আবুজর গিফারী রা. : দ্রোহী, একা, স্পষ্টভাষী / আবদুল মান্নান সৈয়দ

আল্লাহতায়ালার কথা বলে পৃথিবীতে তিরষ্কৃত হওয়া, শাস্তির সম্মুখীন হওয়াকে একমাত্র আবুজর রা. ছাড়া সবাই ভয় করে। এমনকি আমি নিজেও তা থেকে মুক্ত নই।
-হযরত আলী রা.

‘আবুজর একা আছে, একা থাকবে, যাবেও একাকী।’*
কেউ কেউ হয় এরকম: দ্রোহী, একা, স্পষ্টভাষী;
ভিড়ের ভিতরে থেকে নির্জন দ্বীপের অধিবাসী;
বিশাল আকাশে চাঁদ; বিজন কান্তারে এক পাখি।

শত্রুগণ প্রাণপণে অবিশ্রাম চেষ্টা করে যাবে
তোমাকে ভেড়াতে দলে; বেজে যাবে তোমার ঘোষণা:
‘চিরতরে বন্ধ হোক গরিবের শোষণ, বঞ্চনা!’
তুমি থেকে যাবে ইস্পাতের মতো নিজের স্বভাবে।

হে ফকির নির্বাসিত! মরুপ্রান্তরের হে সম্রাট!
ঘুরতে হয়েছে ক্রমাগত মদীনায় – সিরিয়ায়-
শুধুমাত্র দাবি করে মানুষের সমানাধিকার।
নির্বাসন তোমাকেই সাজে, হে মহৎ! হে বিরাট!
হে সিদ্দিক! আজো ঝরে তোমার মাজারে- রাবজায়-
অফুরন্ত জ্যোৎস্নার আশরাফি আর রৌদ্রের দিনার।।

খালিদ-বিন-ওয়ালিদ: আল্লার তলোয়ার / আবদুল মান্নান সৈয়দ

‘The fiercest and most successful of the Arabian warriors.’
_ The Decline And Fall of the Roman Empire: Gibbon

বেহেশতে যাবেন যিনি, তাঁর জন্যে নিষিদ্ধ রোদন।-
উমরের এ-আদেশ খালিদের মৃত্যুতে যখন
না-মেনে, উঠেছে তুঙ্গ কান্নার মাতম পথে পথে,
সঙ্গে সঙ্গে খলিফার হাতের চাবুক গর্জে ওঠে।

তখনই শোনেন তাঁর কন্যাই ক্রন্দন-কাতর।
দরোজার কাছে গিয়েও উমরের পা দুটি পাথর।
খোলা হলো না দরোজা। বসে পড়লেন। ততোক্ষণে,
চোখের পানিতে ভেসে গিয়ে, তাঁরও পড়েছিল মনে:-

বিদ্যুতের চেয়ে দীপ্র চমকায় আল্লার তলোয়ার।
ওহোদ, কাজিমা, ওয়াজাদা, ইয়ারমুক, আজ্নাদীন-
সব-কিছু শত্রুমুক্ত, সব-কিছু রঙিন-স্বাধীন।
যখনই ঝলকে ওঠে আকাশে আল্লার তলোয়ার-
দিন হয়ে ওঠে রাত্রি, রাত্রি হয় ঝলমলে দিন-
সূর্য বা চন্দ্রের মতো চমকায় আল্লার তলোয়ার।।

বেলালের কণ্ঠ থেকে / আবদুল মান্নান সৈয়দ

আবু জেহেল দিনে দিনে যতই বাড়াত অত্যাচার,
অদম্য অপ্রতিরোধ্য হাবশি-গোলাম কাফ্রি-কালো:
জ্যোতির উদ্ভাসে তাঁর হৃদয়ের আঁধার মিলাল:
পুষ্পশয্যা হয়ে উঠল তপ্ত বালু, জ্বলন্ত অঙ্গার।

হাবশি গোলাম বটে, গাত্র-ত্বক কাফ্রি-কালো বটে,
হৃদয়ে ও কণ্ঠে তবু প্রজ্বলিত চাঁদের আধখানা:
মরুর বালিতে ওড়ে অজস্র জ্যোৎস্নার সোনাদানা,
মণিমুক্তা ঝরে পড়ে ফেরেশতার পাখার ঝাপটে।

বেলালের কণ্ঠ থেকে উঠেছে ‘আল্লাহু আকবর!’
টলে পড়ল লাত-মানাত, জ্বিন-পরী, ডাকিনী-পিশাচী।
দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ল কম্বুকণ্ঠ ‘আল্লাহু আকবর!’
ধ্বনিত সত্যের ডাকে প্রকম্পিত উদীচী-অবাচী।
নিশিবাতাসের ঢেউএ স্যন্দমান ‘আল্লাহু আকবর!’
নীল আকাশের ডোম ঘিরে ধরে তারার মৌমাছি।।

সাহাবীরা / আবদুল মান্নান সৈয়দ

আমার সাহাবীগণ আকাশের এক-একটি নক্ষত্রের মতো, তোমরা তাঁদের
যাঁকেই অনুসরণ করবে হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে।
– হযরত মুহম্মদ সা.

তারকার মধ্য দিয়ে সংখ্যাহীন তারকা চলেছে:
সাহাবীরা – তারপর – তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন –
সবই তাঁর রশ্মিস্নাত – আকাশে প্রোজ্জ্বল, অমলিন:
বছর বছর ধরে কতো কতো নক্ষত্র জ্বলেছে।

সূর্য তো স্বয়ম্প্রকাশ; তবু তার অনন্ত কিরণে
যাঁরা হয়েছেন হিল্লোলিত, সেই খাদিজা তাহিরা
থেকে আরো কতো দীপ্তিমান পুণ্যবান সাহাবীরা –
তুলে ধরেছেন তাঁকে তিলে তিলে স্মরণ-বরণে।

গোলাপের মধ্য দিয়ে সংখ্যাহীন গোলাপ ছুটেছে:
যা-কিছু নশ্বর তার মধ্য দিয়ে অবিনশ্বরতা
এঁরা গিয়েছেন রেখে – বর্ণনার স্মারক অক্ষর
এঁদেরই তুলিতে হলো প্রাণবান – জীয়ন্ত ফুটেছে
তাঁর রেখালেখ্য, তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ সব কথা,
তাঁরই দীপ্তি লেগে হয়েছেন এঁরাও অবিনশ্বর।।

হজরত আলী (রা.): জ্ঞানের দরোজা / আবদুল মান্নান সৈয়দ

আমি জ্ঞানের নগরী এবং আলী তার দরোজা।
– হজরত মুহম্মদ (সা.)

যোদ্ধা-কবি একই সঙ্গে, একই সঙ্গে রৌদ্রে-জ্যোৎস্নায়
প্লাবিত তোমার আত্মা। ভ্রাতৃরক্তে রাঙা পৃথিবীতে
চেষ্টা করেছিলে তুমি অফুরান শান্তি এনে দিতে;-
যে-ব্যর্থতা ভরে আছে লাবণ্যে ও মহৎ আভায়।

আবুজরের সঙ্গেও গিয়েছিলে রাবজায় তুমি;
উসমানকে বাঁচাতেও পাঠিয়েছিলে নিজেরই পুত্রকে;-
দরদী সেবক তুমি। অবিচল ছিলে সুখে, শোকে।
বহু বিপরীতে গড়া তোমার আশ্চর্য মনোভূমি।

প্রজ্ঞার শহরে যিনি প্রদীপিত এক সিংহদ্বার,
মৃত্যু তাঁকে কি করবে? – তাঁকে আরো করেছে অবার।
খায়বরের যুদ্ধজয়ী, আসাদুল্লাহ, জ্ঞানেরও সম্রাট,
একই সঙ্গে যোদ্ধা-কবি : কালোত্তর, মহান, বিরাট।
রসুলের চারিত্রের রঙে রঞ্জিত বিশাল দিল্ –
আজ তাঁর প্রশংসায় ভরপুর সমস্ত নিখিল।।

হযরত উসমান (রা.) : অজস্র প্রস্রবণ / আবদুল মান্নান সৈয়দ

আমি হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘উসমান!
যদি আল্লাহতালা তোমাকে খিলাফতের পোশাক পরিয়ে দেন, তবে
স্বেচ্ছায় কখনো তা খুলে ফেলো না।’
-আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)

ইতিহাসে জ্যামিতি কি কাজ করে যায় শব্দহীন?
উমর এবং আলী বজ্রাদপি কঠোর; কোমল
আবুবকর, উসমান। উসমান লাজুক, নির্বল,
সত্তরেও সসংকোচ। একমাত্র আল্লাহর অধীন।

এমনই দরদী তিনি, খুললেস অজস্র প্রস্রবণ
মরুবালুকার দেশে; – একটির নিজের জন্য নয়।
সর্বশেষ দিনগুলিতে দেখালেন তৃষ্ণার বিজয়
কাকে বলে; কাকে বলে, শান্ত স্থির আত্মসমর্পণ।

নবীজীর কথা তুমি ফেলবে কি করে উসমান?-
মৃত্যুকে নিয়েছ তাই মেনে, শান্ত নৃপতি মহান!
নবীজীর কথা ভেবে, বিদ্রোহ ছড়াতে পারে ভেবে,
নির্বিকার জামা পাল্টে গিয়েছ মৃত্যুর মধ্যে নেবে।
কুরআন বুকে বেঁধে হে উসমান! হে জুন্নুরায়েন!
উজিয়ে এসেছ আজ মহাকাল-সমুদ্র সফেন।।

হযরত উমর (রা.) : গোলাপে-ইস্পাতে / আবদুল মান্নান সৈয়দ

হজরত উমর (রা.) বলেছেন,‘ইমরুল কায়েস অন্ধ ও অজ্ঞাত
বিষয়বস্তুকে দৃষ্টিশক্তি দান করেছেন।’
-আল ফারুক : আল্লামা শিবলী নো’মানী

ইমরুল কায়েস ক-টি অন্ধকে করেছে দৃষ্টিদান?-
তুমি শিখিয়েছ তার চেয়ে অনেক-অনেক বেশি :
তোমার চরিত্র যেন গোলাপে-ইস্পাতে মেশামেশি :
পুত্রকে ছাড়োনি; আর দাসকে- মানুষের সম্মান!

শিখিয়েছে কোমলতা- গোলাপের অধিক গোলাপ!
শিখিয়েছ কঠোরতা- ইস্পাতের চেয়েও ইস্পাত!
তলোয়ারে-কবিতায় পরস্পরে আলোকসম্পাত
ঘটিয়েছে একজনই: উমর-ইবনুল-খাত্তাব।

দীর্ঘদেহী, তীক্ষ্নচক্ষু, হে খলিফাতুল মুসলেমীন,
রাত্রিব্যাপী ঘুরে ঘুরে নগরের অলিতে-গলিতে
খুঁজেছ কোথায় আছে অনাহারী, ক্ষুধাতুর, দীন।
-তোমারই আদর্শ আজো আমাদের অবাধ্য শোণিতে
খেলা করে। তাই আজো মৃত্তিকার পৃথিবী রঙিন;
প্রবল বন্যারও শেষে শস্য জাগে উর্বর পলিতে।।

হজরত আবু বকর (রা.): দৃষ্টিতে-শ্রবণে / আবদুল মান্নান সৈয়দ

নবীগণ ব্যতীত সূর্যের উদয়াস্তের এই পৃথিবীতে আবুবকর (রা.)-এর
চেয়ে মহত্তর কোনো ব্যক্তি কখনো জন্মায়নি।
-হজরত মুহম্মদ (সা.)

সাওর-গুহায় সঙ্গী হয়েছিল কে রসুলুল্লাহর?
কে ছিল সত্য গ্রহণে দ্বিধামুক্ত, নিশ্চিন্ত, নির্ভীক?
কে ছিল নবীর সঙ্গে যেন আলো, যেন অন্ধকার?
কে সর্বস্ব সঁপেছিল? – ত্যাগী আবুবকর সিদ্দিক!

ছিলে – উমরের সাথে – রসুলের দৃষ্টি ও শ্রবণ!
যে-কোনো ব্যক্তির চেয়ে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ অধিক।
গোলাপের পাপড়ি আর পাখির ডানার মতো মন
কে নিজেকে দিয়েছিল? – মুগ্ধ আবুবকর সিদ্দিক!

নবীজীর মৃত্যুকালে একটিই জানালা ছিল খোলা
তোমার বাড়ির দিকে। সেটাই তো যথেষ্ট ইশারা,
কার জন্যে নির্ধারিত পরবর্তী শ্রেষ্ঠ আসন? –
– বদরের যুদ্ধে যে দিয়েছিল নবীকে পাহারা;
– যে ছিল সূর্যের রশ্মি আর তাঁর মেঘের হিন্দোলা;
– যে ছিল সত্যের দৃষ্টি, কালোত্তর কালের শ্রবণ।।

খুলাফায়ে রাশেদীন / আবদুল মান্নান সৈয়দ

তোমারই প্রদর্শিত সোজা সত্য-পথের পথিক,
আত্মলোপী, স্বস্থ, দয়াশীল : আবুবকর সিদ্দিক।
নীতিনিয়মের ক্ষেত্রে বজ্রতুল্য, হৃদয়ে গোলাপ,
অসমসাহসী বীর উমর-ইবনুল-খাত্তাব।

কুরআনের সংকলক, ইউসুফের মতো রূপবান,
বালিতে যে-ঝর্ণা আনে : কোমল-শ্যামল উসমান।
প্রজ্ঞার শহরে যিনি প্রদীপিত এক সিংহদ্বার,
কবিতা ও যুদ্ধে সমান কুশলী : আলী হায়দার।
 
তোমার পাহাড় থেকে নেমে-আসা ওরা চার নদী
ভিজিয়েছে আমাদের জমিনের হৃদয় অবধি।
তোমার আকাঙ্ক্ষা থেকে উড়ে-যাওয়া ওরা চার হাঁস
দখল করেছে চার দিগন্তের সমগ্র আকাশ।
তোমারই সূর্যের রশ্মি চারজন করেছে বিস্তার-
আবুবকর, উমর, উসমান, আলী হায়দার।।

হজরত মুহম্মদ (সা.) : তিরোভাব / আবদুল মান্নান সৈয়দ

[হাসসান ইবনে সাবিত রা.-র এলেজির কথা মনে রেখে]

রাত্রে লোকেরা [রাসুলুল্লাহ সা.-কে সমাহিত করার মাধ্যমে]
জ্ঞান, দয়া ও সহিষ্ণুতাকে
সমাহিত করেছে…
-হাসসান ইবনে সাবিত (রা.)

‘ছিলাম ঝর্নার পাশে; কণ্ঠ শুষ্ক তৃষ্ণায় এখন।-
কেননা সমস্ত জ্ঞান- সব দয়া- সহিষ্ণুতা-
মাটির অনেক নিচে চলে গেছে। ক্রন্দন-ক্বণন
ব্যাপ্ত কখনো, কখনো কথা বলছে শুধুই নিরবতা।

কেঁদেছে মসজিদ আর কেঁদেছে নির্জন স্থানগুলি
তাঁর শোকে। কাঁদেনি কে? চরাচর, মৃত্তিকা, আকাশ
এখন রোদনশীল। কেঁদে ফেরে নক্ষত্র ও ধূলি।-
নির্বাপিত হয়েছেন আল্লাহর জ্যোতির উদ্ভাস।’

-চৌদ্দ শো বছর পরেকার এই বাংলা কবিতায়
একথা জানতে চাই: -আজো তাঁর আত্মার বিভায়
পরিব্যপ্ত এ-পৃথিবী। তিনি এক অজেয় পর্বত।
মানবজাতির জন্যে খুলে দিয়েছেন মুক্তিপথ।
কোটি হৃদয়-উদ্যান ভরে গেছে তাঁর ফুলে-ফলে:
জ্ঞান, দয়া, সহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়েছে ভূমন্ডলে।।

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: