ওই আমাদের পাগলা জগাই, নিত্যি হেথায় আসে;
আপন মনে গুন্ গুনিয়ে মুচ্কি হাসি হাসে ।
চলতে গিয়ে হঠাৎ যেন ধমক লেগে থামে;
তড়াক্ করে লাফ দিয়ে যায় ডাইনে থেকে বামে।
ভীষণ রোখে হাত গুটিয়ে সামলে নিয়ে কোঁচা ;
“এইয়ো” বলে ক্ষ্যাপার মতো শুন্যে মারে খোঁচা ।
চেঁচিয়ে বলে ,”ফাঁদ পেতেছ ? জগাই কি তায় পড়ে?
সাত জার্মান, জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে।”
উৎসাহেতে গরম হয়ে তিড়িং বিড়িং নাচে,
কখনও যায় সামনে তেড়ে, কখনও যায় পাছে।
এলোপাতাড়ি ছাতার বাড়ি ধুপুস ধাপুস্ কত!
চক্ষু বুজে কায়দা খেলায় চর্কিবাজির মত।
লাফের চোটে হাঁপিয়ে ওঠে গায়েতে ঘাম ঝরে,
দুড়ুম ক’রে মাটির পরে লম্বা হয়ে পড়ে।
হাত পা ছুঁড়ে চেঁচায় খালি চোখ্টি ক’রে ঘোলা,
“জগাই মেলো হঠাৎ খেয়ে কামানের এক গোলা”!
এই না বলে মিনিট খানেক ছট্ফটিয়ে খুব,
মড়ার মত শক্ত হ’য়ে এক্কেবারে চুপ !
তার পরেতে সটান্ বসে চুলকে খানিক মাথা,
পকেট থেকে বার করে তার হিসেব লেখার খাতা।
লিখলে তাতে- “শোনরে জগাই, ভীষণ লড়াই হলো
পাঁচ ব্যাটাকে খতম ক’রে জগাই দাদা মোলো।”
খুড়োর কল / সুকুমার রায়
কল করেছেন আজব রকম চন্ডীদাসের খুড়ো-
সবাই শুনে সাবাস বলে পাড়ার ছেলে বুড়ো।
খুড়োর যখন অল্প বয়স-বছর খানেক হবে-
উঠলো কেঁদে ‘গুংগা’ ব’লে ভীষণ অট্টরবে।
আরতো সবাই ‘মামা’ ‘গাগা’ আবোল তাবোল বকে;
খুড়োর মুখে ‘গুংগা’ শুনে চমকে গেল লোকে।
বললে সবাই, “এই ছেলেটা বাঁচলে পরে তবে,
বুদ্ধি জোরে এ সংসারে একটা কিছু হবে।”
সেই খুড়ো আজ কল করেছেন আপন বুদ্ধি বলে,
পাঁচ ঘন্টার রাস্তা যাবে দেড় ঘন্টায় চলে।
দেখে এলাম কলটি অতি সহজ এবং সোজা,
ঘন্টা পাঁচেক ঘাঁটলে পরে আপনি যাবে বোঝা।
বলব কি আর কলের ফিকির,বলতে না পাই ভাষা,
ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা।
সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যে রকম রুচি-
মন্ডা মিঠাই চপ কাটলেট খাজা কিংবা লুচি।
মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে যায় খেতে,
মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে।
এমনি ক’রে লোভের টানে খাবার পানে চেয়ে,
উৎসাহেতে হুঁস রবে না চলবে কেবল ধেয়ে,
হেসে খেলে দুদশ যোজন চলবে বিনা ক্লেশে,
খাবার গন্ধে পাগল হ’য়ে জিভের জলে ভেসে।
সবাই বলে সমস্বরে ছেলে জোয়ান বুড়ো,
অতুল কীর্তি রাখল ভবে চন্ডীদাসের খুড়ো।
বুড়ীর বাড়ী / সুকুমার রায়
গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি,
ঝুরঝুরে প’ড়ো ঘরে থুরথুরে বুড়ী।
কাঁথাভরা ঝুলকালি, মাথাভরা ধুলো,
মিটমিটে ঘোলা চোখ, পিঠখানা কুলো।
কাঁটা দিয়ে আটা ঘর- আঠা দিয়ে সেঁটে,
সুতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুথু দিয়ে চেটে।
ভর দিতে ভয় হয় ঘর বুঝি পড়ে,
খক খক কাশি দিরে ঠক ঠক নড়ে।
ডাকে যদি ফিরিওলা, হাঁকে যদি গাড়ি,
খসে পড়ে কড়িকাঠ ধসে পড়ে বাড়ী।
বাঁকাচোরা ঘরদোর ফাঁকা ফাঁকা কত,
ঝাঁট দিলে ঝ’রে পড়ে কাঠকুটো যত।
ছাদগুলো ঝুলে পড়ে বাদলায় ভিজে,
একা বুড়ী কাঠি গুঁজে ঠেকা দেয় নিজে।
মেরামত দিনরাত কেরামত ভারি,
থুরথুরে বুড়ী তার ঝুরঝুরে বাড়ী।
সৎপাত্র / সুকুমার রায়
শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে-
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে?
জানতে চাও সে কেমন ছেলে?
মন্দ নয়, সে পাত্র ভাল-
রং যদিও বেজায় কালো;
তার উপরে মুখের গঠন
অনেকটা ঠিক প্যাঁচার মতন।
বিদ্যে বুদ্ধি? বলছি মশাই-
ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়!
উনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে
ঘায়েল হ’য়ে থামল শেষে।
বিষয় আশয়? গরীব বেজায়-
কষ্টে-সৃষ্টে দিন চলে যায়।
মানুষ ত নয় ভাইগুলো তার-
একটা পাগল একটা গোঁয়ার;
আরেকটি সে তৈরি ছেলে,
জাল ক’রে নোট গেছেন জেলে।
কনিষ্ঠটি তবলা বাজায়
যাত্রা দলে পাঁচ টাকা পায়।
গঙ্গারাম ত কেবল ভোগে
পিলের জ্বর আর পান্ডু রোগে
কিন্তু তারা উচ্চ ঘর,
কংসরাজের বংশধর!
শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের
কি যেন হয় গঙ্গারামের।-
যাহোক, এবার পাত্র পেলে,
এমন কি আর মন্দ ছেলে?