ওই নীল সমুদ্রশয্যায়
শুয়ে আছে সহস্র মানুষ। শুয়ে আছে, নাকি
ডলফিন হয়ে মৎস্যকন্যাদের সাথে নেচে নেচে গান গায়
সোনালি রুপালি জলের গহিনে, যখন ক্রীড়ায় মত্ত সব বসন্তের পাখি
ঝাঁক বেঁধে চঞ্চল চঞ্চুতে নিয়ে যায় তুলে ধবধবে সমুদ্রের ফেনা?
যেখানে উত্তাল জলের মিছিল আজ ফণা তুলে নাচে, ওখানে, লরেনা,
গিয়েছিল আকস্মিক জাহাজটি ডুবে। কি করুণ আর্তনাদে
কেঁপে উঠেছিল আকাশ বাতাস! যখন উন্মত্ত মৃত্যু তার নীল থাবা
হেনেছিল এখানে হঠাৎ, “কে যেন কোথায় কাঁদে!”
বলে হা-হুতাশ করে উঠেছিল সেইসব মানুষদের মা-বাবা,
ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তান। ছুটে এসে তারা, যেন ভেনাসের চোখে
চেয়ে চেয়ে দেখেছিল, মানুষের সব স্বপ্নসাধ চোখের পলকে
কিভাবে হারিয়ে যায় সমুদ্রের হাঁ-এর ভেতর। সিক্তচোখ তারা
গিয়েছিল ফিরে এই সত্য বুকে গেথে: সমুদ্র পাষাণ,
সমুদ্র কুৎসিত। কিন্তু আজ তুমি-আমি এখানে দাঁড়িয়ে যারা
কান পেতে শুনি উন্মাতাল সমুদ্রের গান
আর নির্বাক নিশ্চুপ
চেয়ে চেয়ে দেখি নৃত্যরত সমুদ্রের রূপ,
কী সাহসে বলি তাকে কুৎসিত হায়! বিপুল সুন্দর সমুদ্রের বুকে
কুৎসিতের ঠাঁই নেই; সব ব্যথা, সব দুঃখ, সব দীর্ঘশ্বাস
আনন্দের স্রোতে মিশে সুন্দরের এ মুলুকে
ভস্ম হয়ে যায়। শত শত লাশ
ও তাদের মৃত্যুপূর্ব আহাজারি নিয়ে একটি জাহাজ
ওখানে যে গিয়েছিল ডুবে, নেই আজ
চিহ্ন কোনো তার। দ্যাখো, জলেরা পড়েছে ফেটে
কি-উল্লাসে জলের সাম্রাজ্যে! তিমিরা করছে খেলা
লেজের আঘাতে ঢেউ কেটে কেটে
জলের ভেতর। রূপসী আকাশ সারা বেলা
জলের আরশিতে দেখে মুখ উঠছে ফুর্তিতে হেসে,
কাকে যেন ভালবেসে।
কি বিপুল লোক মারা পড়ে প্রতিদিন বিশ্বময়! কত দেশ, কত জাতি
পড়ছে হুমড়ি খেয়ে অহরহ দুর্ভাগ্যের অন্ধকারে; রক্তের তুফান
বয়ে যায় বারবার বাগদাদে-গুজরাটে; তবু জ্বলে সভ্যতার বাতি,
তবু ফোটে আনন্দের ফুল, কি বিপুল পাখি তবু বসন্তের গান
গেয়ে ওঠে একসাথে সভ্যতার ডালে! সমুদয় মৃত্যু-শোক এক ফোঁটা
জল যেন সমুদ্রের, আর গোটা
সমুদ্রই
জীবনের রূপ-রস-ভালবাসা-গান, অসীম, অথই।
৯.৪.২০১৩ মিলনমোড়, সিরাজগঞ্জ