ঈশ্বর দ্বিতীয় বিবরণ ৫/৯ শ্লোকে এবং একই অনুবাদ করা হয়েছে আরবি ও বাংলায়।
আদিপুস্তক/পয়দায়েশ ২৪/২৬: “And the man bowed down his head, and worshiped the LORD”: “লোকটি তার মাথা নোয়াল এবং প্রভুর ইবাদত করল।” কেরির অনুবাদ: “তখন সে ব্যক্তি মস্তক নমন করিয়া সদাপ্রভুর উদ্দেশে প্রণিপাত করিলেন।” কিতাবুল মোকাদ্দস: “তখন সেই গোলাম মাবুদকে সেজদা করে”।
আদিপুস্তক ২৪/৪৮: ‘And I bowed down my head, and worshiped the LORD’: “আমি আমার মাথা নত করলাম এবং সদাপ্রভুর ইবাদত করলাম।” কেরির অনুবাদ: “আর মস্তক নমন করিয়া সদাপ্রভুর উদ্দেশে প্রণিপাত করিলাম।” কিতাবুল মোকাদ্দস: “তারপর আমি মাবুদকে সেজদা করলাম।”
এভাবে আমরা দেখছি যে, ওয়র্শিপ (worship) বা ইবাদত এবং বাউ ডাউন (bow down) উভয় শব্দই আরবিতে সাজদা এবং বাংলায় প্রণিপাত, সাজদা/ সেজদা বা পূজা অনুবাদ করা হয়েছে। বাউ ডাউন (bow down) বা সাজদা করার আরেকটা বাইবেলীয় পরিভাষা (fell on his face) মুখের উপর পড়ে যাওয়া, উবুড় হয়ে পড়া বা মাটির উপর মুখ রাখা এবং (fell on the ground) মাটির উপর পড়ে যাওয়া। (দেখুন: আদিপুস্তক/পয়দায়েশ ১৭/৩; যিহোশূয়/ যোশুয়া ৫/১৪; ১ শমূয়েল ২০/৪১; ২ শমূয়েল ৯/৬; ১ রাজাবলি ১৮/৭; মথি ২৬/৩৯; মার্ক ৯/২০; ১৪/৩৫; লূক ৫/১২)
নতুন নিয়মের দুটো বক্তব্য আরো নিশ্চিত করে যে, বাইবেলে (fell on his face) উবুড় হওয়া ও (worship) ইবাদত করা উভয়ই একই অর্থে ব্যবহৃত। যীশু একজন কুষ্ঠরোগী বা চর্মরোগীকে সুস্থ করেন। মথি ও লূক উভয়েই ঘটনাটা লেখেছেন। মথি বলেন: “And, behold, there came a leper and worshiped him, saying, Lord, if thou wilt, thou canst make me clean”: অর্থাৎ ‘সেই সময় একজন কুষ্ঠরোগী এসে তাকে ইবাদত (সাজদা) করে বলল…’। কিতাবুল মোকাদ্দস: “সেই সময় একজন চর্মরোগী এসে তাঁর সামনে উবুড় হয়ে বলল, হুজুর, আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে ভাল করতে পারেন।” (মথি ৮/২)
এখানে যে কর্মটা বুঝাতে মথি ‘ওয়র্শিপ ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন, সে কর্মের বর্ণনায় লূক (fell on his face) মুখের উপর পড়া বা সাজদা করা পরিভাষা ব্যবহার করেছেন: “behold a man full of leprosy: who seeing Jesus fell on his face, and besought him, saying, Lord, if thou wilt, thou canst make me clean”: “…কুষ্ঠরোগে পূর্ণ একজন লোক যীশুকে দেখে মুখের উপর পড়ে গেল ও কাকুতি মিনতি করে বলল…।” কিতাবুল মোকাদ্দস: “ঈসাকে দেখে সে উবুড় হয়ে পড়ে কাকুতি-মিনতি করে বলল, ‘হুজুর, আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে ভাল করতে পারেন।” (লূক ৫/১২)
এ থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, বাইবেলের পরিভাষায় উবুড় হওয়া, মাটিতে পড়া, সাজদা করা, প্রণিপাত করা ও ইবাদত করা একই অর্থে ব্যবহৃত।
বাংলা কিতাবুল মোকাদ্দসেও ওয়রশিপ (worship) অর্থ ‘সেজদা’ করা বলা হয়েছে। উপরে আমরা দেখেছি যে, পয়দায়েশ ২৪/২৬ ও ২৪/৪৮ শ্লোকে worship শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে: ‘সেজদা করা’। অনুরূপভাবে শয়তান কর্তৃক যীশুকে পরীক্ষা করা প্রসঙ্গে মথি ৪/৯ ও লূক ৪/৭ শ্লোকে শয়তানের বক্তব্য “All these things will I give thee, if thou wilt fall down and worship me”। কেরির অনুবাদ: “তুমি যদি ভূমিষ্ট হইয়া আমাকে প্রণাম কর”। কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “তুমি যদি মাটিতে পড়ে আমাকে সেজদা কর তবে এই সবই আমি তোমাকে দেব।”
প্রেরিত ১০/২৫: “as Peter was coming in, Cornelius met him, and fell down at his feet, and worshiped him”। কিতাবুল মোকাদ্দস: “পিতর যখন ঘরে ঢুকলেন তখন কর্ণীলিয় তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর পায়ের উপর উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সেজদা করলেন।”
এখানেও ওয়র্শিপ -এর অর্থ ‘সেজদা করা’ লেখা হয়েছে।
১. ৫. ৪. ৩. উবুড় হওয়া ও ইবাদত করা সমার্থক
উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে আমরা আরো নিশ্চিত হলাম যে, বাইবেলের পরিভাষায় উবুড় হওয়ার অর্থ সাজদা করা বা ইবাদত করা। এজন্য fell on his face অর্থাৎ উবুড় হওয়া, মুখের উপর পড়া বা মাটিতে পড়া এবং worship অর্থাৎ ইবাদত করা বা পূজা করাকে সমার্থক অর্থে ব্যবহার করেছেন মথি ও লূক।
কেরির অনুবাদে সঙ্গতি রক্ষা করার প্রবণতা দেখা যায়। সেখানে সর্বদা ওয়র্শিপ অর্থ প্রণিপাত, উপাসনা বা পূজা এবং ‘বাউ ডাউন’ এবং ‘ফেল অন ফেস’ অর্থ উবুড় হওয়া লেখা হয়েছে। তবে কিতাবুল মোকাদ্দস এ সঙ্গতি রক্ষা করেনি। ঈশ্বর বা যীশুর প্রসঙ্গে ওয়র্শিপ বা বাউ ডাউন অর্থ ‘সেজদা করা’ লেখা হয়েছে। আর নবী, ফেরেশতা, বাদশাহ বা অন্যদের ক্ষেত্রে একই শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে উবুড় হওয়া, সালাম করা ইত্যাদি। বাহ্যত মুসলিম বিশ্বাসের দিকে লক্ষ্য রেখে এবং যীশুর দেবত্ব প্রমাণ করতেই একই শব্দের অর্থ বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে।
আমরা দেখেছি বাংলা কিতাবুল মোকাদ্দসে হিজরত ২০/৫ এবং দ্বিতীয় বিবরণ ৫/৯ শ্লোকে ‘bow down’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে: পূজা করা। অন্যত্র fell on his face অর্থাৎ মুখের উপর পড়া বা উবুড় হওয়ার অর্থ সেজদা করা লেখা হয়েছে। আদিপুস্তক/ পয়দায়েশ ১৭/১-৩: “And when Abram was ninety years old and nine, the LORD appeared to Abram … And Abram fell on his face…”। কেরির অনুবাদ: “অব্রামের নিরানব্বই বৎসর বয়সে সদাপ্রভু তাঁহাকে দর্শন দিলেন… তখন অব্রাম উবুড় হইয়া পড়িলেন…।” কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “ইব্রামের বয়স যখন নিরানব্বই বছর তখন মাবুদ তাঁকে দেখা দিয়ে… এতে ইব্রাম সেজদায় পড়লেন।”
১. ৫. ৪. ৪. worship শব্দটাকে ইবাদত বা পূজা অর্থে ব্যবহার
এভাবে আমরা দেখছি যে, বাইবেলের পরিভাষায় ‘ওয়র্শিপ’ অর্থই ‘সাজদা করা’ বা ‘মাটিতে উপুড় হয়ে পড়া’। তবে বাইবেলের অনুবাদে বিভিন্ন স্থানে ওয়র্শিপ অর্থ ইবাদত, উপাসনা, ভজনা বা পূজাও লেখা হয়েছে।
মথি ১৫/৯ ও মার্ক ৭/৭ উভয় শ্লোকেই বলা হয়েছে: “But in vain they do worship me”। কেরির অনুবাদ: “ইহারা অনর্থক আমার আরাধনা করে।” কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “তারা মিথ্যাই আমার এবাদত করে।”
যোহন/ ইউহোন্না ৪/২০-২৪ শ্লোকে ওয়র্শিপ শব্দটা ১০ বার ব্যবহৃত হয়েছে। দশ স্থানেই কেরির অনুবাদে ‘ভজনা’ এবং কিতাবুল মোকাদ্দসে ‘এবাদত’ লেখা হয়েছে। প্রথম শ্লোকটা (৪/২০) হচ্ছে- “Our fathers worshiped in this mountain; and ye say, that in Jerusalem is the place where men ought to worship”: “আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই পাহাড়ে এবাদত করতেন, কিন্তু আপনারা বলে থাকেন জেরুজালেমেই লোকদের এবাদত করা উচিত।” পরবর্তী ৪ শ্লোকে শব্দটা ৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে এবং সকল স্থানেই বাংলায় এবাদত বা ভজনা বলা হয়েছে।
এভাবে কিতাবুল মোকাদ্দসে বিভিন্ন স্থানে ওয়র্শিপ অর্থ এবাদত, উপাসনা বা পূজা লেখা হয়েছে। দেখুন: যোহন/ ইউহোন্না ১২/২০; প্রেরিত ৭/৪২; ৭/৪৩; ৮/২৭; ১৭/২৩; ১৮/১৩; ২৪/১১; ২৪/১৪। কেরির অনুবাদে ভজনা বা পূজা লেখা হয়েছে।
১. ৫. ৪. ৫. worship বিষয়ে বাইবেলীয় বিধান ও রকমারি অনুবাদ
পবিত্র বাইবেলে অধিকাংশ স্থানে একমাত্র ঈশ্বরকে ‘ওয়র্শিপ’ করতে বলা হয়েছে। অন্য কোনো দেবতা, প্রতিমা বা বস্তুকে ‘ওয়র্শিপ’ করতে নিষেধ করা হয়েছে। (যাত্রাপুস্তক ২০/৫; ৩৪/১৪; দ্বিতীয় বিবরণ ৫/৯; ৩০/১৭; ২ রাজাবলি ১৭/৩৬; মথি ৪/১০…) কিন্তু এর বিপরীতে বাইবেলে অনেক স্থানে নবীরা বা বশ্বাসীরা ঈশ্বর ছাড়া অন্য ব্যক্তিকে ওয়র্শিপ (worship) এবং বাউ ডাউন (bow down/ fell on his face) করেছেন। আমরা দেখেছি যে, বাইবেলীয় পরিভাষায় ওয়র্শিপ অর্থ সাজদা বা ইবাদত করা এবং বাউ ডাউন, উপুড় হওয়া বা মুখের উপর পড়ার অর্থও সাজদা করা। অর্থাৎ তাঁরা ঈশ্বর ছাড়া অন্যদের সাজদা করতেন। এছাড়া তাঁরা অন্যদের সাজদা ও ইবাদত গ্রহণ করেছেন। উপুড় হওয়া এবং মুখের উপর পড়ে যাওয়ার কথা- অর্থাৎ সাজদা করার কথা তো অনেক স্থানেই বিদ্যমান। এছাড়া ঈশ্বর ছাড়া অন্যকে ‘ওয়র্শিপ’ অর্থাৎ ইবাদত করার কথাও বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে। ইংরেজি বাইবেলে এ সকল বিষয় খুবই সুস্পষ্ট। উইলিয়াম কেরির অনুবাদ অনেকটাই মূলাশ্রয়ী। সকল ক্ষেত্রেই ওয়র্শিপ শব্দটার অর্থ লেখা হয়েছে ‘প্রণিপাত করা’, অর্থাৎ সাজদা করা। কিন্তু ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ নামক বাংলা বাইবেলে এক্ষেত্রে অনেক হেরফের করা হয়েছে। একই শব্দ কখনো পূজা, কখনো সালাম, কখনো ‘সেজদা’ ইত্যাদি রকমারি অনুবাদ করা হয়েছে। এতে ইহুদি ও খ্রিষ্টান নবীরা ও ধার্মিকরা যে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের সাজদা করতেন তা পাঠক জানতে পারছেন না। বরং তারা জানছেন যে, তারা আল্লাহর সাজদা বা পূজা করতেন আর ফেরেশতা, নবী ও অন্যদেরকে ‘উবুড় হয়ে’ সালাম করতেন বা সম্মান দেখাতেন। অন্য সকল ফেরেশতা, নবী, বাদশাহ ও ধার্মিকের মতই যীশু খ্রিষ্টকেও সে যুগের ধার্মিক বা ভক্তরা এভাবে ‘সাজদা’ করে ‘সম্মান’ করতেন। কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দসে নবী, বাদশাহ, ধার্মিক বা ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে ‘ওয়র্শিপ’, ‘বাউ ডাউন’ বা ‘ফেল অন হিজ ফেস’ বলতে সালাম, সম্মান প্রদর্শন বা কদমবুছি শব্দ ব্যবহার করছেন। পক্ষান্তরে যীশু খ্রিষ্টের ক্ষেত্রে একই শব্দের অনুবাদে ‘সেজদা’ শব্দ ব্যবহার করছেন। বাহ্যত এ দ্বারা তারা বুঝাচ্ছেন যে, যীশুকেও ঈশ্বরের মত ইবাদত করা হত এবং যীশু তা গ্রহণ করতেন। এখানে সামান্য কয়েকটা নমুনা উল্লেখ করছি:
১. ৫. ৪. ৬. ওয়র্শিপ ও উবুড় হওয়া অর্থ সম্মান দেখানো বা সালাম করা
(ক) যিহোশূয় ফেরেশতাকে সাজদা ও ইবাদত করলেন
উপরে কয়েকটা উদ্ধৃতিতে আমরা দেখলাম যে, কিতাবুল মোকাদ্দসে worship, bow down, fell on his face শব্দগুলোর অর্থ ‘সেজদা করা’ বা ‘এবাদত করা’ লেখা হয়েছে। অন্যান্য স্থানে এ শব্দগুলোর অনুবাদে অন্যান্য শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
যিহোশূয় বা ইউসা পুস্তকের ৫/১৩-১৪ শ্লোক কিতাবুল মোকাদ্দসে নিম্নরূপ: “জেরিকোর কাছাকাছি গেলে পর ইউসা খোলা তলোয়ার হাতে একজন লোককে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। ইউসা তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কার পক্ষের লোক- আমাদের, না আমাদের শত্রুদের?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি কারও পক্ষের লোক নই। আমি মাবুদের সৈন্যদলের সেনাপতি, এখন আমি এখানে এসেছি।’ এই কথা শুনে ইউসা মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সম্মান দেখালেন।”
শেষ বাক্যটার ইংরেজি ‘fell on his face to the earth, and did worship’। অর্থাৎ: “তিনি মাটিতে মুখ রেখে সাজদা করলেন এবং ইবাদত করলেন।” আমরা দেখেছি যে, কেরির অনুবাদে ‘fell on his face’ অর্থ উপুড় হওয়া এবং ‘worship’ অর্থ প্রণিপাত বা সাজদা। এ মূলনীতি ঠিক রেখে এ শ্লোকে কেরির অনুবাদ: “তখন যিহোশূয় ভূমিতে উবুড় হইয়া পড়িয়া প্রণিপাত করিলেন।” কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ এখানে অসঙ্গতিপূর্ণ। উপরে বিভিন্ন স্থানে ‘fell on his face’ অর্থ লেখা হয়েছে: ‘সেজদায় পড়লেন’। অথচ এখানে একই কথার অর্থ লেখা হয়েছে ‘উবুড় হয়ে’। এরপর ‘ওয়র্শিপ’ শব্দটার অর্থ লেখা হয়েছে ‘সম্মান দেখানো’।
(খ) দাউদ তালুতের ছেলে যোনাথনকে সাজদা করলেন!
১ শমূয়েল ২০/৪১ “David arose out of a place toward the south, and fell on his face to the ground, and bowed himself three times” অর্থাৎ “দাউদ দক্ষিণের দিকে একটা স্থান থেকে উঠে আসলেন, মাটির উপর তার মুখ রেখে পড়ে গেলেন: সাজদা করলেন এবং তিনবার নিজেকে উপুড় করলেন।” কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “দাউদ সেই পাথরটার দক্ষিণ দিক থেকে উঠে আসলেন। তিনি যোনাথনের সামনে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তিনবার তাঁকে সালাম জানালেন।”
এখানেও সাজদা করাকে ‘মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সালাম জানানো’ বলা হল!
(গ) ধার্মিক ওবদিয় নবী ইলিয়াসকে সাজদা করলেন
১ রাজাবলি/ বাদশাহনামা ১৮/৭: “Obadiah was in the way, behold, Elijah met him: and he knew him, and fell on his face”: “ওবদিয় পথ দিয়ে যেতে ইলিয়াসকে দেখে চিনতে পেরে ‘তার মুখের উপর পড়ে গেলেন’: তাকে সাজদা করলেন।” কিতাবুল মোকাদ্দস: “ওবদিয় পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ইলিয়াসের সংগে তাঁর দেখা হল। ওবদিয় তাঁকে চিনতে পেরে মাটিতে উবুড় হয়ে বললেন…।”
এভাবে বাইবেলে অনেক স্থানে নবীরা বা ধার্মিকরা অন্যদের সামনে মাটিতে উবুড় হয়েছেন, অর্থাৎ সাজদা করেছেন। কিতাবুল মোকাদ্দসে উবুড় হওয়া, সালাম করা, সম্মান দেখানো ইত্যাদি অনুবাদের মাধ্যমে মূল তথ্যটা একেবারেই অস্পষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখব যে, যীশুর ক্ষেত্রে এ শব্দের অর্থে ‘সেজদা করা’ লেখা হয়েছে।
(ঘ) ধার্মিক মহিলা নবী আল-ইয়াসাকে সাজদা করলেন
আল-ইয়াসা একজন মহিলার মৃত সন্তানকে জীবিত করেন। তখন মহিলা তাঁকে সাজদা করেন: ২ বাদশাহনামা ৪/৩৭ “Then she went in, and fell at his feet, and bowed herself to the ground: তখন স্ত্রীলোকটি ভিতরে আসল এবং তাঁর পায়ের উপর সাজদা করল।” কেরি: “তখন সে স্ত্রীলোক নিকটে গিয়া তাঁর পদতলে পড়িয়া ভূমিতে প্রণিপাত করিলেন।” কিতাবুল মোকাদ্দস: “স্ত্রীলোকটি ঘরে ঢুকে তাঁর পায়ে পড়লেন এবং মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সালাম জানালেন।”
১. ৫. ৪. ৭. যীশুর সাজদাকে উবুড় হওয়া বলা হল
বাইবেল থেকে আমরা জানছি যে, যীশু আল্লাহকে সাজদা করতেন, সাজদার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করতেন এবং সাজদারত অবস্থায় দুআ বা মুনাজাত করতেন।
মথি ২৬/৩৯: “And he went a little further, and fell on his face, and prayed, saying: তিনি কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে মুখের উপর পড়লেন, অর্থাৎ সাজদা করলেন এবং দুআ করে বললেন…।” কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “তিনি কিছু দূরে গিয়ে মাটিতে উবুুড় হয়ে পড়লেন এবং মুনাজাত করে বললেন…।”
মার্ক ১৪/৩৫: “And he went forward a little, and fell on the ground, and prayed” অর্থাৎ “তিনি কিছু দূরে এগিয়ে গিয়ে মাটির উপর পড়লেন: সাজদা করলেন এবং দুআ করলেন”। কিতাবুল মোকাদ্দস: “তার পরে তিনি কিছু দূরে গিয়ে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে মুনাজাত করলেন।”
আমরা দেখেছি, ঠিক এ বাক্যাংশকেই কিতাবুল মোকাদ্দসে অন্যান্য স্থানে ‘সেজদা করা’ বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে উবুড় হওয়া বলা হয়েছে।
১. ৫. ৪. ৮. ‘ওয়র্শিপ’ বা ইবাদত অর্থ উবুড় হওয়া!
এভাবে বাইবেলে বহু স্থানে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সৃষ্টিকে: নবী, ফেরেশতা, বাদশাহ বা অন্যদেরকে সাজদা করা হয়েছে এবং নবীরা ও ধার্মিকরাই এরূপ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ‘ওয়র্শিপ’ বা ‘ইবাদত’ শব্দটাও আল্লাহ ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। উপরে আমরা দেখেছি যে, ইউসা বা যিহোশূয় ফেরেশতাকে ‘ইবাদত’ করেছেন বলে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেরির অনুবাদে সকল স্থানে ‘প্রণিপাত’ লেখা হয়েছে। কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদে অনেক হেরফের রয়েছে। এ পুস্তকেই অনেক স্থানে ওয়র্শিপ অর্থ সেজদা (সাজদা) বা এবাদত (ইবাদত) লেখা হয়েছে, কিন্তু অন্যান্য স্থানে ‘ওয়র্শিপ’ শব্দের এমন সব অর্থ লেখা হয়েছে যা শব্দটার আভিধানিক বা ব্যবহারিক অর্থ থেকে বহু দূরবর্তী।
কোথাও ওয়র্শিপের অর্থ লেখা হয়েছে ‘উবুড় হওয়া’। মথি লেখেছেন: “there came a certain ruler, and worshiped him, saying”: “তখন একজন নেতা/শাসক আসলেন এবং তাঁকে ইবাদত/উপাসনা/ ভজনা করে বললেন।” (মথি ৯/১৮)। এখানে কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “তখন একজন ইহুদি নেতা তাঁর কাছে আসলেন এবং তাঁর সামনে উবুড় হয়ে বললেন।”
অন্যত্র মথি লেখেছেন: “Then came she and worshiped him, saying: তখন স্ত্রীলোকটি এসে তাঁকে ইবাদত করে বলল…।” (মথি ১৫/২৫)। কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “সেই স্ত্রীলোকটি কিন্তু ঈসার কাছে এসে তাঁর সামনে উবুড় হয়ে পড়ে বলল।”
এভাবে বারবার ওয়র্শিপ শব্দের অর্থ লেখা হচ্ছে ‘উবুড় হওয়া’। অথচ অন্যান্য স্থানে এ শব্দেরই অর্থ লেখা হয়েছে ‘এবাদত করা’ বা ‘সেজদা করা’। আর এ কথা তো সকলেরই জানা যে, দেবতার সামনে উবুড় হয়ে সাজদা করা ছাড়া সাধারণ চিত, কাত বা উবুড় হওয়ার সাথে ‘ওয়র্শিপ’ শব্দটার কোনো সম্পর্ক নেই।
১. ৫. ৪. ৯. ‘ওয়র্শিপ’ বা ‘ইবাদত’ অর্থ সম্মান দেখানো
অন্যান্য স্থানে ওয়র্শিপ শব্দটার অর্থ সম্মান দেখানো লেখা হয়েছে। শুধু ঈশ্বর বা দেবতাকে ধর্মীয় ভক্তি বা সম্মান দেখানোকেই ইবাদত বা ওয়র্শিপ বলা হয় এবং সাজদার মাধ্যমেই তা প্রকাশ করা হয়। শুধু সম্মান দেখানোকে কখনোই ওয়র্শিপ বলা হয় না। মানুষ মা, বাবা, শিক্ষক, শাসক ও অন্য অনেককেই সম্মান দেখায়। এরূপ সম্মান দেখানোর কারণে কাউকে বলা হয় না যে, সে পিতা, মাতা, শিক্ষক, শাসক বা অমুকের পূজারী, ইবাদতকারী বা ওয়র্শিপার। এরূপ অর্থের কয়েকটা নমুনা দেখুন:
দানিয়েল ২/৪৬: “the king Nebuchadnezzar fell upon his face, and worshiped Daniel” অর্থাৎ “নেবুকাদনেজার তার মুখের উপর পড়ে গেলেন: সাজদা করলেন এবং দানিয়েলের ইবাদত বা পূজা করলেন।” কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “তখন বাদশাহ বখতে-নাসার দানিয়েলের সামনে উবুড় হয়ে পড়ে তাঁকে সম্মান দেখালেন। এবং তাঁর সামনে শস্য কোরবানী করতে ও ধূপ জ্বালাতে হুকুম করলেন।”
এখানে মূল ইংরেজিতে ‘সাজদা করা’ এবং ‘ইবাদত করা’ দুটো কর্মই উল্লেখ করা হয়েছে। উপরন্তু ‘দানিয়েল পূজার’ অংশ হিসেবে তাঁর সামনে শস্য কোরবানী ও ধূপ জ্বালানো হল। তারপরও কিতাবুল মোকাদ্দসে ‘উবুড় হয়ে সম্মান দেখালেন’ বলে পুরো বিষয়টাই অস্পষ্ট করা হয়েছে।
মথি লেখেছেন যে, যীশুর জন্মের পরে পূর্বদেশীয় কিছু পণ্ডিত তাঁকে সাজদা করার জন্য আগমন করেন। তারা রাজা হেরোদকে বলেন: “Where is he that is born King of the Jews? for we have seen his star in the east, and are come to worship him”: “ইহুদিদের যে রাজার জন্ম হয়েছে তিনি কোথায়? আমরা পূর্বদিকে তাঁর তারা দেখেছি এবং তাঁকে ইবাদত (সাজদা) করার জন্য এসেছি।” কিতাবুল মোকাদ্দস: “ইহুদিদের যে বাদশাহ জন্মেছেন তিনি কোথায়? পূর্ব দিকের আসমানে আমরা তাঁর তারা দেখে মাটিতে উবুড় হয়ে তাঁকে সম্মান দেখাতে এসেছি।” (মথি ২/২)
রাজা হেরোদ তাদেরকে বলেন: “when ye have found him, bring me word again, that I may come and worship him also”: “তাঁকে যদি আপনারা খুঁজে পান তবে আমাকে জানাবেন, যেন আমিও তাঁর ইবাদত (সাজদা) করতে পারি।” কিতাবুল মোকাদ্দস: “যেন আমিও গিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে তাঁকে সম্মান দেখাতে পারি।” (মথি ২/৮) একইভাবে ‘ওয়র্শিপ’ শব্দের এ অর্থ দেখুন মথি ২/১১; ৮/২।
বিষয়টা বড়ই অদ্ভুত! ওয়র্শিপ শব্দের আভিধানিক অর্থ ভজনা বা ইবাদত এবং বাইবেলের ব্যবহারিক অর্থ সাজদা করা। উভয় অর্থই কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদকরা জানেন এবং বারবার ব্যবহারও করেছেন। অথচ এখানে তারা প্রকৃত অর্থ বেমালুম চেপে যেয়ে এক শব্দের বদলে দীর্ঘ শব্দমালার অদ্ভুত একটা অর্থ লেখলেন।
১. ৫. ৪. ১০. ওয়র্শিপ বা ইবাদত করা অর্থ পা ধরা
অন্যত্র ‘ওয়র্শিপ’ বা ইবাদত অর্থ লেখা হয়েছে পা ধরা! মথি ১৮/২৬ শ্লোকে যীশু বলেন: “The servant therefore fell down, and worshiped him: তাতে সেই কর্মচারী মাটিতে পড়ল বা সাজদা করল এবং তার মালিককে ইবাদত করল।” কিতাবুল মোকাদ্দস: “তাতে সেই কর্মচারী মাটিতে পড়ে মালিকের পা ধরে বলল”।
১. ৫. ৪. ১১. ওয়র্শিপ অর্থ কদমবুসি
যীশু বলেছেন যে, ইহুদিদেরকে তিনি খ্রিষ্টানদের সামনে নত করাবেন এবং ইহুদিরা খ্রিষ্টানদের পায়ে পড়ে ‘ইবাদত’ (worship) করবে। প্রকাশিত বাক্য ৩/৯: “I will make them of the synagogue of Satan, which say they are Jews, and are not, but do lie; behold, I will make them to come and worship before thy feet: যারা নিজেদেরকে ইহুদি বলে অথচ ইহুদি নয়, শয়তানের দলের (শয়তানের সিনাগগের) সেই মিথ্যাবাদী লোকদের আমি তোমার কাছে আনব যেন তারা তোমার পায়ে পড়ে ইবাদত করে।”
“worship before thy feet: তারা তোমার পায়ে পড়ে ইবাদত করবে” কথাটার অনুবাদ কেরি: “তোমার চরণ সমীপে তাহাদিগকে উপস্থিত করাইয়া প্রণিপাত করাইব।” জুবিলী বাইবেল: “ওদের এনে আমি তোমার পায়ের সামনে প্রণিপাত করতে বাধ্য করব।” কি. মো. “তোমার পায়ের কাছে কদমবুসি করাব”।
১. ৫. ৪. ১২. ওয়র্শিপ বা ইবাদত অর্থ সম্মান বা গৌরব
লূক ১৪/১০ যীশু বলেন: “But when thou art bidden, go and sit down in the lowest room; that when he that bade thee comets, he may say unto thee, Friend, go up higher: then shalt thou have worship in the presence of them that sit at meat with thee: আপনি যখন দাওয়াত পাবেন তখন বরং সবচেয়ে নীচু জায়গায় গিয়ে বসবেন। তাহলে দাওয়াত-কর্তা এসে আপনাকে বলবেন, ‘বন্ধু, আরও ভাল জায়গায় গিয়ে বসুন।’ তখন অন্য সব মেহমানদের সামনে আপনি ইবাদত (ইংরেজি: worship, কেরি: গৌরব; কিতাবুল মোকাদ্দস: সম্মান) পাবেন।”
১. ৫. ৪. ১৩. ‘ওয়র্শিপ’ বা ইবাদত অর্থ ‘ভয় করা’
কিতাবুল মোকাদ্দসে অন্যত্র ‘ওয়র্শিপ’ শব্দের অর্থ বলা হয়েছে ভয় করা। মথি ৪/১০ ও লূক ৪/৮: “it is written, Thou shalt worship the Lord thy God, and him only shalt thou serve: লেখা আছে তুমি তোমার ঈশ্বরের ইবাদত (সাজদা) করবে এবং তাঁরই সেবা (ইবাদত) করবে।” কেরির অনুবাদ: “লেখা আছে, তোমার ঈশ্বর প্রভুকেই প্রণাম করিবে, কেবল তাঁহারই আরাধনা করিবে।” কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “পাক কিতাবে লেখা আছে, তুমি তোমার মাবুদ আল্লাহকেই ভয় করবে, কেবল তাঁরই এবাদত করবে।”
এরূপ স্বাধীন অনুবাদ ধর্মগ্রন্থ তো দূরের কথা সাধারণ সাহিত্য কর্মের ক্ষেত্রেও বিকৃতি বলে বিবেচিত হবে বলে আমরা ধারণা করি। যীশুর এ বক্তব্যটা দ্বিতীয় বিবরণ ৬/১৩ শ্লোকের উদ্ধৃতি। দ্বিতীয় বিবরণে ‘ওয়র্শিপ’ (সাজদা বা ইবাদত) শব্দের পরিবর্তে ফিয়ার (ভয়) শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে: “Thou shalt fear the LORD thy God, and serve him”: “তুমি সদাপ্রভু তোমার ঈশ্বরকে ভয় করবে এবং তাঁর সেবা করবে।” কিন্তু এখানে যীশু ‘ওয়র্শিপ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। কেরির অনুবাদে মৌলিকতা রক্ষা করা হলেও কিতাবুল মোকাদ্দসে যীশুর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
১. ৫. ৪. ১৪. যীশুর ক্ষেত্রে ওয়র্শিপ আবার ‘সেজদা’ হয়ে গেল
উপরে আমরা দেখলাম যে, ওয়র্শিপ শব্দটার অর্থ ইবাদত, পূজা, প্রণিপাত বা সাজদা করা। কিন্তু বাংলা কিতাবুল মোকাদ্দসে শব্দটার অর্থ বহুভাবে হেরফের করা হয়েছে। এ হেরফেরের সর্বশেষ রূপ যীশুর ক্ষেত্রে ওয়র্শিপ সালাম করা, সম্মান দেখানো, কদমবুসি করা ইত্যাদি থেকে হঠাৎ করেই ‘সেজদা করা’ বা ‘উপুড় হয়ে সেজদা করা’ হয়ে গেল। কয়েকটা নমুনা দেখুন:
মথি ১৪/৩৩: “Then they that were in the ship came and worshiped him, saying…”। কিতাবুল মোকাদ্দস: “যাঁরা নৌকার মধ্যে ছিলেন তাঁরা ঈসাকে সেজদা করে বললেন, সত্যিই আপনি ইবনুল্লাহ।”
মথি ২৮/৯: “And they came and held him by the feet, and worshiped him”। কিতাবুল মোকাদ্দস: “তখন সেই স্ত্রীলোকেরা তাঁর কাছে গিয়ে পা ধরে তাঁকে সেজদা করলেন।”
মথি ২৮/১৭: “And when they saw him, they worshiped him: but some doubted”। কি. মো.: “সেখানে ঈসাকে দেখে তাঁরা তাঁকে সেজদা করলেন, কিন্তু কয়েকজন সন্দেহ করলেন।” (বাইবেল-২০০০: প্রণাম করে ঈশ্বরের সম্মান দিলেন)
লূক ২৪/৫২: “And they worshiped him”। কি. মো: “তখন তারা উবুড় হয়ে তাঁকে সেজদা করলেন।” (বা.-০০: উপুড় হয়ে প্রণাম করে ঈশ্বরের সম্মান দিলেন)
যোহন/ইউহোন্না ৯/৩৮: “And he said, Lord, I believe. And he worshiped him”। কি. মো: “তখন লোকটি বলল, ‘হুজুর, আমি ঈমান আনলাম।’ এই বলে সে ঈসাকে সেজদা করল।” (প্রণাম করে ঈশ্বরের সম্মান দিলেন)
বাহ্যত যীশুর ঈশ্বরত্ব প্রমাণের জন্যই ওয়র্শিপ শব্দের অনুবাদে এরূপ লুকোচুরি। যে শব্দটার অর্থ প্রণাম করা, সালাম করা ইত্যাদি লেখা হল, অবিকল সে শব্দটাই যীশুর ক্ষেত্রে ‘প্রণাম করে ঈশ্বরের সম্মান জানান’ বা ‘সাজদা করা’ হয়ে গেল!! অথচ যীশুকে যেভাবে ওয়র্শিপ, সাজদা বা ‘প্রণাম করে ঈশ্বরের সম্মান’ করা হয়েছে এরূপ ‘ওয়র্শিপ’ বাইবেলের নবী ও ধার্মিকরা ফেরেশতা, নবী, বাদশাহ ও অন্যদের করেছেন। বাইবেলীয় নবী ও ধার্মিকদেরকে নির্বিচারে এভাবে ওয়র্শিপ করা হয়েছে। ওয়র্শিপ এবং সমার্থক শব্দগুলো তাঁদের সকলের ক্ষেত্রেই একইভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। শুধু অনুবাদের স্বেচ্ছাচারিতায় বাংলাভাষী পাঠকের কাছ থেকে সত্য হারিয়ে গেল!
১. ৫. ৫. wine অনুবাদের হেরফের
ইংরেজি ওয়াইন (wine) শব্দটার অর্থ ‘মদ’ বা ‘আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত মদ’, আরবি খামর (خمر)। এনকার্টা ডিকশনারি ওয়াইন শব্দের অর্থ লেখেছে: “an alcoholic drink made by fermenting the juice of grapes: আঙ্গুরের রস গাজিয়ে তুলে তৈরি করা মাদক পানীয়।” এনকার্টা বিশ্বকোষ লেখেছে: “Wine, alcoholic beverage made from the juice of grapes: ওয়াইন: আঙ্গুরের রস থেকে তৈরি মাদক পানীয়।” মাদকমুক্ত আঙ্গুররস, দ্রাক্ষারস বা গ্রেপ জুসকে কখনোই ‘ওয়াইন’ বলা হয় না।
মদ বা মাদক পানীয় বুঝাতে বাইবেলে wine অর্থাৎ মদ এবং strong drink অর্থাৎ মাদক পানীয় শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাংলা বাইবেলগুলোতে অধিকাংশ স্থানে ওয়াইনের অনুবাদ করা হয়েছে দ্রাক্ষারস বা আঙ্গুর রস। এজন্য ইংরেজি ভাষায় বাইবেল পাঠ করলে মদের বিষয়ে বাইবেলের নির্দেশনা অনুধাবন করা যত সহজ হয় বাংলায় তা একেবারেই সম্ভব নয়। বাইবেলের বাংলা অনুবাদগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ‘আঙ্গুর-রস’ বিষয়ে অনেক কথা পাঠককে মাতাল না করলেও হতবাক করে। অনুবাদের হাতছাফাইয়ে ইংরেজি ‘ওয়াইন’ শব্দটা কোথাও ‘আঙ্গুর রস’ বা ‘দ্রাক্ষারস’ এবং কোথাও মদে পরিণত হয়েছে এবং কোথাও শব্দটার অনুবাদ একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে।
১. ৫. ৫. ১. আঙ্গুরের জুস খেয়েও মানুষ মাতাল হয়
অবাক বিস্ময়ে পাঠক বাংলা বাইবেলে বারবার পড়বেন, আঙ্গুর রস খেলে মানুষ মাতাল হয় (গীতসংহিতা ৭৮/৬৫)। “আফরাহীমের ইমাম ও নবীরা এখন আঙ্গুর-রস খেয়ে টলে ও মাতলামি করে…” (ইশাইয়া/ যিশাইয় ২৮/৭)। “আঙ্গুর রস খেয়ে ভীষণ মাতাল লোকের মত হয়েছি” (যিরমিয়/ইয়ারমিয়া ২৩/৯)। “আঙ্গুর রস খেয়ে টলতে থাকবে।” (যিরমিয় ২৫/১৫)। আঙ্গুর-রস খেয়ে কি পাঠক কখনো টলেছেন ও মাতলামি করেছেন? ভীষণ মাতাল হয়েছেন?
১. ৫. ৫. ২. আঙ্গুরের রস খেয়ে নবীরা উলঙ্গ হন ও ব্যভিচার করেন!
নোহ আঙ্গুর-রস খেয়ে উলঙ্গ হলেন (আদিপুস্তক/ পয়দায়েশ ৯/২১-২৪) এবং লোট আঙ্গুরের রস খেয়ে নিজের মেয়েদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হলেন (আদিপুস্তক/পয়দায়েশ ১৯/৩২-৩৫)। পাঠক হতবাক হয়ে চিন্তা করবেন আঙ্গুর-রস বা গ্রেপ-জুস খেলে কিভাবে এরূপ হতে পারে?
১. ৫. ৫. ৩. ফুর্তিতে মাতাল হওয়ার জন্য আঙ্গুরের রস পান করুন
আঙ্গুর রসে মানুষের হৃদয় ফুর্তিতে ভরে যায় বা ফুর্তিতে মাতাল হয়ে উঠে! (২ শমুয়েল ১৩/২৮; ইষ্টের ১/১০; গীতসংহিতা/জবুর ১০৪/১৫; উপদেশক/ হেদায়েতকারী ১০/১৯; জাকারিয়া/সখরিয় ১০/৭)। পাঠক বুঝতে পারেন না কিভাবে তা হয়! আমরা যখন আঙ্গুরের জুস পান করি তখন কোনোই ‘ফুর্তি’ হয় না!
পাঠক পড়বেন: “যাদের মনে খুব কষ্ট আছে তাদের আঙ্গুর রস দাও। তারা তা খেয়ে তাদের অভাবের কথা ভুলে যাক, তাদের দুঃখ-কষ্ট আর তাদের মনে না থাকুক” (মেসাল/ হিতোপদেশ ৩১/৬-৭)। পাঠক আরও পড়বেন: “আমি স্বজ্ঞানে আঙ্গুর রস খেয়ে শরীরকে উত্তেজিত করলাম এবং নির্বোধের মত কাজ করে নিজেকে খুশী করবার চেষ্টা করলাম।” (উপদেশক/ হেদায়েতকারী ২/৩) পাঠক হতবাক হয়ে ভাববেন, আঙ্গুরের রস খেলে কিভাবে মানুষ দুঃখকষ্টের কথা ভুলে যেতে পারে? আঙ্গুরের রস খাওয়ার মধ্যে নির্বুদ্ধিতাই বা কী? আর আঙ্গুরের রস খেলে শরীরই বা কিভাবে উত্তেজিত হয়?
১. ৫. ৫. ৪. আঙ্গুর রস ভালবাসলে সে কখনো ধনী হতে পারবে না
বাংলা বাইবেলে পাঠক যখন পড়বেন, আঙ্গুর রস ভালবাসলে সে কখনো ধনী হতে পারে না (মেসাল/হিতোপদেশ ২১/১৭) তখন দিশেহারা হয়ে ভাববেন যে, কথাটা কিভাবে সত্য হতে পারে? আঙ্গুরের জুস পছন্দ করলে সমস্যা কোথায়?
১. ৫. ৫. ৫. সমস্যার সমাধানে ইংরেজি বাইবেল পড়ুন
ইংরেজি ভাষায় বাইবেল পড়লে পাঠকের উপরের সকল বিস্ময় কেটে যাবে। তবে অন্য একটা বিস্ময় তার উপর ভর করবে: কিভাবে মূল বাইবেলের মদ বাংলা বাইবেলে আঙ্গুর-রস বা গ্রেপ-জুসে পরিণত হল!
১. ৫. ৫. ৬. মাঝে মাঝে কারণ ছাড়াই আঙ্গুর-রস মদে পরিণত হয়!
বাংলা বাইবেলগুলোতে ‘ওয়াইনের’ অনুবাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্রাক্ষারস বা আঙ্গুর-রস লেখা হলেও মাঝে মাঝে মদ লেখা হয়েছে। মাঝে মাঝেই আমরা দেখি যে, ইংরেজি ‘ওয়াইন’ নিরীহ আঙ্গুর রস থেকে মদে পরিণত হয়েছে! কয়েকটা নমুনা দেখুন:
(How long wilt thou be drunken? put away thy wine from thee) “তুমি মদ খেয়ে আর কতক্ষণ নিজেকে মাতাল করে রাখবে, মদ আর খেয়ো না।” (১ শামুয়েল ১/১৪)। (drink the wine of violence): “জুলুম হল তাদের মদ” (মেসাল/ হিতোপদেশ ৪/১৭)। (Wine is a mocker): যে লোক মদানো আঙ্গুর-রস খেয়ে মাতাল হয় সে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে।” (মেসাল ২০/১) (They that tarry long at the wine; they that go to seek mixed wine. Look not thou upon the wine when it is red) যারা অনেকক্ষণ ধরে মদ খায় তাদেরই এই রকম হয়; তারা মিশানো মদ খেয়ে দেখবার জন্য তার খোঁজে যায়। মদের দিকে তাকায়ো না যদিও তা লাল রঙ্গের।” (মেসাল ২৩/৩০-৩১)(it is not for kings to drink wine) “বাদশাহদের পক্ষে মাদানো আঙ্গুর রস খাওয়া উপযুক্ত নয়।” (মেসাল: ৩১/৪)
(they shall be drunken with their own blood, as with sweet wine) “তারা মদের মত করে নিজেদের রক্ত খেয়ে মাতাল হবে।” (ইশাইয়া ৪৯/২৬)। (all ye drinkers of wine, because of the new wine; for it is cut off from your mouth): “ওহে সমস্ত মদখোর, তোমরা টাটকা আঙ্গুর-রসের মদের জন্য বিলাপ কর; কারণ তা তোমাদের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।” (যোয়েল ১/৫)। (These men are full of new wine) “ওরা মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে।” (প্রেরিত ২/১৩)। (the wine of the wrath of her fornication): “জেনার ভয়ংকর মদ” (প্রকাশিত কালাম ১৪/৮; ১৮/৩)। (the wine of the wrath of God): “আল্লাহর গজবের মদ” (প্রকাশিত ১৪/১০) । (the wine of the fierceness of his wrath): “তাঁর গজবের ভয়ংকর মদে” (প্রকাশিত ১৬/১৯)।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি (BBS) প্রকাশিত কিতাবুল মোকাদ্দসে উপরের সকল স্থানে ‘ওয়াইন’ শব্দটার অনুবাদে মদ বা মদানো আঙ্গুর-রস বলা হয়েছে। অথচ একই শব্দকে একই প্রসঙ্গে অন্যান্য স্থানে আঙ্গুর-রস বলা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালে প্রকাশিত বাচিপ (BACIB) পরিবেশিত কিতাবুল মোকাদ্দসে আবার অধিকাংশ মদকেই আঙ্গুর রস বানানো হয়েছে। তবে দু’-এক স্থানে তা মদই রয়ে গিয়েছে (যেমন মেসাল ৩১/৪)।
আবার অনেক স্থানে ওয়াইন শব্দটার অনুবাদ বাদ দিয়ে শুধু মাতাল বা মতলামি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে: (be not drunk with wine) “মাতাল হয়ো না..।” (ইফিষীয় ৫/১৮)। (Not given to wine, no striker): “তিনি যেন মাতাল বা বদমেজাজী না হন।” (১ তীমথিয় ৩/৩)। (not given to much wine) “তাঁরা যেন মাতাল না হন…”। (১ তীমথিয় ৩/৮)। (not given to wine, no striker): “মাতাল বা বদমেজাজী” (তীত ১/৭)। (not given to much wine): “মাতাল হওয়া তাঁদের উচিত নয়।” (তীত ২/৩)। (excess of wine): “মাতলামি করে।” (১ পিতর ৪/৩)
১. ৫. ৬. অনুবাদে বিকৃতির আরো কিছু নমুনা
প্রথম নমুনা: ‘গীতসংহিতা’ বা জবুর শরীফের ৮২/৬ কিং জেমস ভার্শন (King James Version: KJV) বা অথোরাইজড ভার্শন (Authorized Version: AV)-এ নিম্নরূপ: “I have said, Ye are gods; and all of you are children of the Most High”: “আমি বলেছি, তোমরা ঈশ্বর, এবং তোমাদের সকলেই শ্রেষ্ঠতমের সন্তান”। রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শন (Revised Standard Version: RSV)-এর ভাষ্য নিম্নরূপ: “I say, you are gods, sons of the Most High, all of you” : “আমি বলি, তোমরা ঈশ্বর, শ্রেষ্ঠতমের পুত্র, তোমরা সকলেই”।
কেরি: “আমি বলেছি, তোমরা ঈশ্বর, তোমরা সকলে পরাৎপরের সন্তান।” জুবিলী: “আমি বলেছি, তোমরা ঐশীজীব! তোমরা সবাই পরাৎপরের সন্তান।” পবিত্র বাইবেল ২০০০: “আমি বলেছিলাম, তোমরা যেন ঈশ্বর, তোমরা সবাই মহান ঈশ্বরের সন্তান।” কিতাবুল মোকাদ্দস ২০০৬: “আমি বলেছিলাম, তোমরা যেন আল্লাহ, তোমরা সবাই আল্লাহ তা’লার সন্তান।” কিতাবুল মোকাদ্দস ২০১৩: “আমিই বলেছি, তোমরা দেবতা, তোমরা সকলে সর্বশক্তিমানের সন্তান।”
মূল ইংরেজি পাঠ থেকে সুস্পষ্ট যে, এখানে মানুষদেরকে, সকল মানুষকে সুস্পষ্টভাবে ঈশ্বর ও ঈশ্বরের পুত্র বলা হয়েছে। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, বাইবেলীয় পরিভাষায় কাউকে ঈশ্বর বলা বা ঈশ্বরের পুত্র বলা দ্বারা কোনো দেবত্ব বা ঈশ্বরত্ব বুঝায় না; বরং ঈশ্বরের দাস ও সৃষ্টি বুঝায়। কেরির বাংলা অনুবাদ মূলাশ্রয়ী। তবে অন্যান্য অনুবাদে মানুষকে ঈশ্বর বলার বিষয়টা অস্পষ্ট করা হয়েছে। জুবিলী বাইবেল ও মুকাদ্দস-১৩ ‘ঐশীজীব’ ও ‘দেবতা’ শব্দ ব্যবহার করেছে। আর অন্য দুই অনুবাদে ‘যেন’ শব্দটা অতিরিক্ত সংযোজন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় নমুনা: বাইবেলের Proverbs নামের পুস্তকটার বাংলা নাম কেরি বাইবেলে ‘হিতোপদেশ’, জুবিলী বাইবেলে ‘প্রবচনমালা’ এবং কিতাবুল মোকাদ্দসে ‘মেসাল’। এ পুস্তকের ২৬ অধ্যায়ের ৪ ও ৫ শ্লোক নিম্নরূপ: “Answer not a fool according to his folly, lest thou also be like unto him. Answer a fool according to his folly, lest he be wise in his own conceit”: “মুর্খকে উত্তর দিও না তার মুর্খতা অনুসারে; পাছে তুমিও তার মতই হয়ে যাও। মুর্খকে উত্তর দাও তার মুর্খতা অনুসারে; পাছে সে তার অহমিকায় জ্ঞানী হয়।”
কেরির অনুবাদ: “(৪) হীনবুদ্ধিকে তাহার অজ্ঞানতা অনুসারে উত্তর দিও না, পাছে তুমিও তাহার সদৃশ হও। (৫) হীনবুদ্ধিকে তাহার অজ্ঞানতা অনুসারে উত্তর দেও, পাছে সে নিজের দৃষ্টিতে জ্ঞানবান হয়।” কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩ কেরির অনুরূপ।
জুবিলী বাইবেলের অনুবাদ: “নির্বোধকে তার মুর্খতা অনুসারে উত্তর দিয়ো না, পাছে তুমিও তার মত হও। নির্বোধকে তার মুর্খতা অনুসারেই উত্তর দাও, পাছে সে নিজেকে প্রজ্ঞাবান মনে করে।”
এর বিপরীতে পবিত্র বাইবেল ২০০০ এবং কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: “প্রয়োজন বোধে বিবেচনাহীনকে তার বোকামি অনুসারে জবাব দিয়ো না, জবাব দিলে তুমিও তার মত হয়ে যাবে। প্রয়োজন বোধে বিবেচনাহীনকে তার বোকামি অনুসারে জবাব দিয়ো, তা না হলে সে তার নিজের চোখে নিজেকে জ্ঞানী মনে করবে।”
এখানে ‘প্রয়োজন বোধে’ শব্দদুটো সংযোজন করা হয়েছে। বস্তুত বাইবেল সমালোচকরা এ দুটো শ্লোককে বাইবেলীয় বৈপরীত্যের সুস্পষ্ট নমুনা হিসেবে উল্লেখ করেন। কারণ, একই পুস্তকের একই অধ্যায়ের পাশাপাশি দুটো শ্লোকে সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী দুটো আদেশ দেওয়া হয়েছে: প্রথম আদেশ: নির্বোধকে তার নির্বুদ্ধিতা অনুসারে উত্তর দিয়ো না। দ্বিতীয় আদেশ: নির্বোধকে তার নির্বুদ্ধিতা অনুসারে উত্তর দাও।
খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা বিভিন্নভাবে এ বৈপরীত্যের উত্তর প্রদান করেছেন। কিন্তু কেউই পাক কিতাবের মধ্যে দুটো শব্দ সংযোজন করার সাহসিকতা দেখাননি। কিন্তু বাংলা কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদকরা সে সাহস দেখালেন। প্রাচীন কাল থেকে খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা এরূপ সংযোজনের সময় বন্ধনী ব্যবহার করতেন। বাংলা কিতাবুল মোকাদ্দসের সম্পাদকরা ‘প্রয়োজন বোধে’ দুটো শব্দ পবিত্র পুস্তকের মধ্যে সংযোজন করার জন্য এরূপ কোনো বন্ধনীরও ‘প্রয়োজন বোধ’ করেননি।
তৃতীয় নমুনা: মথি ৫/৩৯ KJV: “ye resist not evil…” (তোমরা দুষ্ট/পাপী/মন্দ/বদমাইশ লোককে প্রতিরোধ করো না) RSV: Do not resist one who is evil… (যে ব্যক্তি দুষ্ট/ মন্দ/ পাপী/ বদমাইশ তাকে তোমরা প্রতিরোধ করো না।) কেরি ও কিতাবুল মোকদ্দস-২০১৩: “তোমরা দুষ্টের প্রতিরোধ করিও না; (বরং যে কেউ তোমার দক্ষিণ গালে চড় মারে, অন্য গাল তাহার দিকে ফিরাইয়া দেও।)” জুবিলী বাইবেলের অনুবাদ: “দুর্জনকে প্রতিরোধ করো না…।”
এর বিপরীতে পবিত্র বাইবেল ২০০০ ও কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: “তোমাদের সংগে যে কেউ খারাপ ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে কিছুই করো না…”
পাঠক হয়ত বলবেন, অর্থ তো কাছাকাছিই! কিন্তু ধর্মগ্রন্থের মূল পাঠে কি লেখা আছে? “তোমাদের সংগে যে কেউ খারাপ ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে কিছুই করো না”? এ কথাটার ইংরেজি কী? পবিত্র গ্রন্থের মধ্যে এরূপ সংযোজন ও বিয়োজন কি অনুবাদের বিশ্বস্ততা ও ধর্মগ্রন্থের পবিত্রতা রক্ষা করে?
প্রকৃত বিষয় হল, যীশুর এ বাক্যটা অনেক সমালোচনা কুড়িয়েছে। দুষ্টকে প্রতিরোধ না করলে সমাজ টিকবে কি করে? সম্ভবত এজন্য অনুবাদকরা অর্থকে সহনীয় করার চেষ্টা করেছেন। তবে এতে পবিত্র পুস্তকের অর্থ বিকৃতি ছাড়া কোনো লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ এক্ষেত্রেও প্রশ্ন একই থাকে। আমাদের সন্তানদেরকে কি আমরা এটাই শিক্ষা দেব? তোমাদের কেউ মারলে, অত্যাচার করলে, ধর্ষণ করলে, পকেট মারলে…. তোমরা তার বিরুদ্ধে কিছুই বলবে না? বরং আরেকবার অপরাধটা করার সুযোগ দেবে?
চতুর্থ নমুনা: মথি ২৫/১৫ নিম্নরূপ: KJV: And unto one he gave five talents, to another two, and to another one; RSV: to one he gave five talents, to another two, and to another one…
কেরি এবং কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: “তিনি এক জনকে পাঁচ তালন্ত, অন্য জনকে দুই তালন্ত, এবং আর এক জনকে এক তালন্ত … দিলেন।”
জুবিলী বাইবেল: “একজনকে তিনি পাঁচশ’ মোহর, অন্যজনকে দু’শো মোহর, ও আর একজনকে একশ’ মোহর … দিলেন।”
পবিত্র বাইবেল ২০০০ ও কিতাবুল মোকাদ্দস: “তিনি একজনকে পাঁচহাজার, একজনকে দু’হাজার ও একজনকে এক হাজার টাকা দিলেন।”
আমরা জানি না, বাইবেল সোসাইটিগুলোর নিকট শত ও হাজার একই সংখ্যা কি না! তবে আমরা দেখছি যে, কেরির অনুবাদ মূলাশ্রয়ী। তালন্ত (talent) যেহেতু প্রাচীন মুদ্রা, সেহেতু টীকায় তা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তবে ‘এক তালন্ত’-কে ইচ্ছামত ‘এক শত টাকা’ বা ‘এক হাজার টাকা’ বলে অনুবাদ করা মোটেও গ্রহণযোগ্য অনুবাদ বলে গণ্য নয়।
পঞ্চম নমুনা: মার্ক ১৬/১৫: KJV: Go ye into all the world, and preach the gospel to every creature. RSV: Go into all the world and preach the gospel to the whole creation
উভয় ভার্শনের অর্থ এক। কেরি এবং কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: “তোমরা সমুদয় জগতে যাও, সমস্ত সৃষ্টির নিকটে সুসমাচার প্রচার/তবলিগ কর।” জুবিলী বাইবেলের অনুবাদ: “তোমরা বিশ্বজগতে বেরিয়ে পড়, সমস্ত সৃষ্টির কাছে সুসমাচার প্রচার কর।” কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬-এর অনুবাদ: “তোমরা দুনিয়ার সব জায়গায় যাও এবং সব লোকদের কাছে আল্লাহর দেওয়া সুসংবাদ তবলিগ কর।”
এখানে every creature/ the whole creation বা ‘প্রত্যেক সৃষ্টি/ সকল সৃষ্টি’ বাক্যাংশের অনুবাদ করা হয়েছে: ‘সব লোকদের’। এ অনুবাদের মাধ্যমে যীশুর মূল নির্দেশ পরিবর্তন করা হয়েছে। সৃষ্টি আর লোক এক নয়। সৃষ্টি অর্থ মানুষ ও অন্যান্য সকল সৃষ্টি। পক্ষান্তরে লোক বলতে মানুষ বুঝানো হয়। ইংরেজিতে সব লোকদের বুঝাতে ‘every man, every person/ all people’ ইত্যাদি বলা হবে।
বাহ্যত এ পরিবর্তনের বাহ্যিক কারণ বাইবেল সমালোচকদের তীর। তারা বলেন, যীশু সকল সৃষ্টির কাছে গসপেল বা ইঞ্জিল প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। আর সৃষ্টি বলতে মাছ, পাখি, সাপ, বিচ্ছু সবই বুঝায়। খ্রিষ্টান প্রচারকরা কখনোই এগুলোর কাছে ইঞ্জিল প্রচার করেন না! এ সমালোচনা থেকে বাঁচতেই সম্ভবত এরূপ বিকৃতি। গ্রহণযোগ্য ধর্মগ্রন্থের জন্য যীশুর নির্দেশকে অবিকৃতি রেখে ব্যাখ্যা করাই কি উত্তম ছিল না?
ষষ্ঠ নমুনা: ‘লূক’ ৯/২৮: KJV: And it came to pass about an eight days after these sayings, he took Peter and John and James, and went up into a mountain to pray. RSV: Now about eight days after these sayings, he took Peter and John and James, and went up on the mountain to pray.
কেরির অনুবাদ: এই সকল কথা বলিবার পরে, অনুমান আট দিন গত হইলে তিনি পিতর, যোহন ও যাকোবকে সঙ্গে লইয়া প্রার্থনা করিবার জন্য পর্বতে উঠিলেন।” জুবিলী বাইবেল ও কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩ সংস্করণের অনুবাদেও ‘আনুমানিক আট দিন’ বলা হয়েছে। কিন্তু পবিত্র বাইবেল ২০০০ ও কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬-এ (eight days)-এর অনুবাদে ‘এক সপ্তাহ’ বলা হয়েছে।
পবিত্র বাইবেল-২০০০: “এই সব কথা বলবার প্রায় এক সপ্তা পরে যীশু প্রার্থনা করবার জন্য পিতর, যোহন ও যাকোবকে নিয়ে একটা পাহাড়ে গেলেন।” কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: “এই সব কথা বলবার প্রায় এক সপ্তা পরে ঈসা মুনাজাত করবার জন্য পিতর, ইউহোন্না ও ইয়াকুবকে নিয়ে একটা পাহাড়ে গেলেন।”
আমরা জানি না, অনুবাদকদের কাছে এক সপ্তাহ এবং আট দিন একই কিনা অথবা তাদের সপ্তাহ আট দিনে হয় কি না! তবে মূল ভাষ্যের ‘৮ দিন’ কথাকে এভাবে ইচ্ছমত এক সপ্তা বানানো কখনোই গ্রহণযোগ্য অনুবাদ নয়।
সপ্তম নমুনা: লূক ১০/১৯:KJV: Behold, I give unto you power to tread on serpents and scorpions, and over all the power of the enemy: and nothing shall by any means hurt you. RSV: Behold, I have given you the authority to tread on serpents and scorpions and over all the power of the enemy: and nothing shall by hurt you.
পাঠক দেখছেন যে উভয় সংস্করণের অর্থ: “দেখ, আমি তোমাদেরকে সাপ ও বিচ্ছুর উপর দিয়ে হেঁটে যাবার ক্ষমতা দিয়েছি এবং শত্রুর সকল শক্তির উপরে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দিয়েছি। কোনো কিছুই কোনোভাবে তোমাদের ক্ষতি করবে না।”
কেরি: “দেখ, আমি তোমাদেরকে সর্প ও বৃশ্চিক পদতলে দলিত করিবার, এবং শত্রুর সমস্ত শক্তির উপর কর্তৃত্ব করিবার ক্ষমতা দিয়াছি। কিছুতেই কোনো মতে তোমাদের কোনো হানি করিবে না।” কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩ কেরির অনুরূপ।
পবিত্র বাইবেল ২০০০ ও কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: “আমি তোমাদেরকে সাপ ও বিছার উপর দিয়ে হেঁটে যাবার ক্ষমতা দিয়েছি এবং তোমাদের শত্রু শয়তানের সমস্ত শক্তির উপরেও ক্ষমতা দিয়েছি। কোনো কিছুই তোমাদের ক্ষতি করবে না।”
এখানে ‘শয়তান’ শব্দটা অনুবাদের মধ্যে সংযোজন করা হয়েছে যা এ শ্লোকের মূল পাঠে কোথাও নেই। এ শ্লোকটা নিয়ে অনেক আপত্তি বিদ্যমান। যীশুর প্রেরিতগণ ও শিষ্যরা কখনোই শত্রুদের উপর ক্ষমতা পাননি। ইহুদি ও রোমানরা তাদের ইচ্ছামত নির্যাতন ও হত্যা করেছেন। বাহ্যত এ আপত্তি থেকে বাঁচার জন্য এ শব্দকে সংযোজন করা হয়েছে। এভাবে পবিত্র পুস্তকের মধ্যে একটা শব্দ যোগ করা হয়েছে। অথচ পবিত্র পুস্তকের শেষ কথা: যদি কেউ পবিত্র পুস্তকের মধ্যে একটা শব্দও যোগ করে তবে পবিত্র পুস্তকের সকল অভিশাপ ও গযব তার জন্য যোগ করা হবে! আর এরূপ ‘অভিশপ্ত’ সংযোজন দ্বারা তাঁরা আপত্তি খণ্ডন করতে পারেননি। কারণ, যীশুর দেওয়া এ ক্ষমতা ১২ প্রেরিতের একজন ইস্করিয়োতীয় যিহূদার কোনোই উপকার করতে পারেনি। শয়তান তাকে পুরোপুরিই গ্রাস করে।
অষ্টম নমুনা: নতুন নিয়মের চতুর্থ পুস্তক যোহন বা ইউহোন্না। যোহন ১২/২৫ ইংরেজিতে নিম্নরূপ: KJV: “He that loveth his life shall lose it; and he that hateth his life in this world shall keep it unto life eternal”. RSV: “He wjp loves his life loses it; and he who hates his life in this world will keep it for eternal life.” উভয় ভার্শনেই অর্থ: “যে তার নিজ জীবন/ প্রাণ ভালবাসবে সে তা হারাবে; এবং যে এ জগতে তার নিজের জীবন ঘৃণা করবে সে অনন্ত জীবনের জন্য তা সংরক্ষণ করবে।”
কেরির অনুবাদ: “যে আপন প্রাণ ভালবাসে সে তাহা হারায়; আর যে এই জগতে আপন প্রাণ অপ্রিয় জ্ঞান করে, সে অনন্ত জীবনের জন্য তাহা রক্ষা করিবে।” কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩ কেরির অনুবাদের অনুরূপ।
পবিত্র বাইবেল-২০০০ এবং কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬ নিম্নরূপ: “যে নিজের প্রাণকে বেশী ভালবাসে সে তার সত্যিকারের জীবন হারায়, কিন্তু যে এই দুনিয়াতে তা করে না সে তার সত্যিকারের জীবন অনন্ত জীবনের জন্য রক্ষা করবে।”
আমরা দেখছি যে, কেরির অনুবাদ মূলানুগ। শুধু ‘হেট’ বা ঘৃণা করাকে ‘অপ্রিয় জ্ঞান করা’ লেখা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী অনুবাদ খুবই একেবারেই ভিন্ন অর্থবাহী। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে মূল অর্থ পরিবর্তন করে ‘বেশী’ শব্দটা যোগ করা হয়েছে। একইভাবে মূল বক্তব্য বিনষ্ট করে ‘সত্যিকারের জীবন’ শব্দদু’টো যোগ করা হয়েছে। আর হেট বা ঘৃণা করা শব্দটা বেমালুম চেপে যেয়ে ‘তা না করে’ বলা হয়েছে। ‘তা না করা’ অর্থাৎ কোনো কিছুকে ‘বেশি ভাল না বাসা’ কি ‘হেট’ বা ঘৃণা করার সমার্থক? বিশ্বের কোনো ভাষায় কি তা আছে? কোনো বিবেকবান মানুষ কি তা বলবেন? আমি আমার কোনো বন্ধুকে কম ভালবাসি- এর অর্থ কি আমি তাকে ঘৃণা করি?
কোনো ছাত্র যদি গ্রামার পরীক্ষায় এরূপ স্বাধীন বা স্বেচ্ছাচারী ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ অনুবাদ করে তবে শিক্ষক কিভাবে তার মূল্যায়ন করবেন? কোনো আর্থিক বা রাজনৈতিক ডকুমেন্টের এরূপ অনুবাদ করা হলে তা কি ‘অপরাধ’ বলে গণ্য করা হবে না? এরূপ বিকৃতির কারণ বুঝতে পারা পাঠকের জন্য হয়ত কঠিন হতে পারে। ইঞ্জিলের এ বক্তব্যটা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকদের প্রচুর সমালোচনা কুড়িয়েছে। কারণ নিজের জীবনকে ভালবাসা সহজাত মানবীয় প্রকৃতি। কাউকে বলা যায় যে, তুমি জীবনের চেয়ে দেশ, রাষ্ট্র, ধর্ম বা ঈশ্বরকে বেশি ভালবাসবে। কিন্তু এ কথা বলা যায় না যে, জীবনকে ভালবাসলেই তুমি চাকরি বা অনন্ত জীবন হারাবে। এজন্য যীশুর নামে কথিত বক্তব্যটা খুবই আপত্তিকর।
অন্যদিকে অনন্ত জীবন লাভ করতে জীবনকে ঘৃণা করতে হবে কথাটাও একই রকম অগ্রহণযোগ্য। কেউ যদি জীবনকে ঘৃণা-ই করে তবে তাকে অনন্তকালের জন্য রক্ষার চেষ্টা করবে কেন? জীবনের প্রতি প্রেমই তো তাকে তা অনন্তকালের জন্য রক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করে। জীবনের প্রতি ঘৃণা মানুষকে অসুস্থ ও অপ্রকৃতস্থ করে।[21]
বস্তুত যীশুর নামে ইঞ্জিলের মধ্যে লিখিত অনেক কথাই এধরনের প্রান্তিক। দ্বিতীয় শতাব্দীর খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী ও জ্ঞানবাদী বা ‘মারফতি’ (Gnostic) সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে এসব ‘প্রান্তিক’ আবেগী কথাগুলো খুবই বাজার পেত। সম্ভবত এগুলো যীশুর নামে বানানো কথা। সর্বাবস্থায় এগুলোর ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, কিন্তু মূল বক্তব্যের মধ্যে মানবীয় ব্যাখ্যা জুড়ে দিয়ে তাকে যীশুর বা ঈশ্বরের কথা বলে চালানো কি ধর্ম, মানবতা, বিবেক বা জাগতিক আইনে গ্রহণযোগ্য?
নবম নমুনা: রোমীয় ৩/৭: KJV: “For if the truth of God hath more abounded through my lie unto his glory; why yet am I also judged as a sinner?” (তার গৌরবের প্রতি আমার মিথ্যায় ঈশ্বরের সত্য যদি অধিকমাত্রায় উপচে পড়ে তবে আমি কেন পাপী বলে বিচারিত হই?)। RSV: But if through my false-hood God’s truthfulness abounds to his goory, why am I still being cindermned as a sinner? (যদি আমার মিথ্যাচারিতার মাধ্যমে ঈশ্বরের সত্যবাদিতা তাঁর মর্যাদায় উপচে পড়ে তবে এরপরও আমিও কেন পাপী বলে নিন্দিত হচ্ছি?)
কেরির অনুবাদ: “কিন্তু আমার মিথ্যায় যদি ঈশ্বরের সত্য তাঁহার গৌরবার্থে উপচিয়া পড়ে, তবে আমিও বা এখন পাপী বলিয়া আর বিচারিত হইতেছি কেন?”
কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: “কিন্তু আমার মিথ্যায় যদি আল্লাহর সত্য তাঁর গৌরবার্থে উপচে পড়ে, তবে আমিও বা এখন গুনাহগার বলে আর বিচারের সম্মুখীন হচ্ছি কেন?”
জুবিলী বাইবেল: “কিন্তু আমার মিথ্যাচারিতায় যদি ঈশ্বরের সত্যনিষ্ঠা তাঁর গৌরবার্থে উপচে পড়ে, তবে আমি কেনই বা এখনও পাপী বলে বিবেচিত হচ্ছি?”
পবিত্র বাইবেল ২০০০ এবং কিতাবুল মোকাদ্দস ২০০৬: “কেউ হয়ত বলবে, আমার মিথ্যা কথা বলবার দরুন আরও ভালভাবে প্রকাশ পায় যে, ঈশ্বর/ আল্লাহ সত্যবাদী। এতে যখন ঈশ্বর/ আল্লাহ গৌরব লাভ করেন তখন পাপী/ গুনাহগার বলে আমাকে দোষী করা হয় কেন?”
সম্মানিত পাঠক, আপনি দেখছেন যে, ‘কেউ হয়ত বলবে’ কথাটুকু এ শ্লোকের কোনো ইংরেজি পাঠে নেই, প্রথমে উদ্ধৃত বাংলা অনুবাদেও নেই।সর্বশেষ দুটো অনুবাদে ‘কেউ হয়ত বলবে’ কথাটুকু সংযোজন করে পুরো বক্তব্যের অর্থই পরিবর্তন করা হয়েছে।
মূলত সাধু পল তার বিভিন্ন পত্রে বারবার বলেছেন যে, তিনি বহুরূপী। ঈশ্বরের ধর্ম বিস্তারের স্বার্থে তিনি প্রত্যেকের মন জুগিয়ে ভিন্ন কথা বলেন বা মিথ্যা কথা বলেন (দেখুন ১ করিন্থীয় ৯/ ১৯-২২)। এ কথাটাই তিনি এখানে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। কিন্তু একটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বাক্যাংশ সংযোজন করে মূল কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলা হয়েছে। বাহ্যত তাঁর স্বস্বীকৃত মিথ্যাচার অস্পষ্ট করার জন্যই এরূপ করা হয়েছে।
দশম নমুনা: করিন্থীয়দের প্রতি প্রেরিত পলের ১ম পত্রের ১৫ অধ্যায়ে পল যীশু খ্রিষ্টের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর যে সকল শিষ্যের সাথে সাক্ষাৎ করেন তাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন। ১৫ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোকটা KJV ও RSV এবং সকল বাইবেলে: “And that he was seen of Cephas, then of the twelve”
কেরি ও কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: “আর তিনি কৈফাকে, পরে সেই বারো জনকে দেখা দিলেন।”
পবিত্র বাইবেলে ২০০০ এবং কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: “আর তিনি পিতরকে এবং পরে তাঁর প্রেরিতদের/ সাহাবীদের দেখা দিয়েছিলেন।”
প্রথম অনুবাদ মূলাশ্রয়ী। কিন্তু দ্বিতীয় অনুবাদে ‘the twelve’ বা ‘সেই বারোজন’ পরিবর্তন করে ‘প্রেরিতদের’ এবং ‘সাহাবীদের’ লেখা হয়েছে। এভাবে মূলের পরিবর্তন ছাড়াও অসাধু সম্পাদনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
এখানে সাধু পল ভুল করেছেন। যীশু মৃত্যু থেকে উঠার পরে যখন প্রেরিতদের সাথে সাক্ষাৎ করেন তখন ‘সেই বারো’ জনের একজন ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা মৃত্যু বরণ করেছিলেন। ফলে প্রেরিতদের সংখ্যা ছিল ১১ জন। এজন্য সাধু পলের কথাটা এখানে ভুল। এ ভুল দ্বারা প্রমাণ হয় যে, সাধু পল পবিত্র আত্মার সাহায্যে তাঁর পত্রগুলো লেখেননি। বরং সাধারণ একজন ধর্ম প্রচারক হিসেবেই লেখেছেন। এজন্য তাঁর ভুল হত। বাহ্যত এ ভুলটা লুকানোর জন্য মূলকে পরিবর্তন করা হয়েছে।
একাদশ নমুনা: করিন্থীয়দের প্রতি প্রেরিত পলের দ্বিতীয় পত্রের শেষে (১৩/১২) পল লেখেছেন: “Greet one another with an holy kiss: একে অপরকে সালাম জানাবে একটা পবিত্র চুমু দিয়ে।” কেরির অনুবাদ: “পবিত্র চুম্বনে পরস্পরকে মঙ্গলবাদ কর।” কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: “পবিত্র চুম্বনে পরস্পরকে সালাম জানাও।” কিন্তু পবিত্র বাইবেল ২০০০ এবং কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “মহব্বতের মনোভাব নিয়ে তোমরা একে অপরকে সালাম জানায়ো।”
সুপ্রিয় পাঠক, অনুবাদটা কেমন মনে হচ্ছে? পরীক্ষার খাতায় যদি কেউ লেখে যে, ‘holy kiss’-এর অর্থ ‘মহব্বতের মনোভাব’ তবে নিরপেক্ষ পরীক্ষক তাকে কেমন নম্বর দেবেন? কোনো মামলা-মোকদ্দমার কাগজে ‘kiss’-এর অনুবাদে মহব্বতের মনোভাব লেখলে কি বিচারক সঠিক বিচার করতে পারবেন? এ অনুবাদটা শুধু বিকৃতই নয়; উপরন্ত এতে ধর্মগ্রন্থের শিক্ষাকেও বিকৃত করা হয়েছে। ধর্মগ্রন্থ নির্দেশ দিচ্ছে ‘চুম্বন’-এর দ্বারা ‘সালাম’ দিতে। অথচ ‘কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬’ পাঠ করে কোনো খ্রিষ্টানই ঈশ্বরের এ পবিত্র নির্দেশ বুঝতে বা পালন করতে পারবেন না।
দ্বাদশ নমুনা: নতুন নিয়মের ঊনবিংশ পুস্তক ‘ইব্রীয়’। বিগত প্রায় দু’ হাজার বছর যাবৎ পত্রটা সাধু পলের লেখা বলে প্রচার করা হয়েছে। বর্তমানে বাইবেল সোসাইটিগুলো পত্রটা বেনামি ও অজ্ঞাতপরিচয় লেখকের লেখা বলে প্রচার করছেন। এ পত্রের ৬ অধ্যায়ের প্রথম শ্লোক কিং জেমস ভার্শন (KJV)-এ নিম্নরূপ: “Therefore leaving the principles of the doctrine of Christ, let us go on perfection” (অতএব, খ্রিষ্টের শিক্ষার মূলনীতিগুলো পরিত্যাগ করে আসুন আমরা পূর্ণতার দিকে গমন করি) রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শন (RSV) নিম্নরূপ: “Therefore let us leave the elementary doctrine of Christ and go on to maturity” (অতএব আসুন আমরা খ্রিষ্টের প্রাথমিক শিক্ষা পরিত্যাগ করি এবং পরিপক্কতার দিকে গমন করি)।
এখানে সাধু পলের (বা অজ্ঞাতপরিচয় লেখকের?) বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। তিনি বলছেন যে, খ্রিষ্টের শিক্ষা ছিল প্রাথমিক এবং সাধু পলের (বা অজ্ঞাত লেখকের?) শিক্ষা উন্নত স্তরের। কাজেই প্রাথমিককে পিছে রেখে উন্নত স্তরে এগিয়ে যেতে হবে।
সম্মানিত পাঠক যদি biblegateway.com ওয়েবসাইটে ইব্রীয় ৬/১-এর সকল ইংরেজি মিলিয়ে পড়েন তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হবেন। যদিও কোনো কোনো ইংরেজি অনুবাদে বিষয়টাকে কিছুটা অস্পষ্ট করা হয়েছে, অধিকাংশ অনুবাদেই বিষয়টা সুস্পষ্ট। যেমন এমপ্লিফাইড বাইবেল (Amplified Bible)-এর পাঠ নিম্নরূপ:
Therefore let us go on and get past the elementary stage in the teachings and doctrine of Christ (the Messiah), advancing steadily toward the completeness and perfection that belong to spiritual maturity. “অতএব, এস, আমরা খ্রিষ্টের নীতি ও শিক্ষার প্রাথমিক স্তর পিছনে রেখে চলে যাই, স্থিরভাবে এগিয়ে যাই পূর্ণতা ও উৎকর্ষতার দিকে, যা আধ্যাত্মিক পরিপক্কতার অন্তর্ভুক্ত।”
পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, যীশুর শিষ্যরা অনেকেই যীশুর শিক্ষা অনুসারে তৌরাতের শরীয়ত পালন করাকে গুরুত্ব দিতেন। পক্ষান্তরে সাধু পল শরীয়ত পালনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এজন্য শিষ্যরা অনেকেই পলের বিরোধিতা করেছেন। এ বিরোধিতাকে পাশ কাটাতে তিনি এখানে ‘ খ্রিষ্টান’ বা ‘খ্রিস্টীয় শিক্ষাকে’ প্রাথমিক ও পূর্ণতার পরিপন্থী এবং তাঁর নিজের পলীয় শিক্ষাকে পূর্ণতর বলে দাবি করেছেন। অর্থাৎ যীশু খ্রিষ্ট প্রাইমারি ও সাধু পল বিশ্ববিদ্যালয়!
কিন্তু বাংলা অনুবাদে বিষয়টা অস্পষ্ট। কেরির অনুবাদ: “অতএব আইস, আমরা খ্রিষ্ট বিষয়ক আদিম কথা পশ্চাতে ফেলিয়া সিদ্ধির চেষ্টায় অগ্রসর হই।” জুবিলী বাইবেলের অনুবাদ নিম্নরূপ: “সুতরাং এসো, খ্রিষ্ট বিষয়ক প্রাথমিক শিক্ষা পাশে রেখে আমরা সিদ্ধতার কথার দিকে এগিয়ে যাই।” পবিত্র বাইবেল ২০০০: “এইজন্য খ্রিষ্টের বিষয়ে প্রথমে যে শিক্ষা পেয়েছি, এস, তা ছাড়িয়ে আমরা পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাই।” কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: “এজন্য মসীহের বিষয়ে প্রথমে যে শিক্ষা পেয়েছি, এস, তা ছাড়িয়ে আমরা পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাই।” কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: “অতএব এসো, আমরা মসীহ বিষয়ক প্রাথমিক শিক্ষার কথা পিছনে ফেলে পরিপক্কতা লাভের চেষ্টায় অগ্রসর হই।”
যদিও সকল সম্পাদনার পরেও এ বক্তব্য নিশ্চিত করছে যে, যীশুর বিষয়ে প্রথমে যে শিক্ষা যীশুর প্রেরিতরা ও যীশুকে স্বচক্ষে দেখা শিষ্যরা প্রচার করেছিলেন সেগুলো পূর্ণতার পরিপন্থী, বাতিলযোগ্য ও পলীয় ধারার শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক।
বাইবেলের বঙ্গানুবাদে এরূপ হেরফের অগণিত। সবচেয়ে অবাক বিষয় যে, এরূপ বিকৃতি সবই ধার্মিক মানুষেরা করছেন, যারা পবিত্র বাইবেলকে অভ্রান্ত ঐশী বাণী বলে বিশ্বাস করেন। আর বাইবেলের মধ্যেই মিথ্যাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, মিথ্যাবাদীকে চির জাহান্নামী বলে উল্লেখ করা হয়েছে, বাইবেলের মধ্যে সামান্যতম সংযোজন বা বিয়োজন নিষেধ করা হয়েছে এবং কেউ এরূপ করলে তার জন্য ভয়ঙ্করতম অভিশাপ ও পরিণতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। (লেবীয় ১৯/১১; হিতোপদেশ ১২/২২, মথি ১২/৩১-৩২, প্রকাশিত বাক্য ২১/৮, ২২/১৮-১৯)
সর্বাবস্থায়, বঙ্গানুবাদের এ হেরফেরের কারণে আমরা বাইবেলের বাংলা উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে সাধারণভাবে কেরির অনুবাদের উপর নির্ভর করব। সহজবোধ্য হওয়ার জন্য কখনো কখনো পরবর্তী অনুবাদের উপরও নির্ভর করব। পাশাপাশি ইংরেজি অথোরাইজড ভার্শন/কিং জেমস ভার্শন (AV/KJV), রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্শন (RSV) ও অন্যান্য ইংরেজি অনুবাদের সহায়তা গ্রহণ করব।