দ্বিতীয় সর্গ
বীরদর্পে ফিরলেন তিনি, দীপ্ত মুখ
ও স্ফীত হৃদয়, বাসা বত্রিশ নম্বরে।
কন্যা তাঁর, সদ্য ফোটা স্বর্ণের কমল
যেন, পিতার বিশাল বক্ষে খুঁজে নিলো
স্নেহের নিলয়। ‘হাসু’ বলে বোলালেন
স্নেহসিক্ত হাত কন্যার সৌভাগ্যশিরে:
“জানি, মাগো, তোমাদের সদাব্যস্ত পিতা
তোমাদের ছেড়ে, ঘোরে শুধু পথে পথে
কিংবা কাটায় কাল অন্ধ কারাগারে;
তোমরা প্রত্যহ তীর্থের কাকের মতো
চেয়ে থাকো পথ- কখন ফিরবো আমি।
আমি ফিরি, তোমাদের ছেড়ে পালানোর
জন্যে ফের। ফিরে যাই। কী খাও তোমরা,
কী পরো, কিভাবে কাটে তোমাদের দিন-
আমি তার, হায়, রাখতে পারিনে খোঁজ।
এইভাবে অবহেলা আর অনাদরে
বড় হয়ে গেলে সব। লিডারের মেয়ে
হওয়া বড়ই কষ্টের, মাগো-আমি বুঝি।”
কন্যা তাঁর, প্রত্যুত্তরে, কইলো সুকণ্ঠে:
“আপনি বঙ্গের বন্ধু; বাংলার মানুষ
আপনাকে ভালবাসে প্রাণের অধিক;
আমাদের সুখ তাতে। আমাদের কথা
ভেবে, হবেন না বিচলিত মিছামিছি।”
ধীর পায়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা
দাঁড়ালেন এসে পাশে। পিতা-দুহিতার
কথার মাঝখানে পড়লেন তিনি ঢুকে:
“দিয়েছি স্বাধীন করে বিহঙ্গের মতো;
তাই তো আপনি আজ বঙ্গবন্ধু বঙ্গে;
যাবেন না কোনোদিন ভুলে এই কথা।”
বললেন তদুত্তরে বঙ্গবন্ধু: “ঠিকই,
দিয়েছো স্বাধীন করে, তাই রাত্রিদিন
বাংলার পথে পথে খুঁজে ফিরি আমি
বাংলার মানুষের হৃত স্বাধীনতা।”
“কথা কন মার সাথে। নিয়ে আসি এই
ফাঁকে দুধটা গরম করে।” এই বলে
সূর্যকন্যা তাঁর ছুটে গেল, যেন ঝড়।
আনন্দের সেই ঝড় বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে
দেখে নিয়ে একবার, বলে উঠলেন
সাত কোটি বাঙালীর নেতা হাসিমুখে:
“বুঝলে হে হাসুর মা; পারবে না আর
দমিয়ে রাখতে ওরা কোনোমতে; সারা
দেশে উঠেছে বাঙালী আজ জেগে; হাড়ে-
হাড়ে পেয়েছে সবাই টের-ভাই নয়,
শত্রু ওরা আমাদের, প্রাণের ঘাতক।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত আর মার খাবো!
মেধাবী শিক্ষক শহীদ শামসুজ্জোহা
ও সার্জেন্ট জহুরুল হকের রক্তাক্ত
আত্মা দেয় না যে ঘুমাতে আমাকে; শুধু
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কি-করুণ
আমারই মুখের দিকে, আর ডেকে বলে:
‘মুজিব, এ রক্ত যায় না বিফলে যেন।’
পারি না বিফলে যেতে দিতে শহীদের
রক্ত কিছুতেই এ-বাংলায়। শুনে রাখো,
আসন্ন ভোটের যুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানে
গো-হারা হারাবো ওদেরকে। এইবার
আমার বাঙালী আর ভুল করবে না।”
“তাই যেন হয়!” ছাড়লেন দীর্ঘশ্বাস
বঙ্গমাতা বেগম মুজিব: “ওদিকে যে
মাওলানা ভাসানী ঘোষণা দিলেন, তিনি
যাবেন না ভোটযুদ্ধে; আগে চাই খাদ্য,
তারপর ভোট। কিছুই বুঝি না, বাপু।
রাজনীতি বড় জটিল জায়গা! বোঝা
দায়, কে কখন, হায়, ছুঁড়ে মারে ঢিল
কোন্ চাকে।” “ও নিয়ে ভেবো না, রেনু।
কে ঠিক, কে ভুল, সময়ই তা বলে দেবে।
আগরতলার ষড়যন্ত্র নামে মিথ্যা-
মামলায় আমাকে ফাঁসাতে চাইলো ওরা।
এবং আমার ছয় দফা নিয়ে প্রশ্ন
তোলা হলো; বলা হলো, আমি দেশদ্রোহী।
কে বলো আমার অধিক বেসেছে ভালো
এ-বাংলাকে? আমি বাংলার প্রতি ইঞ্চি
জমিনকে চিনি; এ-বাংলার সমস্ত
নারী-পুরুষের মুখ যে আমার চেনা;
বেইমানি করতে পারে না শেখ মুজিব
বাংলার এ-মাটি আর মানুষের সাথে।”
“তা-ই তো চেয়েছি আমি সমস্ত জীবন।
চাইনি কখনো দুগ্ধশুভ্র আপনার
ব্যক্তিত্বের ’পর পড়ুক কালির দাগ
এক চুলও। সাত কোটি বাঙালীর নেতা
আপনি, সুপ্রিয়; যায় না খরিদ করা
অর্থ-বিত্ত দিয়ে এ প্রিয়তা এ জগতে;
এই পরিচয় আপনার, আমি চাই,
অক্ষুণ্ণ থাকুক চিরদিন বঙ্গদেশে।
আপনি তখন জেলে। আগরতলার
ষড়যন্ত্র মামলায় পঁয়ত্রিশ জন
অভিযুক্ত। চলছে বিচার। কারাগারে
গিয়ে শুনতে পেলাম প্যারোলে মুক্তি দিয়ে
নিয়ে যেতে চায় সরকার আপনাকে
জরুরি বৈঠকে। বুঝলাম, এ আরেক
ষড়যন্ত্র। আপনার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব
ও রাজনৈতিক সত্তা ওরা দিতে চায়
শেষ করে। শেষ ষড়যন্ত্রজাল এটা।
আমার কেমন ভয় ভয় করছিল;
শুধু মনে হচ্ছিল, আপনি বোধহয়
পড়েই যাবেন পা পিছলে এইবার!
হঠাৎ কী হলো আমার ভিতর, আমি
বলতে পারবো না, আমি চীৎকার করে
বলে উঠলাম: ‘খবরদার! নেবেন না
মুক্তি এইভাবে। মুক্তি যদি দিতে চায়
সরকার, পুরোপুরি দিতে হবে। বন্দী
শেখ মুজিবকে নিয়ে বৈঠকে বসুক
কেউ, এটা আমি বরদাস্ত করবো না।
আমি যা বলি, শুনতে হবে। তা না হলে,
মনে রাখবেন, বাড়ি ফিরে পাবেন না
দেখতে রেনুর মুখ আর।’ এই বলে
কান্না জুড়লাম আমি বালিকার মতো।
আপনি জানেন, কত ছোটকাল থেকে
করে আসছি আপনার ঘর, এরকম
অবাধ্য হইনি কোনোদিন এর আগে।
তারপর সার্জেন্ট জহুরুল হক খুন
হলো। গর্জে ঊঠলো দেশ। ঊনসত্তরের
গণঅভ্যুত্থান হলো। ২২ ফেব্রুয়ারি
আপনি মুক্তি পেয়ে জেল থেকে বের হয়ে
এলেন। বাঙালী আপনাকে সংবর্ধনা
দিলো ২৩ ফেব্রুয়ারি মহাসমারোহে
রেসকোর্স ময়দানে; এবং আপনি
‘বঙ্গবন্ধু’ নাম নিয়ে বীরের মতন
ফিরে আসলেন ঘরে।” বলতে বলতে
ভোরের শিশিরে ভেজা যেন দুই চোখ
মুছলেন বঙ্গমাতা শাড়ির আঁচলে।
বললেন বঙ্গবন্ধু, দুখী মানুষের
নেতা, আর্দ্র কণ্ঠে: “সত্যিই কঠিন এক
ফাঁড়া থেকে সেইদিন দিয়েছিলে তুমি
বাঁচিয়ে আমাকে। জিদ না করতে যদি
এইভাবে, ঘটতে পারতো অন্য কিছু।
লোকে বলে আমি নাকি স্ত্রী বলতে পাগল;
কেন যে পাগল, যদি তা জানতো তারা!”
দুধের গেলাস হাতে ঢুকলো দুহিতা
তাঁর, দুচোখের মণি, ধীর পদক্ষেপে।
আবেগ-আপ্লুত বেগম মুজিব, যেন
অপ্রস্তুত তার আকস্মিক আগমনে,
আড়ষ্ট গলায় বললেন, “যাই। বাপ-
বেটি কথা বলো। রান্না চড়াই গে আমি।”
বঙ্গমাতা, মুখে যার প্রশান্তির দ্যুতি,
তড়িৎ গতিতে ফিরে গেলে গৃহকাজে,
পিতা-কন্যা দুজনেই তাকিয়ে রইলো
তাঁর চলে যাওয়ার দিকে, যেন তারা
দেখছে চেয়ে চেয়ে সর্বাঙ্গে শান্তির ছোঁয়া
দিয়ে ফিরে যাওয়া কোনো বসন্তবাতাস,
যার মিষ্টি শীতলতা লেগে আছে সারা
শরীরে-অন্তরে। উন্মনা মুজিব, যিনি
শ্রেষ্ঠ পুরুষ বাংলার, পেলেন সম্বিৎ
ফিরে, দুহিতার ডাকে: ‘বাবা, খেয়ে নেন
দুধ।’ সোফার উপর পড়লেন তিনি
বসে। অতঃপর কোনো সুশান্ত বালক
প্রবল অনেচ্ছা সত্তেও যেভাবে মান্য
করে তিক্ত কোনো ওষুধ খাওয়ার মতো
মাতৃ-আদেশ কারণ আছে সে-আদেশে
একই সাথে স্বাস্থ্যোদ্ধার ও মায়ের তুষ্টি,
সেইভাবে মাতৃমূর্তি দুহিতার হাত
থেকে দুধের গেলাস নিয়ে, ধীর-স্থির
চুমুক দিলেন মহানেতা, যেন কোনো
সুমিষ্ট নহরে। তলানি পর্যন্ত শুষে
নিয়ে, মুখ তুলে চাইলেন তিনি, মুখে
তাঁর ছড়িয়ে পড়েছে সুসবুজ কোনো
অরণ্যের জ্যোতিরেখা।-“আমার গরুটা
কেমন আছে. মা হাসু? কি-স্বার্থপরের
মতো ওর দুগ্ধ খেয়ে যাই! ওর সাথে
দেখাই করতে পারি না একটা দিনও।”
“ভালোই আছে ও, বাবা। আমরা যখন
ওর কাছে যাই, কেমন বোবার মতো
চেয়ে চেয়ে থাকে আর কাকে যেন খোঁজে।
বোধহয় জেনে গেছে ও-ও এতদিনে,
আপনি বড়ই ব্যস্ত দেশ নিয়ে, দল
নিয়ে আর রাজনীতি নিয়ে। তাই তো ও
চুপ হয়ে থাকে, রা করে না কিছুতেই।”
ছলছল করে ওঠে দুচোখের নীল
দরদী নেতার, কণ্ঠে যাঁর বৈশাখের
বজ্রধ্বনি কিন্তু দীর্ঘ বুকের গহিনে
অথৈ বঙ্গোপসাগর, কি-উত্তাল!-“আহা,
বেচারী! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম
একেবারে। সকালে যখন বের হয়ে
যাই, একবার স্মরণ করিয়ে দিও,
দেখা করে যাবো। এ-বাংলার সমস্ত
পশুপাখি, নদ-নদী, খাল-বিল, খা খা
তেপান্তর, মাঠঘাট, শস্য, ফুলফল,
গাছপালা-চেনে যেন আমাকে সবাই।
কিষাণ, মজুর, কুলি, মুটে, জেলে, মাঝি,
নাপিত ও গাঁয়ের ঘোমটা দেয়া বধু,
গঞ্জের দোকানদার, স্কুলের মাস্টার,
ছাত্র, যুবক, জনতা-তোমার পিতাকে
দেখলেই ভুলে যায় দুঃখকষ্ট সব।
তোমার পিতাকে দেখলেই একবার,
তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে দেশ,
সেই দেশ, যার জীর্ণ বুকের উপর
জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসে
আছে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সামরিক
জান্তা, বসে জোঁকের মতন খাচ্ছে চুষে
সাত কোটি বাঙালীর প্রাণের রুধির।”
হৈ হৈ করতে করতে এমন সময়
ছুটে এলো তাঁর দুহিতা দ্বিতীয়-শেখ
রেহানা ও পুত্র শেখ রাসেল। আনন্দ-
মেলা এক, বসে গেল মুহূর্তেই প্রিয়
জনককে ঘিরে। নেতা তিনি সাত কোটি
মানুষের, আশ্চর্য অনলবরর্ষী বক্তা,
হৃদয়হরণ করা এক সুললিত
কথার যাদুকর, বাঙালী শ্রেষ্ঠতর
হাজার বছরে; গেলেন হঠাৎ করে
হয়ে এক স্নেহ-বৎসল পিতা, প্রিয়
পুত্র-কন্যাদের মাঝখানে। আর জ্যেষ্ঠ
কন্যা তাঁর, যেন কন্যা নয়, দূরদর্শী
জননী হাসিনা, জীবন্ত জগদ্ধাত্রীর
রূপ ধরে, স্মিত-মুখ, ময়ূরীর চোখে
দেখতে লাগলো চেয়ে চেয়ে প্রাণবন্ত
সেই খেলা আর ভাবতে লাগলো: সত্যি,
কি-অপূর্ব মায়ার পৃথিবী এই, আর
এই বত্রিশ নম্বর পুরোনো বাড়িটা!
মুজিবনামা মহাকাব্যের ‘বত্রিশ নম্বর বাড়ি পর্ব’; নাম ‘দ্বিতীয় সর্গ’।