মেঘ থেকে মাটি পর্যন্ত / আল মাহমুদ

আমি নিজের মধ্যে আমার ইচ্ছেমতো ঋতু পরিবর্তনের আবহাওয়া তৈরি করে নেওয়ার অবস্থায় পৌছেছি
না অন্ধত্ব না বার্ধক্য
কেবল অস্তিত্বের কার্যকারণ আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে
মেঘের ওপর ঠেস দিয়ে আমি পৃথিবীকে দেখি
দেখি আমার জন্মের দ্বীপদেশকে
খুব মৃদু শব্দে উচ্চারণ করি, বাংলাদেশ
এতো মৃদু যে আমার অন্তরের শব্দ আমার কানে পৌছোয় না।

একদা আমি এ দেশের প্রতিটি পাখির ডাক থেকে অর্থ বের করতে পারতাম
পালক থেকে রঙের রংধনু
আমি এ দেশের প্রতিটি নদীকে আমার বুকের ভেতর টেনে এনেছি
এখন সব ভুলে যেতে চাই
কারণ ভালোবাসার কথা বললেই একটা প্রতিদানের প্রশ্ন টেরচা হয়ে আমার বুকের মধ্যে লেগে থাকে।
আমি তো কোনো প্রতিদান চাই না
আমি কোনো প্রেমিকও নই যে আমার একটা প্রতিচ্ছায়া থাকবে
বড়জোর একজন কবির পরিণাম চিন্তা করে
আমি মেঘ থেকে মাটি পর্যন্ত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি
আমাকে দেখে হিংস্র পশুরা দ্রুত এগিয়ে এসে গাত্রগন্ধে
বিতৃষ্ণা ব্যক্ত করে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়
পিঁপড়ে থেকে বাঘ পর্যন্ত আমাকে ছোঁয় না
শুধু মানুষই এখনো আমার প্রতি তাদের কো্রধ ব্যক্ত করে
তারা কবিতার প্রতি তাদের অনাস্থা জানাতে গিয়ে ঈর্ষার করাতে আমাকে কাটতে চায়
কিন্তু দেহ শত খণ্ডে বিভক্ত করেও যখন কোনো রক্তের স্বাদ পায় না
তখন হাল ছেড়ে চিৎকার করে বলে, ‘শালা, সত্যি কবি।’
এ কথায় আমি আর শুয়ে থাকতে পারি না।
আমি আমার জন্মভূমির ধানক্ষেতগুলোর মতো নড়েচড়ে বসি। শস্যের গন্ধেে
আমার চতুর্দিকটা ম’ ম’ করতে থাকে।

আমি তো আগেই বলেছি, এমন অবস্থায় এখন আমার
বিশ্রাম যে, এই গ্রীষ্মের দাবদাহে কল্পনা আমাকে
পৌষের শীতে থরথর করে কাঁপায়
ইচ্ছে করলে আমি শীতকে গ্রীষ্ম এবং গ্রীষ্মকে শীতে পরিণত করতে পারি
যে যাই বলুক, এর নামই তো কবিত্ব শক্তি
তবে শত কল্পনার মধ্যেও আমি নারীকে পুরুষে পরিণত করতে পারি না
যদিও নারীরা সব সময় নিজেদের পুরুষই ভাবে
অথচ পৌরুষে তাদের আকাঙ্ক্ষায় কোনো তৃপ্তি নেই।

আমি প্রেমকে ভয় পাই। কারণ
আসঙ্গলিপ্সা কবিকে অর্ধেক নারীত্বে নিমজ্জিত করে
এখন আমার নারীর কাছে একমাত্র কাম্য দয়া আর শুশ্রুষা
শিশুরা যেমন ক্ষুধার্ত হলে মাতৃস্তনের জন্য কেঁদে ওঠে, আমিও
মায়া ও মমতার জন্য আমার দেশমাতৃকার নগ্ন ব-দ্বীপে
একাকী রোদন করি। আমার সাথে প্রকৃতি, পাখ-পাখালি
কীট-পতঙ্গ এবং শূন্য মাঠ মা মা করে কেঁদে ওঠে।

তুমি কি শুনতে পাও, বাংলাদেশ?

অমরতার আক্ষেপ / আল মাহমুদ

কতবার ভেবেছি কবির আংরাখা আমি খুলে ফেলি কিন্তু জগতের সবগুলো
চোখ আমার নগ্নতা অবলোকনে উদগ্রীব। তুমি তো জানো কবির কোনো বন্ধু হয় না।
যেমন রাজার কোনো বন্ধু থাকে না। আমি আমার পোশাক তোমার পালঙ্ক
স্পর্শ করে খুলে ফেলতে চাই। চুমকির কাজ করা এই পিরহান, দামেস্কের
দর্জির তৈরি এই কোট, রেশমের ঝলকানো এই পাজামা, একলক্ষ মুক্তো
বসানো অজগরের চামড়ার এই কটিবন্ধ আমি তোমার বিছানায় শিথিল করে
তোমার পাশে শুয়ে পড়বো। একটা জগৎ দেখার যে ক্লান্তি তা আমার নয়নে
এতদিন জমা ছিল এখন ঘুমুতে চাই।

এসো আমরা পরিত্যক্ত পৃথিবীর কথা আলোচনা করি। তুমি এখানে এই
দুঃখহীন অনুতাপহীন অভাবহীন বাসস্থানে কীভাবে থাকবে? এখানে তো কোনো
মৃত্যু বা বিনাশ নেই। অশ্রুজল বা দীর্ঘশ্বাস নেই। যেখানে শোক নেই হাহাকার নেই
ক্ষুধা বা উপোস নেই সেখানে সুখের স্বাদ আসলে কেমন তা আমি চাখতে এসেছি।

আমার কেন পৃথিবীর কথা এত মনে পড়ে। কেন মানুষের রোদন ও আক্ষেপের
দুনিয়া যা আমরা ফেলে এসেছি অনেক দূরে একটা ভেজা মাটির বিশাল
গোলাকার গ্রহে যা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে একটি তারা হয়ে জ্বলছে। তার কথা ভুলতে পারি না।

আমি কেন নেবু ফুলের গন্ধেভারী বাতাসের কথা আমার স্মৃতি থেকে মুছে
ফেলতে পারি না? নদীর তীরে জোনাকি ভরা সেই গ্রাম খড়োঘরের একটি
চালার নিচে তোমাকে প্রথম চুম্বনের সেই স্মৃতি কেন অনন্ত সুখের মধ্যে এসেও
আমাকে অশ্রুসিক্ত করতে চায়? কে জানে? আমরা তো অনন্তকালের উপযোগী
দেহাবয়ব পেয়েছি। কিন্তু কেন সেই রোগ জরজর মশা-মাছির গুঞ্জনের মধ্যে
তোমার মরদেহের ক্লান্তি স্পর্শ করার পার্থিব বাসনা এখনো আমার অমরত্বের
শরীরের নিচে গুমরিয়ে মরছে।তবে কি তুমি সেই তুমি নও?
ও বিশালাক্ষি, কাঞ্চনকান্তি, অমরযৌবনা, কেন মৃত্যুময় পৃথিবীর স্মৃতি আমাকে
এত আকুল করে রেখেছে? আমি কবি এই কি অপরাধ? ও নেবু ফুলের গন্ধ,
ও নদী তরঙ্গের ভেঙে পড়া চাঁদের স্মৃতি, ও বিলুপ্ত পৃথিবীর হাওয়া, আমার
কবিত্বকে আমার প্রিয়ার পালঙ্কে আর আমাকে তোমাদের আঁচলের হাওয়ায়
কেন ঘুম পাড়িয়ে দাও না?

নাবিক / আল মাহমুদ

দেখো আমার মুখের দিকে।
মনে হবে নোনা তরঙ্গের উপর ডানা মেলে দিয়েছে এক গাঙচিল।
মনে হবে ফেনার আলোড়নের মধ্যে আমার জন্ম
মনে হবে মাটি নয় তরঙ্গই আমার আবাস।

আমি জানি ঢেউয়ের ভেতর শুয়ে আছে
আমার কত পূর্বসূরি
ঢেউয়ের ভেতর আমি তাদের চোখ, চোখের মণি
মুক্তা হয়ে যেতে দেখেছি
তাদের হাড়গোড় এখন প্রবাল
তাদের কত স্বাদ ছিল, স্বপ্ন ছিল
কত বন্দরে তারা প্রেমের নোঙর ফেলেছিল
এখন তাদের হাড় প্রবাল হয়েছে নুনের মধ্যে

বলো নাবিকের উত্তরাধিকার কী? স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়।
নাবিকের লাশ মাটি পায় না
তরঙ্গে ভেসে যায় তার অবশেষ
কোনো অবসন্নতা নেই যেমন সমুদ্র ঘুমায় না।

উদয় ও অস্তের দৃশ্য দেখার জন্য
তীরের মানুষেরা সমুদ্রের কাছে আসে।
কী তারা দেখতে পায়? অনিঃশেষ লবণ
ফেনিল তরঙ্গ তুলে অনন্তকাল ধরে নাচছে।

সমুদ্র হলো এই পৃথিবীর একটি পরম সত্য
মানুষ যখনই ক্ষুধার্ত হয়
পৃথিবী যখন আর তার আহার যোগাতে পারে না
তখন সাগর তার পেট খুলে দেয়।

কত প্রলোভন একজন নাবিককে ডাকে
ক্ষণস্থায়ী আনন্দ বন্দরে বন্দরে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
কিন্তু একটি বিশাল দীর্ঘশ্বাস নোঙর তুলে নিয়ে আবার ভেসে পড়ে
কারণ দরিয়া কোনো দিগন্ত মানে না
কে এই আদি হাতছানির আদি স্রষ্টা
শুধু অসীমের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া
এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।

অতৃপ্ত প্রেম নিয়ে বন্দরে বন্দরে আমরা রেখে আসি আমাদের অশ্রুজল
যা সমুদ্রের মতোই নোনা এবং অদৃষ্টের মতোই সীমাহীন।

বাতাসের মুখে লাগাম দিয়ে / আল মাহমুদ

ইচ্ছে ছিল দেখতে দেখতে যাওয়ার। আমার কৈশোরের পথও ছিল ছায়াশীতল।
বৃক্ষ ও পাখির অরণ্যের একঘেয়েমি পেরিয়েই যে নদী
তা আমি জানতাম। যেমন জানে ডিমের ভেতরকার পাখির কুসুম।
চিরকাল ভেবে এসেছি একটা নদীর লেজ ধরতে পারলেই
আমার গন্তব্যে অর্থাৎ মস্তকে গিয়ে দাঁড়াবো। একেবারে ফণার ওপর।
এক মধ্য দুপুরের নদী যেখানে বাঁক ধরেছে সেখানে পৌঁছেই
দেখি ডাঙা জুড়ে কেবল কবরের সারি। সমাধিলিপিহীন
শত শত গর্ত।
শকুনীরা ডানা খুলে রোদ পোয়াচ্ছে। এখানেই তো আমার
থমকে দাঁড়াবার পালা। যাদের সাথে কিংবা সামান্য আগে-পরে
আমার যাত্রা, তারাই এখানে শুয়ে। আমার সালাম নিরুত্তর।
তবুও আমার বুক কাঁপলো। কারণ বাতাসে ভাসছে
শহীদের কাফনে ছড়ানো গোলাপের নির্যাস। যা কেবল
সহযোদ্ধার নাসিকা ছাড়া কোনো বেইমানের নাসারন্ধ্রে
ঢোকার কথা নয়।
আমার ভেলা আবার ভাসলো। আমি নামহীন সমাধি প্রান্তর
পেছনে ফেলে আমার পতাকা উড়িয়ে দিলাম।

সাতাশটি বছর বাতাসের মুখে লাগাম দিয়ে যেখানে এসেছি
সেখানে যোদ্ধার মুখোশপরা শেয়ালের হুক্কাহুয়ায়
নগরবাসী নিথর।
অথচ এর প্রতিটি তোরণ, মিনার ও স্মরণসৌধ আমার চেনা।
পান্থশালাগুলো গিজ গিজ করছে মুখোশধারী প্রমোদলোভীদের ভিড়ে
কবিদের পচা পদ্যে কেবল ভাঁড়ামি ও হালুয়া রুটির গন্ধ।
মানচিত্রের বেসাতকারীদের গায়ে পণ্ডিত্যের পোশাক। আর
শীতের পাখি বিক্রেতার মত কে যেন বাংলাদেশকে হাত বাঁধা
হাঁসের মত ঝুলিয়ে হাঁক দিচ্ছে, সস্তা, খুব সস্তা, আসুন।

গতিই আমার নিয়তি / আল মাহমুদ

সবার মধ্যেই দেখেতে পাচ্ছি আমাকে নিয়ে উদ্বেগ। আমার দিকে তীর্যক চোখের দৃষ্টি।
ফিসফিসিয়ে কথা। এই তুমি লাইন ভেঙে এগুচ্ছো কেন? দেখছ না আমরা আছি?
আমরা তোমার মুরব্বী। বয়সে তো বড়?

আমি বুঝলাম না, আমার একটা পা একটু আগ বাড়ানো বটে। কিন্তু আমি তো লাইন ভেঙে যাইনি।
আমি তো নড়িনি। কেন সবাই ভাবছে আমি তাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছি?
আমার চেহারাটাও আমি যতদূর জানি বেয়াদবের মতো নয়। তাছাড়া আমি
অদৃশ্য পাখা কোথায় পাবো? আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেন
মানুষ ভাবে আমি তাদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছি? ভেতর দিয়ে
চলে যাচ্ছি? ভেদ করে যাচ্ছি, প্রভেদ করে যাচ্ছি?

হায় আল্লাহ! প্রভু আমার আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেন গতির সৃষ্টি হয়।
আমি স্থানু। কিন্তু অন্যের বিবেচনায় অশ্বারহী। যদি আমার নিয়তি আমাকে
এমনভাবে আকাশ ফাটানো বিদ্যুতের ঝিলিকে ছড়িয়ে দেয়, আমার কী করার আছে?

ঘাড় ফিরিয়ে দেখি সবাই আমার চেনা, আমার আত্মীয়, পরম কুটুম্বের মুখোশে ঢাকা
ওইসব প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখোশ টেনে ছেঁড়ার দায়িত্ব তো আমার নয়, আর আমি দাঁড়িয়েও
থাকতে চাই না। লাইন ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার যে নেই, এমন তো নয়।

আমি তো প্রকৃতপক্ষে সব সীমা ছাড়িয়ে উপচিয়ে পড়তে চাই। কিন্তু আমি
বিবেকহীন নই, ধর্মহীন নই, মানুষ্যত্বহীন নই। যারা আমার পোশাক টেনে ধরেছে
তারা জানে আমাকে আটকে রাখার ক্ষমতা তাদের আর নেই। আমাকে পরাভূত
বানাতে পারে যারা, তারা তো কেউ এ লাইনে এসে দাঁড়ায়নি। দাঁড়ায়নি অবশ্য
তাদের অনুকম্পার জন্যে, ভালবাসার জন্যে। এ প্রতিযোগিতায় সেই নারীকেও
দেখছি না, যার ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে আমি ভষ্ম হয়ে যাই এই ভয়ে পৃথিবীতে সারা
জীবন আমি পালিয়ে বেড়ালাম। গাছের আড়ালে, পর্বত ও গিরি-শৃঙ্গের
পেছনে মুখ লুকিয়ে থাকলাম।
কিন্তু তবু আমার লাইনের অগ্রগামীরা ভাবছে আমি তাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছি। মাড়িয়ে
যাচ্ছি কিংবা সবাইকে হারিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছি।

আমার আত্মার ভেতরে এক গোপন প্রেরণার শিখা দেখতে পাচ্ছি বটে। কিন্তু আমি তো
তা নিজে জ্বালাইনি। আমার প্রভুর দিকে বার বার সিজদা দিতে দিতে
অকস্মাৎ মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি কী যেন একটা ঘটে গেছে। আমার
সুরত আগের মতোই ঠান্ডা, চোখে বিদ্যুতের বিভা। কেউ না জানলেও
আমি তো জানি আমার পিঠে অগ্রভেদী দু’টি ডানার নিক্কণ। আমি
ছাড়িয়ে যাবো এটা কোনো ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হলো, যারা আমার দাঁড়িয়ে
থাকাতেও গতির বিদ্যুৎ দেখতে পায় তারা ঈর্ষাকাতর। মৃত্যুর স্তব্ধতায় তারা স্থবির।
যারা নিঃশ্বব্দ গতির ধাবমানতাকে নিজেদের মাথা দিয়ে মাপে তারা বামন।

আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও তাদের ছাড়িয়ে যাই।

হৃদয় ভাঙার শব্দ / আল মাহমুদ

হৃদয় ভাঙার শব্দে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়।
বিছানায় হাতড়ে ফিরি। শুন্য একটা বালিশ রয়েছে-
তুলোর বালিশ
কেশতেলের গন্ধে ভরা নারীর বালিশ, ছেঁড়া চুলও আছে হয়তো লেগে
অথচ হৃদয় ভাঙার যে শব্দে কবিদের ঘুম ভেঙে যায় সেটা তো প্রকৃত পক্ষে মুগুরের শব্দ।
ইট ভাঙা মুগুরের শব্দ
প্রতিটি বাড়িতেই ঝুর ঝুর ভেঙে পড়ছে রাঙা ইট। ভাঙা ইট
দু’দিকে দুইখন্ডে ফাঁকা।
হৃদয় ভাঙার শব্দে ঘুম পায়, ঘুম ভেঙে যায়
বলো কার সাথে কথা বলে কবি। পৃথিবী ভাঙার শব্দে
নেশা ধরে গিয়েছে খুনীর
বলো কার সাথে কথা বলে কবি
গ্রাম থেকে ধরে আনো কৃষ্ণকেশী দীর্ঘবেণী দেশোয়ালী যুবতীকে ফের
ধরে আনো নগরের পিতলাচোখী স্বর্ণকেশী সুচতুরা নাগরীকে এক
শোয়াও কবির বিছানায়
হৃদয় ভাঙার শব্দ দাও- তার কর্ণকুহরে। বলো প্রিয়তমা
হৃদয় ভাঙার শব্দ শুনুক সে, তুমি পথে বসে থাকো স্থির
চতুরতা করো নাকো, ছন্দ শিখে শুঁকে হয়ে যাও পুরুষ বালিশ।

অন্তিম বাসনার মতো / আল মাহমুদ

আরেকটু এগোতে চাই। বান্ধবহীন এ মহাযাত্রায়
আর কয়েক পা। দেখো
সমাপ্তির কাছে এসে পায়ের মাংস ফুলে উঠেছে,
হাঁটুতে বিদ্যুৎ। ভর রাখার জন্য টলটলায়মান মাংসপেশী।

যারা কাঁধ বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের মধ্যে
বন্ধুত্বের বিচার করা আমার আর সাজে না।
ভর রাখতে চাই এখন যে-কোনো শত্রুর কাঁধে
যদি তার আস্তিনে লুকানো থাকে বাঁকা ছুরি,
তবে তা আমূল বসিয়ে দিক আমার বুকে।
আমার বক্ষস্থল যে-কোনো অস্ত্রাঘাতের বেদনায় চেয়ে
তোমরা বৃহত্তরই পাবে।
আমাকে শুধু এইটুকু পথ অতিক্রম করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে দাও।
আমার অন্তরাত্মা সীমান্ত ছাড়িয়ে এখন স্বপ্নের মধ্যে পাখি হয়ে উড়ছে।
আমি কি আর কোনো মিত্র খুঁজতে পারি?
যার কাঁধে ভর রেখেছি, ও নির্ভরতা তুমি কি নারী?
শাড়ি পরা?
আমার স্পর্শে তোমাকে আমি পুরুষ বানিয়ে দিতে পারি
কিন্তু এর বিনিময়ে আমাকে উপচে উঠতে দাও;
পেছনে যেতে দাও।
শুধু সীমার ওপারে একটা পুরু পা না হোক
নখের কিছু অংশ মাটি খামছে ধরুক এখন।
আমি শত্রু বা মিত্র কারও চেহারার দিকে
তাকাবার অবস্থায় নেই। যদি কোনো দুশমন
মুচকি হেসে বলে আমিই তো তোমাকে
এত দূর আনলাম
তাহলে তাকেই সালাম।

স্বপ্নের মধ্যে এখন আমি পাখি হয়ে গেছি
উড়ছি, ঘুরছি নখ আঁচড়ে। মেঘের ভেতর
নিজের সমাধি ফলক বসিয়ে দিয়েছি।

ভেঙে যেয়ো না মা আমার / আল মাহমুদ

যেসব শিশুদের আমি একদা হাসতে খেলতে এবং হাঁটতে শিখিয়েছিলাম
এখন তারা আমার পঙ্গুত্ব চোখের নিষ্প্রভতা এবং
নিশ্চল নৈরশ্য নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছে।
আড়ালে নয় আমার সামনে। আমি ভাবি এটাই জগতের নিয়ম কিনা
আমি অবশ্য এতে কোনো চাঞ্চল্য অনুভব করি না, না-বেদনা না-দুঃখ।
কারণ আমি কালকে অতিক্রম করে আসা একটি নিভে যাওয়া
ধুমকেতু মাত্র, যেন তেজ হারিয়ে একটা শিলাপাথর। পৃথিবীর
গ্রানিটে শব্দ করে নিস্তব্ধতায় মগ্ন।

শুধু মানুষের শিশুদের যে হাঁটতে শেখাতে হয় এটা একটা
আশ্চর্য ব্যাপার। আর সব প্রাণী সয়ম্ভর, গর্ভ থেকে
নেমেই অনায়াস কর্ম-চঞ্চল। সাপের শিশু মায়ের মতো ফণা ধরছে
মায়ের মতোই বীষ সঞ্চারিণী, বাঘের শিশু হিংস্র, ঈগলের
বাচ্চা টেনে ছিঁড়ে কেড়ে রক্তাক্ত উড়ালে উড়ে যায়।
পেছনে লুটায় জগৎ।
কিন্তু আমার শিশুরা প্রথম আমার আঙুল ধরে অতি কষ্টে
দাঁড়িয়েছিল। আমার হাঁটু আঁকড়ে মুখ তুলে দেখেছিল
পিতাকে। তারপর কোমর, তারপর বুক। এখন এদের মাথা
আমার সমান। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
হুইল চেয়ারে এঁটে বসছে কোমর, যা একদা শক্ত চামড়ার
বেল্টে বাঁধা থেকে হিমালয় ডিঙাতে চাইতো।

আমি কী দেবে যাচ্ছি?

আমি কী বলব ধরণী দ্বিধা হও? না। এবং
আমি দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবীকে আমার কম্পমান হাত দিয়ে
বুকে জড়িয়ে ধরতে চাই। বলতে চাই ভেঙো না ।
ভেঙে যেয়ো না মা আমার।

শুধু মানুষের বাচ্চাকেই হাঁটাতে হয়। মুখের ভেতর পুরে
দিতে হয় মাতৃস্তন, যতক্ষণ সে মাংসাশী না হয়ে ওঠে।

৭/ ১১/ ০৪

স্বপ্নের ভেতর দর্জি মেয়েটি / আল মাহমুদ

রাতভর বৃষ্টি। আর সেলাই কলের শব্দ। কে এই যুবতী?
ক্রমাগত সেলাই করে চলেছে ভাসমান মেঘের সাদা থানগুলো
সে কি সেলাই করছে আমার জন্য কাফন? তার মুখ আমি
বিদ্যুতের ঝলকের মধ্যে একবার মাত্র ঝলসে উঠতে দেখেছি।
অচেনা ঘর্মাক্ত চেহারা। নাকের নাকফুলটিতে একটিমাত্র জোনাকি।

খাটের উপর উপচে পড়ছে এক প্রবল পুরুষের নগ্নতা।

মেয়েটি আমার চেনা নয়। কিন্তু তাকে অচেনা বলার সাহস
আমি
সর্বত্র হাতড়ে বেড়িয়েছি। যতবার
হাত বাড়িয়েছি নীলিমায় ততবারই আমার নখের ভেতর
উঠে এসেছে চূর্ণ নক্ষত্রের গুঁড়ো।
ঠিক ওই মেয়েটির নাকে ঝুলানো নাকফুলের বিন্দু।
সবই তো চেনা। সেলাইয়ের মেশিন এখন জোড়া লাগাচ্ছে
সবগুলো মেঘস্তরকে। সেলাই বিহীন কাফন কে দেবে আমাকে?
মেয়েটির মুখ একবার আমার দিকে ফিরল
সে কি এখন একজন কবির নগ্নতা মাপার ফিতে বের করবে?

এই অক্লান্ত, অলৌকিক দর্জি মেয়েটির জন্য আমি আরও একবার
পাশ ফিরে শুতে চাই। সে আমাকেই মাপুক যাতে তার
কাটা কাফনের পিরহান আমার সাথে খাপ খেয়ে যায়।
সারারাত এই বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে দর্জি মেয়েটি
জোড়া দিয়েছে মেঘস্তর। তার গাল বেয়ে নেমে এসেছে
ঘামের বিন্দু। আমি তার জন্য পাশ ফিরে শুয়েছি
সংবরণ করেছি পৌরুষ।
নখ থেকে ঝেড়ে ফেলেছি নক্ষত্রের চমক।
আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাক ওই সেলাই কলের শব্দে।

কেন যে দর্জি মেয়েটি মেঘের পর মেঘস্তর জোড়া লাগিয়েে
আমাকে ঢাকার আয়োজন করছে তা সেই জানে।

আজ আমি তার জন্য বারবার পাশ ফিরে শুয়েছি
বালিশ ভিজিয়ে দিয়েছি চোখের জলে
বৃষ্টি ও অশ্রুজলের নদী আমার পালংক ছাপিয়ে
পৃথিবীর পেটের ভিতর আছড়ে পড়েছে।
কিন্তু সেলাই কলের শব্দ সব কিছু ছাপিয়ে এখন আমার
রক্ত মাংসের উপর এসে ঝিমঝিম করে বেজে চলেছে
আর সেলাইয়ের সুতোয় বাঁধা পড়ে যাচ্ছে আমার দীর্ঘ আয়ুষ্কাল।
পৌরুষ ও প্রবৃত্তি। কে এই অচেনা দর্জি? তার নাকফুলে
আমার আত্মা জ্বলছে।

২৪ জুন ২০০৪

জিদের শহর / আল মাহমুদ

জিদের শহরে আছি। এ শহরে কেউ বুঝি মচকায় না কোনোদিন।
হেলে পড়ে না, কাত হয় না, চিৎ হয় না।
কেবল আকাশের দিকে মাথা তুলে গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
মৃত্যুর গর্জন কিংবা বিদ্যুতের ঝলসে ওঠা দেখে পাখিরা অন্ধকারেও ঝাঁপ দেয় যেখানে, পশুরা পালায়।
ওই তো একটা চিতল হরিণী দিগ্বিদিব জ্ঞানশূন্য হয়ে কেওড়ার কাঁটায় ঝাঁপ দিচ্ছে।
ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাপ্লুত শরীর নিয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলে যাচ্ছে বরাহের দল।
অজগর হাঁ গুটিয়ে ডুবে যাচ্ছে মাটির ফাটলে।
কিন্তু এই জিদের শহরে দাঁড়িয়ে আছি তুমি আর আমি।
কী হতো একটু কাত হলে? একটু নুয়ে পড়লে? ঠাস ঠাস শব্দে
ছুটে আসা সীসের পিন্ড চলে যেত কানের পাশ দিয়ে
হৃৎপিন্ডের বাঁ দিকে হাই তুলে মৃত্যু
বাতাসে মিলিয়ে যেত।
কিন্তু ভেঙে গেলে তুমি। যেমন ভেঙে যায় চিরস্থায়ী সেগুনের শির।
উপচে পড়ছে রক্তের ফোয়ারা। মৃত্যু তোমাকে শুইয়ে দিয়েছে ভেঙে মুচড়ে দুমড়ে।
ও আমার প্রিয়তমা মাঙসপিন্ড, লুটিয়ে থাকো এই জিদের শহরে
এই জিঘাংসার কংক্রিট সিঁড়িতে।
হে জিদের শহর, মানুষের রক্ত এত লাল কেন?

আমি কাত, চিৎ, অবনত, অবহেলিতের একটিমাত্র মাথা।
কারো পদতলে লুটাইনি কোনোদিন। কিন্তু মচকে যেতে জানি, ঝুঁকে পড়তে জানি, সরে দাঁড়াতে জানি।
গুলি ও স্প্লিন্টারের ধাতব শব্দ কতবার আমার বুকের পাশ দিয়ে চলে গেছে। আমি কি মৃত্যুকে জানি না?

আগুন ও গন্ধকের ভেতর  আমাকে সাঁতার শিখিয়েছিল কুলটা এক নারী।
আমি বাঁচতে চাই বলে তাকে উদঘাটন করি না, তার শাড়ির বাো আমাকে মানবগন্ধী করে তুলেছে।
এখন আমি কী করি বলো? আমি সর্বপ্রাণীকে শুঁকে দেখেছি।
আল্লার কসম, মানুষের মাথার গন্ধের চেয়ে মিষ্টি গন্ধ
পাথরে, প্রান্তরে, উপত্যকায়, পশুতে,
পাশবিকতায়, সবুজে, শ্যামলিমায়, প্রকৃতিতে
বিকৃতিতে কোথাও নেই।
ও মানুষের মাথা, পাথর হয়ে যেও না, গাছ থেকে যেও না,
কংক্রিট পাষাণ হয়ে যেও না।
কাত হও, চিৎ হও, মচকে যাও। শুধু
লুটিয়ে পড়ো না।

০৪.১০.০৪

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: