দ্বাদশ সর্গ
ছিলো মজে জার্মানীতে সখীদের সাথে
দু-তনয়া; হেসেখেলে, গেয়ে আর ঘুরে
বসন্তের পাখি যেন, ইউরোপকুঞ্জে।
গেছেন হাসিনা তাঁর পুতুল ও জয়
দু-সন্তান নিয়ে স্বামী ওয়াজেদ আলী
মিয়ার কর্মস্থলে; সাথে তাঁর ছোট ভগ্নি
শেখ রেহানাও। হেথা ঘোরে, সেথা ঘোরে,
কি-অপূর্ব দেশ, যত দ্যাখে তত জাগে
দেখবার সাধ এর নিত্যনবরূপ!
ঐশ্বর্যে-বৈচিত্র্যে রেখেছে সাজিয়ে যেন
প্রতিটা শহর মহাসম্রাজ্ঞীর মতো।
ধনাঢ্য রূপসী রাজকন্যা প্রকৃতির
গোটা ইউরোপ যেন, অনন্ত যৌবনা;
কে না চায়, দেখে তারে জুড়ায় নয়ন!
মিললো দুদিনের ছুটি ওয়াজেদ মিয়ার;
চললেন সে-ছুটিতে সবাইকে নিয়ে
বেলজিয়ামের রাজধানী স্বর্গপুরী
ব্রাসেলসে; তারিখ চৌদ্দ আগস্ট। সোজা
উঠলেন গিয়ে বেলজিয়াম-রাষ্ট্রদূত
সানাউক হকের বাসায়। প্রেসিডেন্ট-
তনয়া ও জামাতার উপস্থিতি, যেন
হাতে পাওয়া চাঁদ, দিয়েছে বাড়িয়ে তাঁর
আভিজাত্য আরো। অভিভূত রাষ্ট্রদূত
জানালেন অভ্যর্থনা মহামর্যাদায়
রাষ্ট্রীয় অতিথিদের। দূতাবাসে কর্ম-
রত বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা-
কর্মচারী যত, রাষ্ট্রদূত হতে নিম্ন
পদমর্যাদার, এ দূর বিদেশভুয়ে
ব্যস্ত সকলেই নির্ভুল মনোরঞ্জনে
অভ্যাগতা রাজঅতিথির; যা-ই চায়,
চোখের পলকে চলে আসে; চায় না যা,
তাও এসে গড়াগড়ি খায় কন্যাদের
পায়ের তলায়। ভৃত্য যারা, ক্রীতদাস,
তারা চিরদিন চেয়ে থাকে শকুনের
মতো শ্যেন-চোখে মনিবের সন্তুষ্টির
দিকে; মনিবের তুষ্টি ছাড়া, তোষামোদি
ছাড়া বাঁচে না জগতে তারা একদিনও।
ছিলো ডুবে প্রেসিডেন্ট-তনয়ারা অথৈ
হর্ষোল্লাসে, মৎস্য যেন মহাসাগরের,
কাঁটছিল আনন্দসাঁতার দূর দেশে;
সাথে দুই পুষ্পশিশু, জয় ও পুতুল।
রাষ্ট্রদূত হকের কন্যারা প্রাণ খুলে
করছিল গল্পগুজব, কৌতুক, হাসি-
ঠাট্টা নবাগতা সখীদের সাথে, রাত্রি
জেগে জেগে। পনেরো আগস্ট মধ্যরাতে
রেহেনার অট্টহাসি ছড়ালো ঝংকার
সুপ্ত জনে জনে। তবু না বিরক্ত কেউ;
বরং জনাব হক বললেন হেসে:
“হাসারই বয়স; হাসবেই তো; হাসুক না!”
ভগ্নিপতি ওয়াজেদ মিয়া ছুটে এসে
ধমকালেন তাঁকে; বললেন ক্রুদ্ধস্বরে:
‘যত হাসি তত কান্না, মনে রেখো, মেয়ে।’
যত রাগে দোলাভাই তাঁর, তত যায়
হেসে গড়াগড়ি কন্যাগণে। হায়, তারা
জানতো যদি, কি-কঠিন দুঃসংবাদ
করছে অপেক্ষা, কি-দুর্দিন আসছে নেমে
জীবনে তাঁদের, কি-বৈরি বৈশাখি মেঘ
ভাগ্যের আকাশ তাঁদের ফেলেছে ঘিরে!
ফোন এলো ভোর বেলা। বাংলাদেশ থেকে।
তখনও ভাঙেনি কারো ঘুম। উঠে গিয়ে
রাষ্ট্রদূত ধরলেন রিসিভার: ‘এক
সেনা-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট
শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাস-
ভবনে নিহত, স্বপরিবারে।’ কাঁপছেন
শুনে তিনি ভয়ে। লাটিমের মতো যেন
ঘুরছে জগত। বুদ্ধি তাঁর নেমে যাচ্ছে
পারদের মতো নিচে। এখন উপায়?
দরজায় নক করে উঠালেন ডেকে
প্রেসিডেন্ট-জামাতাকে ঘুম থেকে। উঠে
এসে ওয়াজেদ আলী মিয়া শুনলেন
সব কথা। বাকরুদ্ধ তিনি দুঃসংবাদে।
অন্তরাত্মা তাঁর কেঁপে উঠলো ভয়ে-ত্রাসে:
‘হায়, খোদা! কী শোনালে এ কুক্ষণে তুমি!’
পড়লো আকাশ যেন ধসে, আচমকা
বসন্ত-কাননে; যেন বৃষ্টিহীন, মেঘ-
হীন, খর-রৌদ্রে নিদারুণ বজ্রপাত
হর্ষে হেঁটে চলা দূরগামী পথিকের
মাথার উপর; যেন সমুদ্রসৈকতে
ঝিনুক কুড়াতে কুড়াতে উচ্ছল হর্ষ-
শিশু, বেখেয়ালে, ডেবে গেল চোরা-
বালির হাঁ-এর ভেতর, ভাগ্যের দোষে;
হায়, প্রভু; কী শোনালে এ কুক্ষণে তুমি!
অবশ শরীর; নিশ্চল হাত-পা; যেন
ভারী পাথরের পা ফেলে, কি-কষ্টে তবু
ওয়াজেদ মিয়া বসলেন গিয়ে পাশে
সুপ্ত স্ত্রীর; পাশে তাঁর ঘুমায় শান্তিতে,
স্বর্গ থেকে নেমে আসা দুই স্বর্ণশিশু;
ফিরালেন চোখ তিনি দয়িতার দিকে-
কুসুমের মতো শুয়ে আছে কি-সুন্দর
যেন স্বর্গের অপ্সরী, পিতৃ-অন্ত প্রাণ,
পিতা-বঙ্গবন্ধু ছাড়া বোঝে না যে কিছু,
পুত্রের অধিক যে তাঁর জগদ্বিখ্যাত
পিতার নিকট; ‘হায়, হাসু, প্রিয়ংবদী,
জীবনসঙ্গিনী হে আমার, কোন্ প্রাণে
কবো এই কথা তোমাকে হে!’ বসে বসে
ভাবছেন তিনি; দুই চক্ষু বেয়ে তাঁর
দরদর করে ঝরছে অশ্রুজল; তার
কয় ফোঁটা পড়লে পুষ্পিত মুখে, ধড়-
ফড় করে উঠলেন যেন জেগে এক
ভয়ার্ত হরিণী; স্বামীর দুহাত ধরে
বললেন: ”হায়! কী হয়েছে! কী ব্যাপার!
কেন কাঁদো এইভাবে? খুলে কও সব।”
মুছলেন ত্রস্ত হাতে দুচোখের পানি;
পরমাণূ বিজ্ঞানী সে, শক্তি নিয়ে যাঁর
রাত্রিদিন গবেষণা; মানায় কি তাঁর
মেয়েলি ক্রন্দন? টানটান হয়ে তিনি
বললেন কম্পমান কণ্ঠে: “রেহেনাকে
ডাকো। গ-গোল প্রচ-, ঢাকায় । গুলি
ছুঁড়েছে সৈন্যরা বত্রিশ নম্বরে। আব্বা-
আম্মা-ওরা সব কেমন আছেন, কেউ
বলতে পারছে না।” “কী বলছো এসব!”
বলে ফুঁপিয়ে উঠলো যেন আষাঢ়ের
মেঘ, ঝরঝর: ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে
উঠালেন তিনি রেহেনাকে। দুই ভগ্নি
দুজনকে বুকে বেঁধে, ফুঁপিয়ে ফুুঁপিয়ে
কাঁদলেন কিছুক্ষণ, কিছু না বুঝেই।
কী ঘটেছে, কী হয়েছে-জানে না এখনো
তাঁরা; জানে না কী কারবালা ঘটিয়েছে
সীমারেরা বাংলার মসনদে। ও-দুখিনী
অনাথ মেয়েরা বাংলার, কে মোছাবে
তোমাদের আঁখিজল, যখন শ্রাবণ
বেঁধেছে অনন্ত বাসা তোমাদের চোখে?
কাঁদো, নারী, কাঁদো, যদি কেঁদে সুখ হয়,
যদি জুড়ায় হৃদয় কেঁদে বেইমান-
অকৃতজ্ঞ এই মীর জাফরের দেশে!
“কেঁদো না, কেঁদো না” বলে ওয়াজেদ মিয়া
লাগলো সান্ত¡না দিতে, প্রিয় জনে। “কেউ
যায়নি তো মারা?” বলে প্রেয়সী হাসিনা
চেয়ে রয় কি-করুণ দুর্বোধ্য স্বামীর
মুখের দিকে, অচেনা যেন কত এই
মুখ! বললেন: “এক্ষুণি বলবো কথা
বাবা-মার সাথে।” ওয়াজেদ মিয়া তার
প্রত্যুত্তরে খোঁজেন বাহানা কত, তাঁকে
ভোলাবার; ছোট ছোট মিথ্যা দিয়ে ঢেকে
রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তাঁর ভয়াবহ
প্রাণঘাতী কঠিন সত্যকে: “ঢুকছে না
ফোন, হাসু। ধৈর্য ধরো। আস্তে আস্তে যাবে
জানা সব কথা। হয়ো না অস্থির মোটে।”
অস্থিরতা ততই যাচ্ছে যে বেড়ে! হায়,
ভাবেন রেহেনা, গত রাত্রির আমারই
অট্টহাসি যত অকল্যাণের মূল? কেন
চেয়ে আছে এইভাবে দোলাভাই তাঁর
দিকে? কেন এ বাড়ির লোকজন এত
পর পর, অচেনা ভীষণ, মনে হচ্ছে
হঠাৎ এভাবে? “হায়, আপু, কী হয়েছে,
রেখো না লুকিয়ে কিছু, খুলে বলো!” বলে
লুকায়ে ভগ্নির বুকে মুখ, হাউমাউ
করে কাঁদতে লাগলো অনাথ বালিকা
বাংলার, দূর দেশে। ভগ্নি তাঁর “চুপ
র্ক” বলে তাকালেন ফের ওয়াজেদ
মিয়ার দিকে: “কী হলো, ফোন করো, খোঁজ
নাও।” ধীর পদক্ষেপে, যেন জ্যান্ত লাশ,
গেলেন বাংলার ধীমান জামাতা উঠে
রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের নিকট।
গিয়ে শুনলেন তাঁর চাপা হট টক
টেলিফোনে, জার্মানীর বাংলাদেশের
রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর
সাথে: “কি-উটকো ঝামেলা দেখুন! সব
আপদ এ দুঃসময়ে চেপে বসে আছে
আমার উপর। আপনি তো নির্ঝঞ্ঝাট-”
লজ্জায় ও অপমানে হয়ে উঠলো লাল
ওয়াজেদ মিয়ার বিষণ্ন মুখ: ‘হায়,
কী কয় চামচিকা! বঙ্গবন্ধু-তনয়ারা
রাষ্ট্রের আপদ? পঙ্কে নিপতিত যেন
বিশাল হস্তিনী, পা দেখায় মূর্খ ভেক
তাকে, সক্রোধে।’ জামাতা তিনি, প্রেসিডেন্ট
শেখ মুজিবের; কী সাহসে এ নির্বোধ
উচ্চারণ করে মুখে হেন ভাষা, তাঁর
সম্মুখে! পেলেন গন্ধ তিনি সুগভীর
ষড়যন্ত্রের, চারদিকে। এক্ষুণি বেরুতে
হবে তাঁকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে, দূরে কোথা,
এ নিবাস থেকে; যেভাবে পালিয়েছিল
লুৎফাকে নিয়ে পরাস্ত সিরাজ। তিনি
লুকিয়ে মনের ক্ষোভ মনে, বললেন
বিনয়ের সাথে: “লাইন দেবেন না কেটে;
দিন হুমায়ুন সাহেবের সাথে কথা
বলি।” বড়ই বিব্রত রাষ্ট্রদূত হক;
অগত্যা দিলেন তুলে ফোন তাঁর হাতে;
দিয়েই গেলেন ঢুকে ঘরে তস্করের
মতো; বিদূষী স্ত্রী তার, দিলেন ধিক্কার
মহারোষে: “অমানুষ তুমি! কথা কও
এইভাবে বিপদের দিনে কোন্ মুখে?”
উঠলো অস্ফুটস্বরে ফুঁসে রাষ্ট্রদূত,
যেন জাতসাপ: “বুঝো না আমার চেয়ে
বেশি; বঙ্গবন্ধু ঝাড়ে-বংশে শেষ; কার
ধড়ে মাথা ক’টা, ঠাঁই দেয় বেঁচে যাওয়া
তাঁর তনয়াকে!” ওদিকে আরেক ঘরে
তাঁরই কন্যাগণ কেঁদে জারজার, হায়,
সখীদের দুঃখে! এরকমই বুঝি হয়
নিয়তির খেলা, যাদের কল্যাণকথা
ভেবে ব্যতিব্যস্ত সারাক্ষণ, শত্রু ভেবে
ছোঁড়ে তারা নির্দয়ের মতো তীক্ষ্ন বাক্য-
বাণ! ‘হায়, যার জন্যে করি চুরি,সেই কয়
চোর!’ ভাবেন উন্মনা হয়ে তিনি। চলে
গেলে ওয়াজেদ আলী মিয়া, উঠলো বেজে
ফের ফোন। রাষ্ট্রদূত সানাউল হক
ছুটে এসে করলেন রিসিভ। জানালেন
জার্মানীর রাষ্ট্রদূত তাকে: পাঠাচ্ছেন
গাড়ি তিনি ব্রাসেলস আর জার্মানীর
বর্ডারে; ব্যবস্থা নেন যেন তিনি দ্রুত
বর্ডার পর্যন্ত তাঁদেরকে পাঠানোর।
‘হা-পরমেশ্বর! কী-বাঁচা বাঁচালে তুমি!’
এই বলে জানালো সে মনোতুষ্টি; পরে
দিলো সে ধিক্কার চাপাস্বরে: “বাকশাল
ও রক্ষিবাহিনী নিয়ে মেতেছিলে বড়;
হয়েছে পতন ঠিকই আপনারই দোষে !’
বলে সে হাসলো দাঁতে দাঁতে শেয়াল ও
শকুনের হাসি, যেভাবে মীর জাফর-
ঘসেটি বেগম-রাজ বল্লভ-জগৎ
শেঠরা সানন্দে হেসেছিল প্রাণখুলে
সতেরো শ সাতান্নোয় বাংলার নবাব
সিরাজ উদ দৌলার করুণ মৃত্যুতে।
কি-বিচিত্র এই বঙ্গদেশ আর তার
মানুষেরা! চোখের পানিতে ভেসে ভেসে
মুজিবদুলালী শেখ হাসিনা ভাবতে
লাগলেন এক মনে। পাশে ভগ্নি কাঁদে;
মা-খালার কান্না দেখে, কাঁদে জয়; কাঁদে
অবুঝ পুতুলও পিতৃকোলে; কেবল হে
পাষ- সীমার, কাঁদলো না তোর মন;
কাঁপলো না হৃৎপি- তোর একবারও!
উঠলেন জার্মানীতে এসে অবশেষে
মুজিবকন্যারা। সাক্ষাৎ-ফেরেস্তা যেন
রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।
তটস্থ সারাক্ষণ মুজিবকন্যাদের
আদরআপ্যায়ণ ও নিরাপত্তা নিয়ে।
যাবে চাকরি? যাক। কী হবে চাকরি দিয়ে
যখন ঘাতক ছুড়েছে বুলেট প্রিয়
পিতার পিঞ্জরে! যাবে প্রাণ? যাক না হে!
কী হবে জীবন দিয়ে, যখন জাতির
জনক নিহত বাংলায়, যখন ঘৃণ্য
শকুনের হাতে আজ প্রাণের পতাকা,
লাল-সবুজ যে-পতাকার জন্যে ত্রিশ লক্ষ
বাঙালী দিয়েছে প্রাণ, দিয়েছে ইজ্জত
মাতাভগ্নি দুই লক্ষ। জনাব চৌধুরী
বললেন দৃঢ় কণ্ঠে: “আমার এখানে
থাকুন নিশ্চিন্তে; পাবেন না কোনো ভয়।”
মহীয়সী পত্নী তাঁর, শোনাতে লাগলো
অভয়বাণী। কেন এ অভয়? আসলে
কী ঘটেছে বত্রিশ নম্বরে? জানেন না
এখনো তা হাসিনা-রেহেনা বিস্তারিত।
খুললেন মুখ অবশেষে প্রিয় নেতা
শেখ মুজিবের মন্দাদৃষ্টা দু-কন্যার
উপর্যুপরি পীড়াপীড়িতে রাষ্টদূত
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী: “যা বাস্তব,
হবেই তা মেনে নিতে, আজ কিংবা কাল;
লাভ নেই লুকিয়ে সত্যকে, হবেই তা
প্রকাশিত একদিন না একদিন; হে
বঙ্গবন্ধু-তনয়ারা, ” কাঁপতে লাগলো
কণ্ঠ তাঁর বলতে গিয়ে, “তাহলে শুনুন,
বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই, করেছে সৈন্যরা
হত্যা তাঁকে ভোর রাতে।” “বেঁচে নেই?” বলে
গেলেন রেহেনা মুর্ছা হাসিনার কোলে।
হুমায়ুন-পত্নী তাঁকে পাঁজাকোলা করে
শোয়ালেন বেডে; ব্যস্ত হয়ে গেল সব
জ্ঞান ফেরানোর জন্যে তাঁর। ওয়াজেদ
মিয়া ধরে আছেন পত্নীকে শক্ত হাতে;
পত্নী তাঁর বাকরুদ্ধ হয়ে, দিয়েছেন
ছেড়ে অশ্রুজল, যেন পদ্মানদী তাঁর
অবাক দুচোখে হঠাৎ গিয়েছে মিশে;
পুতুল ও জয় ভয়ে, ধরে জননীর
গলা, জুড়ে দেছে কান্না উচ্চৈঃস্বরে। কে সে
পাষাণ, না কেঁদে পারে এই ক্ষণে! কাঁদে
ওয়াজেদ মিয়া, কাঁদে রাষ্ট্রদূত, কাঁদে
এ বাড়ির সব লোক একসাথে। হায়,
দেশ, মাতা বঙ্গ, তোমার চোখের পানি
শুকাবে না আর কোনোদিন; কেঁদে কেঁদে
যাবে যে তোমার প্রাণ, কারণ তোমার
শ্রেষ্ঠ যে-সন্তান সহস্র বছরে, তাঁকে
ফেলেছে যে হত্যা করে জারজ সীমার!
বিষণ্ন বদনে চেয়ে আছে সকলেই
শেখ মুজিবের শোকার্ত দুলালী শেখ
হাসিনার অশ্রু টলোমলো চোখে, যেন
তিনি অশ্রু-সরোবরে করুণ নয়নে
চেয়ে থাকা কোনো দুঃখকমল। মুখ
খুললেন তিনি অবশেষে এই বলে,
বিস্ময়ে: “এও কি সম্ভব! গুজব বোধ-
হয় ছড়িয়েছে বিরোধীরা।” বললেন
চৌধুরী: “আমরা খোঁজ নেবো তারও।” বলে
চললেন মুজিবতনায়া, যেন তিনি
শুনতে পাননি কিছু কিংবা শুনছেন না
কারো কথা: “বাঙালী কী করে পারে হত্যা
করতে আমার পিতাকে? পাকিস্তনীরাও
করেনি সাহস ছুঁড়তে বুলেট যাঁর
বুকে-!” বললেন ওয়াজেদ মিয়া, “পারে,
হাসু, পারে। রয়েছে যে মীর জাফরের
প্রেতাত্মারা ঘাপটি মেরে আজও শান্তিপ্রিয়
বাঙালীর মাঝে; সতের শ সাতান্নোয়
ওরা ছিলো, আজও আছে এবং থাকবে
চিরদিন।” হুতাশন যেন, উঠলেন
জ্বলে পত্নী তাঁর: “কোথায় সে মীরজাফর,
আমি আট কোটি বাঙালীকে সাথে নিয়ে
করবো মূলোৎপাটন তার, বাংলার
বুক থেকে। মিঃ এ্যামবাসাডার, আপনি
কালই ব্যবস্থা নিন আমাকে ঢাকাতে
পাঠানোর। কী ঘটেছে ঢাকায়, সচক্ষে
দেখতে চাই আমি।” বললেন হুমায়ুন
রশীদ চৌধুরী, “হে বঙ্গবন্ধু তনয়া,
শান্ত হোন। কিভাবে ঢাকায় ফিরবেন
আপনি-এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার
করেছে আপনাদের স্বদেশে ফেরার
ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি। আপাতত দেশে
ঢুকতে পারবেন না আপনারা, দু-বোনের
কেউ। ” “ঢুকতে পারবো না আমাদের দেশে
আমরা? শেখ মুজিবের বাংলায়? বলুন
কে সে সরকার, কার এত স্পর্ধা, রাখে
আটকে বৈদেশে বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে?
কন, প্রেসিডেন্ট নন আমার জনক?”
“ছিলেন। এখন মৃত।” “মৃত? আজ দেশে
কে তবে রাষ্ট্রপ্রধান?” “তিনি মহামান্য
প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক।” “ কে সে?
খন্দকার মোশতাক? পিতার কাছের
মানুষ- বাণিজ্য মন্ত্রী?” “কাছের মানুষ
বটে, কিন্তু ছিলেন না বিশ্বস্ত ” উঠলেন
বলে ওয়াজেদ আলী মিয়া, “জানি, তাঁকে
বাবাও কখনো করতেন না পছন্দ।
যুগে যুগে মার্কাস ব্রুটাস বন্ধুবেশে
করেছে হামলা জুলিয়াস সিজারের
’পরে মোক্ষম সময়ে। মনে করে দ্যাখো,
খোকাচাচা একবার মোশতাকের জন্যে
এসেছিল সুপারিশ নিয়ে; বাবা তাকে
বলেছিলেন, ‘রে খোকা, এসেছিস তুই
কার জন্যে? কখনো পশ্চাৎ থেকে কেউ
করে যদি ছুরিকাঘাত আমাকে, মনে
রাখিস, তাহলে করবে তা মোশতাক।’
এই সেই মোশতাক, রটিয়ে কুৎসা
তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে, বাবার কাছ
থেকে তাঁকে করেছিল বিচ্ছিন্ন; উদ্দেশ্য,
প্রকৃত বন্ধুরা যাতে ভিড়তে না পারে
তাঁর কাছে। আজ সব হয়ে যাচ্ছে স্পষ্ট।”
চোখ দুটো যেন জলে ডোবা পদ্মফুল;
সেই চোখে ভেসে উঠছে কত স্মৃতি এই
খন্দকার মোশতাকের, আঁঠার মতোই
থাকতো যে লেগে সারাক্ষণ তাঁর পিতা
প্রেসিডেন্ট-মুজিবের সাথে সাথে। হায়,
এই কি সেই মোশতাক, যার রুগ্ন স্ত্রীর
সেবাশুশ্রুষার সমস্ত দায়দায়িত্ব
তুলে নিয়েছিলেন মা কাঁধে, যখন সে
কারাগারে বন্দী, স্বাধীনতার আগে? হায়,
এই কি সেই মোশতাক, যে কিনা মাটিতে
গড়াগড়ি খেয়ে করেছিল কান্নাকাটি
দাদীর মৃত্যুর পর? শোকে মুহ্যমান
বাড়ির সবাই, দাদীর মৃত্যুতে; কিন্তু
যে রক্তের কেউ নয়, সেই কিনা শোকে
গড়াগড়ি খাচ্ছে ধুলোয়! তবে কি স্রেফ
অভিনয়ই ছিলো এইসব?-“বেইমান!”
বলে, উঠলেন কেঁদে মুজিবদুলালী:
“সব বেইমান! সব বিশ্বাসঘাতক!
কিন্তু এই আমি, জগত-বিখ্যাত পিতা
স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবের কন্যা আল্লার ইচ্ছায়
বেঁচে আছি পৃথিবীতে; আমার সন্তান
জয় ও পুতুলের কসম, জন্মদাতা
পিতার কসম, মায়ের কসম আর
আমার প্রাণের ভাই জামাল-কামাল-
রাসেলের কসম, কাউকে ছাড়বো না
আমি, কাউকেই ছাড়বো না; সব
ঘাতকেরই কল্লা আমি ছিঁড়ে নেবো এই
হাতে; প্রতিটা মৃত্যুর নিখুঁত হিসেব
বুঝে নেবো ঠিকই কড়ায় গ-ায়, পাই-
পাই করে; ঘাতক সে যেই হোক, টুটি
তার ছিঁড়ে ফেলবোই!” অতঃপর তিনি
জুড়লেন আর্তনাদ জননীর নামে:
“ও মাগো, আমাকে কেন পাঠালে বৈদেশে?
তুমি বুঝি অনেক আগেই পেয়েছিলে
টের, সবাইকে মেরে ফেলবে ওরা, বাঁচতে
দেবে না কাউকে? তাই বুঝি পুত্রদের
কাছে রেখে, আমাকে ও রেহেনাকে,
কন্যা বলে, ঠেলে দিলে দেশের বাইরে,
বাঁচতে তোমাদের ছাড়া? হয়তো সবার
চেয়ে বেসেছিলে ভালো; তাই আমাদের
চাওনি মরতে দিতে! ও মা, মাতৃহীন-
পিতৃহীন আজ দুই এতিম সন্তান
দেখে যাও পৃথিবীতে কি-শান্তিতে আছে!
তুমি দেখে যাও, পিতা, তোমার স্নেহের
দুলালীরা আজ হঠাৎ শেওলা হয়ে
ভাসতেছে কিভাবে ভাগ্যের দরিয়ায়,
জগতে যাদের খোদা ছাড়া কেউ নেই।”
মুজিবদুলালী হাসিনার এ-রোদনে
পড়ে গেল আহাজারি সারা বাড়ি। কেউ
কাঁদে উচ্চৈঃস্বরে, কেউ চাপড়ায় বুক,
যেন কারবালায় ফের ইমাম হোসেন
হয়েছেন খুন, স্বজনেরা তাঁর ‘হায়,
খোদা! হায় খোদা!’ বলে করছে ক্রন্দন;
যেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব
সিরাজউদ্দৌলা ফের হয়েছে শহীদ
মহম্মদ আলী বেগের ক্রুর ছুরির
আঘাতে, লুৎফা বেগম তার কন্যাকে
বুকে নিয়ে জুড়েছে ক্রন্দন হা-হা রবে
বাংলার বাতাসে। সে-ক্রন্দনে থরথর
কাঁপছে আকাশ, কাঁপছে জগতময়
কোটি মানুষের আহত বিবেক; আর
মেঘনা-যমুনা-পদ্মা ও মধুমতীর
মিষ্টি পানি হঠাৎ রক্তিম হয়ে, স্থির
হয়ে গেল, পেলো না কখনো আর যারা
ফিরে খরস্রোত, প্রিয় মুজিবের শোকে।
মুজিবনামা মহাকাব্যের ‘মহাশোক পর্ব’; নাম ‘দ্বাদশ সর্গ’।
—–সমাপ্ত——