উৎসর্গ কবিতা; বখতিয়ারের ঘোড়া / আল মাহমুদ

আজ বারুদের ধোঁয়ার আড়ালে কারা লুকায়?
কারা জালিমের ছলনার ফাঁদে পড়ে ধোকায়?
এ জেহাদে তার ঠাঁই নেই, যারা তোলে দেয়াল
তাড়াও তাদের যারা মোনাফেক কালো শেয়াল।

হুদহুদ পাখির কৈফিয়ত / আল মাহমুদ

ও রাজা সোলেমান,
কেন আমার একটু এদিক ওদিক উড়ে বেড়ানোতে আপনি এমন তিতিবিরক্ত?
আল্লাহ আপনাকে মানুষের, জিন ও হাওয়ানদের রাজা বানিয়েছেন।
ও বাতাসকে হুকুম করার মালিক,
সহস্র প্রাণের উপর দয়া দেখানোর জন্যই তো নবী-রসুলগণ আসেন
পৃথিবীকে নরম করতে।
আপনি পিঁপড়ে থেকে শুরু করে আমার মত হুদহুদ পাখিরও ভাষা বোঝেন।
বোঝেন প্রতিটি অশ্রুসিক্ত নয়নের অনুনয়। আর পাখির স্বভাবই
যেহেতেু অনুসন্ধিৎসা এবং কবির মতো ডানা মেলে ভেসে বেড়ানো
তার বেয়াদপীর প্রতি কে আর অতো খেয়াল রাখে?
উড়াল ও আড়ালে থাকাই পাখিদের জন্য কল্যাণকর।
ও নবী সোলায়মান আলায়হিসসালাম,
আমার ক্ষণ-অনুপস্থিতি ক্ষমার্হ, কারণ আমি আপনার বিস্ময়বোধকে
উদ্রিক্ত করার মশাল নিয়ে এসেছি, এনেছি এক অদ্ভুত দেশের মানচিত্র।

ও পিঁপড়েদের কথা অনুধাবনকারী,
আমি কি আমার পালকের চেয়েও অধিক আনন্দ সংবাদ
এনে রাজকীয় পুলকের উৎসমুখ খুলে দিইনি?
আপনার আজ্ঞায় বাতাস আমাকে ভাসিয়ে নেয় দূরে দূরান্তরে
জিনেরা অজানা দেশের পাকা মেওয়া এনে রাখে আমার ক্ষুধাতূ চঞ্চুর সামনে।
আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আপনার সোহবতে থেকে আমি
দুনিয়ার সাদাকালো হলুদ সকল আদম জাতির ভাষা এখন বুঝতে পারি।
আহা মানুষের ভাষা যদি আমার জন্য দুর্বোধ্য হতো কতই না ভাল ছিল।

হে নবীমহামতি,
আমার বাচালতা মার্জনা করুন। মানুষ যা কিছু বলে এর অর্ধেকই
মিথ্যে প্রতিশ্রুতি যা কক্ষনোও রক্ষিত হয় না।
আর মানুষের মেয়েরা তারা যত সুন্দরীই হোক তারা
মিথ্যার ব্যাপারে একেবারে শেবার সর্বোচ্চ মন্দিরতুল্য। সোনাদানায় সাজানো।
আমার ক্ষণ-অনুপস্থিতি আনার তীক্ষ্ন দৃষ্টির রাজকীয় মর্যাদাকে উদ্বিগ্ন না করুক।
কারণ আমি নিয়ে এসেছি পুর্বদিগন্ত থেকে এক নারীশাসিত উর্বর ভূমির খবর। যে দেশ
আল্লাহর ব্যাপারে নিরাসক্ত কিন্তু উপাসনা ধরেছে উদিত সূর্য ও পৌত্তলিকতার।
ও সহস্র রথের মালিক মহারথী রাজা সোলেমান,
আমি নিয়ে এসেছি সেই পতাকা ও পুজোর রাজ্য
শেবার সেই দিগভ্রান্ত রাজ্ঞীর খবর। যিনি কোটি মানুষের আনুগত্যের
বিনিময়ে চাপিয়ে দিয়েছেন এক স্বৈর সিংহাসন, দুর্ভার, পাষাণ।

আপনি তো জানেন রাজা
রাজ্ঞীর শাসন মানেই তো দেশ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া। নদী শূন্য
খরা, কুয়াশা ও মুকুল ঝরে যাওয়া।
পুরুষের অনুপস্থিতি হলো স্বাধীনতা ও সীমান্ত সংকোচিত হয়ে আসার আলামত।

আক্ষেপ সেই দেশের জন্য
যেখানে সহস্র পুরুষের বাহু পেশীবহুল কিন্তু তীরন্দাজ হয়ে আছে নারী।
রাজপুরুষ, জ্ঞানী অধ্যাপক, কবি-বিদূষক এবং সেনাপতিগণ নির্বাক
মাথা নত করে থাকে রাজপুরুষেরা এক অহংকারী,নির্বোধ রাণীর স্বেচ্ছানর্তন ও
হিংস্র খেয়ালের কাছে।
কে না জানে রাণীদের ঠোঁটে ও অন্তর্বাসে কোনো টেরচা সেলাই থাকে না।
মাতৃরূপ ত্যাগ করলে নারীর চেহারায় আর নেকড়েনীর মুখের পার্থক্য ঘুচে যায়।
পৃথিবীর মৃত্তিকায় শান্তির প্রতিশ্রুতি দানকারী
ও পয়গম্বর রাজা সোলেমান,
কয়েক লহমার জন্য আমার অনুপস্থিতি ক্ষমা করুন। আর পূর্বদেশের
সেই নারীরাজ্যের মহারাজ্ঞীর প্রতি এক হেদায়েতের বার্তা লিখে
আমার গলায় ঝুলিয়ে দিন।
আমি তা পৌঁছে দিতে
আমার পাখা মেলে আছি।

দেশ মাতৃকার জন্য / আল মাহমুদ

একজন কবি আর কি দিতে পারে? এই নাও আমার পরিস্রুত ভাষা
নাও কবিতা-
আমার রক্ত। কলমের কালির চেয়েও মহার্ঘ। নাও আমার অশ্রুজল
দ্যাখো এতে যদি তোমার মরে যাওয়া স্রোতগুলো
নদীকে বিহ্বল করে ঘোলা পানির তোড় নিয়ে
সমুদ্রের দিকে ধাবমান হয়।
নাও অক্ষিগোলক। যদি এতে তোমার ভবিষ্যৎদৃষ্টি একবিংশ শতাব্দীকে
দুটি তীক্ষ্ন তীরের মত গেঁথে ফেলে। আমার চামড়া দিয়ে তোমার
রাঙা পায়ের জুতো বানিয়ে দিলাম। পরো।
আর হেঁটে যাও আগামী দিনের দিগবলয়ের দিকে।
পৃথিবী দেখুক আমার সমস্ত গান পাখি হয়ে তোমার শরীরে বাসা বেঁধেছে
আমার শব্দ তোমার শাড়ির পাড়ে মাছের আকৃতি নিয়ে
ঝাঁক বেঁধে সাঁতার কাটছে, তোমার ঘোমটায়।
দেখুক আমার ছন্দ তোমার কণ্ঠহার হয়ে দুলছে। আর
আমার উপমা?
তুমি তো জানো তোমার সাথে তুলনা দিই এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই।
চির দুঃখিনী মা আমার
তোমার ঐশ্বর্যই তোমার শত্রু। যেমন আপন আপন মাংসে
হরিণী বৈরী।

চারদিকে শকুনীর উড়াউড়ি দেখে ভাবি তোমার শ্যামল প্রান্তর
হিংস্র মাংসাশী পাখির বিষ্ঠায় আকীর্ণ বটবৃক্ষের মত কেন?
আমরা কি তোমাকে রক্ষা করতে পারব? অযোগ্য সন্তান আমরা।
তবুও তো তোমার শস্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
তোমার রুদ্ধ নদীগুলোর ইশারায় আমরা কাঁপছি।
তোমার পর্বত যেন মাতৃস্তনের মত ভালোবাসার গহিনে
আমাদের জন্য আহ্বান।
তোমার প্রান্তর যেন রেখায়িত মাতৃ উদরের মত। যেখানে আমাদের উদ্ভব।
কে বলে পরাজিত তুমি? চির বিজয়িনী তুমি কোটি কোটি
ঈমানদার মানুষের ধাত্রী।
তোমার জন্য তোমার সন্তানদের অদেয় কি কিছু আছে? অথচ নামগোত্রহীন
ডাইনিরা তোমাকে নিয়ে পাশাখেলায় মত্ত। তারা বাজি রাখে
তোমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের
তারা তোমাকে চির ক্রীতদাসী বানিয়ে তোমার অঙ্গে পরিয়ে দিতে চায়
দাসত্বের বল্কল।
কিন্তু তোমার সন্তানেরা জানে, ও আমাদের তৌহিদবাদিনী
অবগুণ্ঠিতা জননী জাগ্রতা
পৌত্তলিক ধুম্রকুণ্ডলী থেকে তুমি একদিন বেরিয়ে আসবেই।

তোমার নদীগুলো আবার সমুদ্রের দিকে ধাবমান হবে। চিম্বুক পাহাড়
হবে তোমার স্তনাগ্রচূড়ার মত মাতৃত্বের গৌরব।
ডাইনিদের পাশার ঘুটি একদিন ইতিহাসের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হলে
স্বাধীনতার গান গাইবে তোমার কিষাণ-কিষাণীরা।
আমরা এভাবেই তোমার আশাকে জাগিয়ে তুলি। আশাইতো
তোমার ভবিষ্যত ও ভরসা। প্রন্তরে তোমার চরণেরা
দ্যাখো ভবিষ্যতের গান ধরেছে। আল্লাহর প্রশংসার গান।
আগামীর আনন্দের গান। এই গানে তোমার শস্যক্ষেত্রগুলো কি
শ্যামল হয়ে উঠবে না?

প্রার্থনার ভাষা / আল মাহমুদ

একটু জানান দাও হে প্রভূ, তুমি হাল ধরে আছো আমার মত এক
টলটলায়মান দিগভ্রান্ত নৌকোর।
জানান দাও
তুমি আছ এক ছেঁড়াখোড়া আর সাত তালিমারা পালের ফুলে ওঠা
অদৃশ্য বাতাস হয়ে।
আমি পাড়ি দিয়ে এসেছি পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গের উল্টো দিক থেকে
সময়ের উল্টো দিক থেকে আমার যাত্রা।
আমি পেওছুব তোমার নির্ধারিত কিনারে। তোমার নির্বাচিত উপত্যকায়।
আমার আয়োজন
তুমি তো জানোই কেমন অকিঞ্চিতকর। আর তোমার ছায়া কত
দিগন্ত বিস্তারী।
আমি পেরিয়ে এসেছি ঢেউয়ে ঢেউয়ে অপেক্ষমান শত সহস্র ঝাঁক বাঁধা
অতিকায় হাঙরের মুখ। তারা বার বার কামড়ে কামড়ে বিক্ষত করেছে
আমার পাটাতন। আমি দুহাতে লোনা পানির স্রোত ঠেকিয়ে
মেরামত করেছি আমার অমার অর্ধমগ্ন তলদেশ।
তোমার কাছে পৌছার অদম্য ইচ্ছা আমাকে দিয়েছে
সব ছিদ্র বন্ধ করার নিগূঢ় শক্তি।
আমাকে খুবলে খেতে চেয়েছিল যে দরিয়ার দাঁতাল দানবেরা
ভুস ভুস শব্দে তাদের ব্যর্থ নিঃশ্বাসের পানিতে আমার
সর্বাঙ্গ সিক্ত করে তারা হারিয়ে গেছে
অথৈ লবনের সায়রে।
এখন দ্যাখো বিজয়ীর মত আমার মাস্তুল ভেসে উঠেছে।
প্রতিটি সর্বগ্রাসী তুফানের অন্তিম আঘাতের পর। আমি বোবা হয়ে গেলেও
কথা বলার মিনতিতে আমার বক্ষস্থল স্ফীত।
এলাহি, আমাকে ভাষা দাও প্রভু। মিনতি করার ভাষা।
ক্ষমা প্রার্থনা এবং পাপ মোচনের শব্দ এখনও আমার অনায়ত্ত
আমার চাই প্রার্থনার ভাষা, যা কাব্য বা কান্না নয়। বরং
আত্মনিবেদনের মানবিক অনুতাপ। যেমন হযরত আদম তার
শরীরছেড়াঁ সঙ্গিনীকে নিয়ে অপরাধী কপাল বেহেশতের ধূলিতে
স্থাপন করে বলেছিলেন ক্ষমা প্রভু
একটিবারের মত ক্ষমা।
তিনি মেনে নিয়েছিলেন নির্বাসন। মেনে নিয়েছিলেন পৃথিবী
মেনে নিয়েছিলেন, শ্রম ঘাম কাম সন্তান সংসার, রোগ এবং পুত্রশোক।
কিন্তু আমি সেই আদি পিতা-মাতার অবহেলার পুত্র
আমার কাছে পৃথিবী দুঃসহ
প্রতিটি গ্রহ, তারকা, উদয়াস্ত দুঃসহ।
দুঃসহ মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি।
মানুষের আগ্রহ যেখানে-সেখানে পাড়ি জমাতে সক্ষম, সর্বত্র।

মানুষের নভোযান, খেয়া আর প্রযুক্তি তাড়িত বিশাল যান্ত্রিক উৎক্ষেপ
সবি নিরর্থক স্বপ্নের জ্বালানিতে ব্যর্থতার সমুদ্রে সাঁতার মাত্র।
আমি চাই অন্য কিছু।
আমার গতি তুমি তো জানো প্রভু কোন দিকে ধাবমান!

আমার রক্তে-মাংসে সেই ফেলে আসা ‍চুম্বকের টান।
যেখান থেকে আমাদের পিতা-মাতা
কেবল জ্ঞানের লোভে, অমরতা ও আত্মতৃপ্তির আকাংখায়
একদা কানাকড়ি মূল্যে হেলায় হারিয়েছিলেন বেহেশত। সেই
মহাউদ্যানের টান আমার রক্তে, আমার মাংসে ও মজ্জায়।
দাও তাকে ফিরিয়ে আমায়।

প্রার্থনার ভাষা দাও প্রভু, নির্জ্ঞান আত্মসমর্পণের
সহজতা।
আমি কি পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি না হাঙরসংকুল সমুদ্রের চেয়ে দুরুহ
যে আয়ু?
সেই দিন এবং রাত্রি?িউদয় আর অস্ত।
আঁধার এবং আলো। না
আলো আর অন্ধকার আর না। জ্বলুক তোমার নূরের দীপ্তি
যা ভেদ করে যায় পৃথিবীর উদবে লুকানো সমস্ত গলিত ধাতুর
সাতপরত পর্দা।
পৌঁছুতে চাই প্রভু তোমার সান্নিধ্যে
তোমার সিংহাসনের নীচে একটি ফুরফুরে প্রজাপতি হয়ে।
যার পাখায় আঁকা অনাদিকালের অনন্ত রহস্য।

১৫.১.৯৮

গন্তব্যের কাছাকাছি এসে / আল মাহমুদ

নদীটা পেরিয়েই মনে হল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সব শব্দ আমাকে ছেড়ে গেছে।
ঢেউ, বৈঠা আর পানির ছলছলানির সাথে
এতক্ষণ নিরুদ্দেশ যাত্রার যে প্রতিবাদ উঠেছিল। আশ্চর্য
নৈশব্দের মধ্যে কখন সব তলিয়ে গেল।
শত্রুতাও কি এখন এমন সবুজ মাঠ? যতদূর চোখ যায়
বিদ্বেষ হয়ে গেছে পাকা ধানের দুলুনি?
আমার পরিশ্রম দেখে যারা একদা বলত, আর একটি মাত্র নদী
আর একটা খেয়াঘাট পেরুলেই আমি গন্তব্যে পৌঁছুব। এখন তারা
কোথায়? এই সোনার ধানের একটা মীমাংসা কি দরকার নয়?

আমার না হয় কোনো বন্ধু ছিল না।

কিন্তু যে বৈরিতার ঘূর্ণিতে আমি বার বার দিশেহারা
তারা এসেও কি এই সীমাহীন শস্যের একটা সিদ্ধান্ত দেবে না?
লুটে নেবে না আমার সোনার ধান? আমি সব রকম রাহাজানির
জন্য প্রস্তুত। অন্তত মানুষের কণ্ঠস্বরে বেজে উঠুক
রাগ, দ্বেষ, হিংসা-
যদি গুলির শব্দ আমাকে বিদ্ধ নাও করে।

সত্যি যদি গন্তব্যের কাছাকাছি এসে গিয়ে থাকি তাহলে
তোমার সেই মুখ
সেই প্রত্যাখ্যানের পুরনো ভঙ্গী কেন দেখব না? কেন শত্রুতার বদলে
এই চিরহরিৎ শোভা?
বাতাসে ধানের দোলা অথচ ফসল তোলার কোনো আয়োজন নেই।
আমার জন্য শত্রু বা বন্ধু কেউ তো থাকুক?

কেউ বলুক বা না বলুক জানি আমি শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি।
এখানে কোনোদিন কোনো মানুষের কৃতির হিসেব হবে না এ কেমন কথা?
অন্তত তিরস্কার করার মত কেউ কি নেই?
ভূমিহীনদের দীর্ঘশ্বাসের মত এই সীমাহীন সবুজ আমার কোন্ কাজে লাগবে?
নিরাপদ ধানের গন্ধে আমার সারা জীবনের ভুখ তিয়াসা
পেটের ভিতর গুলিয়ে উঠেছে।
এখন কে আমাকে ভাতের থালা এগিয়ে দিয়ে বলবে, খাও!
আমি না বুঝে জিততে চেয়েছিলাম বলে কি আমার মাঠ ঘাট প্রান্তর
প্রাচুর্যের নরক হয়ে যাবে?

২৫.৩.৯৭

অন্ধের ভূমিকা / আল মাহমুদ

ছিলাম তো মুখ ফিরিয়ে। ভেবেছিলাম উদয়াস্তে আমার কি ভূমিকা?
আলোর আভায় ও বিকিরণে আমি স্তস্তিত পাথরের পাথরের জমাটবাঁধা অন্ধকার মাত্র।
দায় ও দায়িত্ব থেকে দূরে দিন আর রাতের
নিয়মগুলেঅ আবর্তিত হোক। আমি জানবো না কারা পৃথিবীতে এল গেল।
আর অন্ধের ধর্ম তো স্থকিরতা। চোখ মেলে আছি অথচ দেখছি না কিছুই।
এ ছাড়া আমার অন্ধত্বকে আমি ঠিক অন্ধকারও বলি না। দেখিনা
বলেই কি কিছু থাকতে নেই? আমার বোধশক্তি এ চিন্তায়
অধোবদন। নইলে তো অনেক আগেই বলততাম, অন্ধকারের অর্থ কিছু নেই।

নেই যদি আমার চোখের মধ্যে এত ব্যাকুলতার পানি কোত্থেকে এল?
কেবল কি বাতাসের আনাগোনায় আমার স্নায়ু সুখ পায়?
যার চলাচলের জন্য আমার এই প্রতিক্ষা
কেন মনে হয় সে এলে আমি ঠিক টের পাব। ঐ টের অন্ধের আন্দাজ নয়।
সচলতার প্রতি অনুভবের উত্তর।না দেখার আফসোসের বদলে
অন্য শব্দ তখন আমার প্রাপ্য হবে। অন্তত না দেখার জন্য
আমাকে কেউ অন্ধ বলবে না। বরং অন্ধের সামনে সকলেই
তাদের লজ্জা আর অনাবরণ ঢেকে ফেলবে। আর আমি
তোমাদের বসনের শব্দে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাসব।

সকলের উদয়কালের আলো যখন জড় জগৎকে অতিক্রম করে
আর আমি নিমীলিত আঁখি, কেন মনে হয় আমার চোখের কোনো দরকারই ছিল না।
প্রয়োজন ছিল না কোনো স্পর্শানুভূতির। চোখ কান নাক বা
ত্বকের আবরণ আমাকে একটা মেশিন বানিয়ে ফেলেছে। আমি
দেখতে শুনতে শুঁকতে চাইনি। চাই না
এই তো অন্ধের আকাশে এক্ষুণি একটা চাঁদ উঠলো।
আর জোছনার শিরশিরানিতে ইন্দ্রিয়সমূহের ভেতর দিয়ে ছুঁচের মত
পার হচ্ছে এক আকারহীন অস্তিত্বের ঘোষণা।
হায় আমার অন্ধত্ব কি এতটাই স্বাধীন?

১২.৪.৯৭

খনার বর্ণনা : সনেট পঞ্চক (৫) / আল মাহমুদ

নারীর কামিনী দেহ যামিনীর তৃতীয় প্রহরে
আতর-চন্দনে লেপে যে পুরুষ একবার ছোঁয়,
নিখিলের নগ্নতাকে জেনো সে-ই আলিঙ্গনে ধরে
সৃজনের পঞ্চভূত তার সাথে একখাটে শোয়;

নিসর্গের নীতি মেনে এসো পতি, মেঘবৃষ্টি গণি
জগতের উপকার জ্যোতিষের শাস্ত্রে লেখা নাই;
ঋতুর বৈচিত্রে কাঁপে লীলাবতী খনার ধমনী
মাটির মাহাত্ম্য গেয়ে এসো দোঁহে লাঙলে দাঁড়াই।

কিষাণের সোনা জেনো কার্তিকের কর্ষনের কাদা
কোদালে-কুড়ুলে মেঘে যদি ঢাকে আকাশের রং
রবি খন্দ ভরভর্তি, কি করবে রাজার পেয়াদা?
এ জেনো কবির প্রজ্ঞা, নয় কোনো শাস্ত্রের ভড়ং।

কার্তিকে কুয়শা হলে জানো না কি আমার মুকুল
ঝরে মরে পড়ে যায়! দুনো ফলে তাল ও তেঁতুল।

খনার বর্ণনা : সনেট পঞ্চক (৪) / আল মাহমুদ

পান খাও হে পন্ডিত কথা কও রসভরা ঠারে
না জানো ভেষজবিদ্যা সার কর শাস্ত্রের বচন;
পানের মহিমা বলি শোনো স্বামী, খনার বিচারে
শাওন পানের মাস। এই লতা রাবণের ধন।

এই পান মুখে দিয়ে চার্বাকের বেদের বিরোধী
গুয়ার সোয়াদ চেখে পঞ্চমুখে ভজে ইহকাল;
তির্যক যুক্তিতে কাটে চতুর্বেদ, ব্রাহ্মণের বোধি;
বলে এ জগৎ সত্য অন্য সবি শূন্যের মাকাল।

খান তো অনার্য কন্যা প্রকৃতির ঠোঁটকাটা কবি
জমিনের গন্ধ শুঁকে ফলনের ভবিষ্য বাখানে;
পানের মর্তবা বলি, পানপাতা হৃদয়ের ছবি
দানবের শস্য পান। খনা জানে, পানের কি মানে!

পান খান পন্ডিতেরা কথা কন রসভরা ঠারে
না জেনে পানের মর্ম পান সেবে সব অবতারে।

৩.৫.৯৭

খনার বর্ণনা : সনেট পঞ্চক (৩) / আল মাহমুদ

নারীর দেহের চেয়ে নম্য কিছু নেই পৃথিবীতে
সব শাস্ত্র ঘেঁটে শেষে হে জ্যোতিষী নারীতে আরাম;
রোহিণী তারার ওম একমাত্র নারী পারে দিতে
মাতাবধূকন্যা কহ, নারী এক রহস্যের নাম।

মেদিনীর সাথে শুধু স্ত্রীদেহের তুলনা সরস
গবংসহা তনুদেহা মানুষের তপস্যার ফল;
কৃষির আরম্ভে নারী, পশুরাও নারীতে বিবশ
নারী শক্তি, নারী স্বাস্থ্য, জ্ঞানীদের পিপাসার জল।

এহেন ধনের বাড়া রাজসভা কি দেবে পন্ডিত?
জ্যোতিষের ছকে ফেলে গুণে দ্যাখো কোন্ ধন সেরা,
স্ত্রীধনের অমঙ্গল ডেকে আনে খনার অহিত,
চারুবাকী রসনার চারিভিতে কাঞ্চনের বেড়া?

তার চেয়ে মাঠে যাও, পড়ে গেছে বোশেখের বাও
আদা শিকড় ঝেড়ে বাঁশ বনে হলুদ লাগাও।

২.৫.৯৭

খনার বর্ণনা : সনেট পঞ্চক (২) / আল মাহমুদ

প্রকৃতির ছায়া আমি হে রাজন, আমিই সৃজন
মানুষের শুক্র ধরি। বুঝি উষ্ণ বীর্যের বেদনা,
ধানে ও কাউনে বাঁচি, রক্ষা করি চাষীর গোধন,
বরাহের পুত্রবধূ মিহিরের ঠোঁটকাটা খনা।

মাঘের শেষের মেঘে আকাশের কটোরা গড়ায়
তবু কেন বৃষ্টি নেই, নদী শুষ্ক, বলো কার পাপ?
খনার গণনা বলে দেশ জ্বলবে দারুণ খরায়,
ইঁদুরেরা তাজা হবে। রাজ্যে হবে চরের প্রতাপ।

ইঁদুর নিধনযজ্ঞে অঘ্রাণের আগে মহারাজ
প্রতিটি শস্যের গর্তে ছ্যাঁকা দিতে পাঠাও মুনীষ,
তবেই পৌষের রাতে প্যাঁচাদের মসৃণ আওয়াজ
শোনা যাবে শালিখেতে শাখে শাখে দোয়েলের শিস।

টিভির উত্তরে গিয়ে কদলীর কান্ড রুয়ো রাজা
দক্ষিণে মূলার খেত, খোলা থাক ভাগ্যের দরোজা।

১.৫.৯৭

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: