অন্ধকার হ’য়ে গেল পৃথিবীটা / আল মুজাহিদী

(হিরোশিমা : আগস্ট ১৯৪৫)

অন্ধকার হ’য়ে গেলো
অন্ধকার হ’য়ে গেলো পৃথিবীটা
এই গাঢ় অন্ধকারে
ঢেকে গেলো মানুষের মুখ
তবুও উন্মুখ আলোকণা জন্ম নেয়- এই মৃত ভস্মাধারে।
আগুনের ঝাঁজরা পোড়া মানুষের করোটি-রা
পড়ে থাকে প্রদোষের নিচে
এখনো দিগন্ত লাল
বেলাভূমে ছায়া নামে
‘নিসিকি’ সী-বীচে।
হিরোশিমা কাঁপে। কেঁপে ওঠে
বারবার। সভ্যতাও ফ্যালে অশ্রুজল;
নায়াগ্রার প্রপাতের
চেয়ে, আহা! আরো বেশি অবিশ্রান্ত
এ শোক প্রবাহি!
তবু থেমে নেই গান-
মানুষের পদপাতে
প্রগতির পথের নির্মাণ;
তুমি কি আসবে কাল?
হেসে ক্ষণকাল?
ভাঙবে এ অন্তরাল?
দিনের প্রথম আলো হাতে
দাঁড়াবে উঠোনে
ধ্বংস্তূপ পড়ে থাক দূরে, বহুদূরে
আলোকণা আছে আরও এই অন্তপুরে
প্রিয় প্রকৃতিকা,
কোথাও যেও না আর ‘অসুর-সংঘাতে’।
আমি জানি, পৃথিবীতে
প্রতিদিন সূর্যমুখী ফোটে
তোমার সূর্যও আশায় আশায়
জাগে। শুধু জেগে ওঠে।

আগুন নেভেনি, আগুন নেভেনা / আল মুজাহিদী

শান্তিবাদী বললেন, ‘শান্তিই যুদ্ধ থামাতে পারে।’
যুদ্ধংদেহী দানব বললে, ‘শান্তি নিস্ক্রিয় নিদানপত্র।’
কবি বললেন, ‘শান্তি একটা ইমেজ।’
তুমি বললে, ‘শান্তি একটি প্রতিমা।’
আমরা সকলে ভাঙতে ও গড়তে পারি।
শিশুরা বললে, ‘তোমরা আগুন নেভাও,
আমরা ভুল করে আগুনে হাত দিতে পারি।’
কতিপয় কাপালিক ভীষণ দ্রংষ্টাঘাত করলো
শিশুটির কোমল শরীরে।
ঘরে-ঘরে, ভেতর-বাইরে, পৃথিবীর প্রতিটি উনুনে
হিরোশিমায়, ফিলিস্তিন, কসোভায় আগুন জ্বলছে।
আগুন নেভেনি ব্যাবিলনে।
আগুন নেভেনা।
আণবিক চুল্লি জ্বলে দিনরাত
ধিকিধিকি।

নাগাসাকি সভ্যতার শেষকৃত্যে / আল মুজাহিদী

আমরা কি সূর্যকে আবার বলতে পারবো, ‘আমরা এখনও সেই নরকের জ্বলন্ত অঙ্গারে জেগে আছি।’
মানুষের মড়ার খুলিতে ধ্বংসের আগুন
আমাদের করোটিতে দজ্জালের খড়গ তুলে ধরা
আমাদের হৃৎপিণ্ডে দানব বাজাচ্ছে যুদ্ধের দামামা
তুমি কিন্তু এখনও জ্বলছো মাথার উপর আগের মতোই
সভ্যতার শেষকৃত্যে তুমি এখনও জ্বলছো।
প্রেয়সীর পোড়ানো শরীরে কিংবা স্তনবৃন্তে ঝরে পড়েছিলো
তোমার শেষ রশ্মি। আমি শুধু তোমার আলোর চিহ্ন থেকে চিনে নিতে
পেরেছিলাম আমার প্রিয়তমার আদল।
সূর্য, আমরা কি তোমাকে আবার বলতে পারবো, ‘আমরা এখনও
সেই নরকের জ্বলন্ত অঙ্গারে জেগে আছি।’
আমাদের নির্বাক করোটি
আমাদের অসহায় হৃৎপিণ্ড
আমাদের নির্বাসিত স্বাধীনতা
পৃথিবীর ঘরে ঘরে নিসর্গের লোকালয়ে
একেকটি মমির মতো জেগে আছে। নাগাসাকি,
তুমি আমার আত্মার ফলক চিহ্নিত সেনোটাফ
আমাদের শোক আমাদের দুঃখ জেগে থাকে এখানেই
শোকের মর্মরে নির্মিত এ ম্যুসলিয়াম।

পৃথিবী, আজ দেখছি তোমার নিজের মঙ্গল চেতনায় তুমি মগ্ন
আর আমি? প্রেয়সীর জন্য বিলাপ করছি
আর আমার পিতৃপুরুষের ফসিলের জন্য।
নাগাসাকি, তুমি বাংলার মৃত্তিকা থেকে কুড়িয়ে নাও
শতাব্দীর ঝরাপাতা
এলিজিগুচ্ছ।

হিরোশিমাবাসীদের উদ্দেশ্যে / আল মুজাহিদী

পূর্ব পুরুষের ইতিহাস ধরে রেখে তোমরাও ইতিহাস হলে। তোমরা
দেশের মাটিকে স্বর্গে ভরিয়ে তুললে। জোতজমিভরা সোনালি শস্য
আর উন্মুক্ত বাতাস আর তোমাদের অস্থিতে মজ্জায় নেচে ওঠে
জীবন্ত নিয়তি। তোমরা মুক্ত হলে অনন্তকালের কুঠুরিতে; আকাশের
এবং আকাশের চেয়েও দিগন্ত বিস্ত্ৃত অন্য কোনো অন্তরীক্ষে,
অন্তরীক্ষমণ্ডলে তোমার শোকার্ত পতাকা ওড়ে। আজ
তোমাদের চোখে মুখে দেখি শোকের জ্বলন্ত স্বপ্ন
তোমাদের পরনের ডোরাকাটা জামা, ট্রাউজার যেন নক্ষত্রের বুটিকরা পোশাক।
জানালার শার্সি খোলা।
দরোজাটাও হারিয়ে ফেলেছে কুলুপ বিগত দিনের ঝড়ে;
ক’টা তোতা পাখি তোমাদের ঘরে ঢুকে পড়ে আত্মবৃন্তে ব’সে পত্রালি দোলায়
আর গলা ছেড়ে গান ধরে তোমরা এখন মুক্ত।
চলো, আমরা হাত ধরাধরি করে বের হ’য়ে পড়ি
নগরের স্ক্যোয়ারে কিংবা উপত্যকায়। ঝর্ণার পানিতে নেমে
জলমগ্ন হই। সাঁতার কাটি এই অরণ্য শেওলায়।
বলো তো এ রকম জীবন কোথায় ছিলো, এতোদিন।
পাখিরা বললো, ‘আমাদের ভেতরেই।’

০৯/০৮/৯৩

হিরোশিমা নাগাসাকি শোকগাথা/ আল মুজাহিদী

হিরোশিমা, তোমার মাটিতে আজ নতুন বৃক্ষের সোপান। কুঁড়ি ফোটানোর
শব্দে, পৃথিবীর ঘুম ভেঙে যায়। তুমি বারবার জেগে ওঠো ধ্বংসস্তূপ
থেকে-অঙ্গীকার করো পাখির কুলায় আন্দোলিত দিন রাত্রি।
হিরোশিমা বলো, আমি কেন বারবার প্রকৃতির ভেতর সুনীল যন্ত্রণার ছায়া
দেখি। তোমার শোকার্ত বীজকণা ধ্বংসের অতীত থেকে বসন্ত হাওয়া
নতুন জীবন ব’য়ে বেড়াতে চায়।
আর আণবিক- বিভীষিকাহীন পৃথিবীর অঙ্গীকার দৃঢ়বদ্ধ হ’তে
থাকে। হিরোশিমা, আজ যেন প্রতিটি মানুষ জীবিতের প্রগাঢ়
নিঃশ্বাসে প্রতিটি গ্রহকে তোলে সহিষ্ণু-হৃদয়। বলো, আর
ক’বার পুড়বে এ-পৃথিবী-প্রগতি নন্দনতত্ত্বের মসৃণ কাগজপত্রে ?
বলো, আর ক’বার পুড়বে গোলাপ বৃন্তের সোনালি উদ্যান?
নক্ষত্র ও নীলিম নীলিমা? সূর্যের হৃৎপিন্ড থেকে আর কতো ঘটবে
রক্তপাত। হিরোশিমা, বলো আমরা কি ক’রে বাঁচিয়ে রাখবো আমাদের
যা কিছু নিজস্ব ! আমাদের দিনগুলো আমাদের রাতগুলো আমাদের
চৈতন্য, সংজ্ঞা, সত্তা, নিদ্রা এবং স্বপ্ন ? এসা, আমরা প্রার্থনা করি আমাদের
স্বপ্ন ও নক্ষত্রের জন্যে। আমাদের অন্তরিক্ষ, সূর্য ও নক্ষত্রের জন্যে।

০৭/০৮/১৯৯৩

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: