জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ ,-
পাহাড়ের মতো ওই মেঘ
সঙ্গে লয়ে আসে
মাঝরাতে কিংবা শেষরাতের আকাশে
যখন তোমারে !-
মৃত সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে !
ছেঁড়া- ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে
তরাসে ছেলের মতো ,- আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে
অনেক সময়,-
তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে ,-চাঁদ ;-
পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়,
একদিন হয়েছে যা,- তারপর হাতছাড়া হয়ে
হারায়ে ফুরায়ে গেছে,- আজো তুমি তার স্বাদ লয়ে
আর একবার তবু দাঁড়ায়েছে এসে !
নিড়নো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চারদিকে,
শস্যের ক্ষেত চষে- চষে
গেছে চাষা চ’লে;
তাদের মাটির গল্প- তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে
অনেক তবুও থাকে বাকি,-
তুমি জান – এ- পৃথিবী আজ জানে তা কি !
পঁচিশ বছর পরে (মাঠের গল্প) / জীবনানন্দ দাশ
শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে—
বলিলাম—‘একদিন এমন সময়
আবার আসিও তুমি—আসিবার ইচ্ছা যদি হয়—
পঁচিশ বছর পরে।’
এই ব’লে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;
তারপর, কতোবার চাঁদ আর তারা
মাঠে-মাঠে ম’রে গেল, ইঁদুর-পেঁচারা
জ্যোৎস্নায় ধানখেত খুঁজে
এলো গেল; চোখ বুজে
কতোবার ডানে আর বাঁয়ে
পড়িল ঘুমায়ে
কতো-কেউ; রহিলাম জেগে
আমি একা; নক্ষত্র যে-বেগে
ছুটিছে আকাশে
তার চেয়ে আগে চ’লে আসে
যদিও সময়,
পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!
তারপর—একদিন
আবার হলদে তৃণ
ভ’রে আছে মাঠে,
পাতায়, শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে-দিকে, চড়ুয়ের ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে—পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা, ঠাণ্ডা—কড়্কড়্;
শসাফুল—দু-একটা নষ্ট শাদা শসা,
মাকড়ের ছেঁড়া জাল—শুক্নো মাকড়সা
লতায়—পাতায়;
ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়;
দেখা যায় কয়েকটা তারা
হিম আকাশের গায়—ইঁদুর-পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে-মাঠে, খুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজো মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!
পেঁচা (মাঠের গল্প) / জীবনানন্দ দাশ
প্রথম ফসল গেছে ঘরে—
হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে
হিম হ’য়ে আসে
বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা;
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা;
ধানখেতে—মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা;
ঘরে গেছে চাষা;
ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী—
তবু পাই টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের
কোনো সাধ।
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে,
শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে
মেঠো চাঁদ অার মেঠো তারাদের সাথে
জাগে এক অঘ্রাণের রাতে
সেই পাখি;
অাজ মনে পড়ে
সেদিনও এমনি গেছে ঘরে
প্রথম ফসল;
মাঠে-মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর,
কার্তিক কি অঘ্রাণের রাত্রির দুপুর;
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে,
শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে,
পাথার ছায়ায় শাখা ঢেকে,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে,
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জেগেছিলো অঘ্রাণের রাতে
এই পাখি।
নদীটির শ্বাসে
সে-রাতেও হিম হ’য়ে আসে
বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা,
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা;
ধানখেতে মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা,
ঘরে গেছে চাষা;
ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী,
তবু আমি পেয়েছি যে টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের
কোনো সাধ।
মেঠো চাঁদ (মাঠের গল্প) / জীবনানন্দ দাশ
আমার মুখের দিকে — ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়া জমি — খড়-নাড়া — মাঠের ফাটল,
শিশিরের জল!
মেঠো চাঁদ — কাস্তের মতো বাঁকা, চোখে–
চেয়ে আছে — এমনি সে তাকায়েছে কত রাত — নাই লেখাজোখা।
মেঠো চাঁদ বলে:
আকাশের তলে
ক্ষেতে ক্ষেতে লাঙলের ধার
মুছে গেছে, ফসল কাটার
সময় আসিয়া গেছে — চলে গেছে কবে!–
শস্য ফলিয়া গেছে — তুমি কেন তবে
রয়েছ দাঁড়ায়ে
একা একা! –ডাইনে আর বাঁয়ে
খড়-নাড়া — পোড়ো জমি — মাঠের ফাটল,–
শিশিরের জল।’…
আমি তারে বলি:
‘ফসল গিয়েছে ঢের ফলি,
শস্য গিয়েছে ঝরে কত–
বুড়ো হয়ে গেছ তুমি এই বুড়ি পৃথিবীর মতো!
ক্ষেতে ক্ষেতে লাঙলে ধার
মুছে গেছে কতবার, কতবার ফসল কাটার
সময় আসিয়া গেছে — চলে গেছে কবে!–
শস্য ফলিয়া গেছে– তুমি কেন তবে
রয়েছ দাঁড়ায়ে
একা একা! –ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি –খড়-নাড়া –মাঠের ফাটল–
শিশিরের জল!’
নীলিমা / জীবনানন্দ দাশ
রৌদ্র ঝিলমিল,
ঊষার আকাশ, মধ্যনিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারেবারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!
– উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুন্ডলী,
উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত কঙ্করগুলি মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
– মরীচিকা-ঢাকা!
অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার , -পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল,-
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধি-বিধানের এই কারাতল
তোমার ও-মায়াদন্ডে ভেঙেছ মায়াবী।
জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
কোন দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী!
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি,-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়,-স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
– শঙ্খশুভ্র মেঘকুঞ্জে, শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিতে স্পর্শে হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
আমি কবি,- সেই কবি / জীবনানন্দ দাশ
আমি কবি,- সেই কবি,-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আনমনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল- মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন কাজরীর গানে!
দাদুরী কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!
স্বপন-সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দেওয়ানা করে!
জনম ভরিয়া সে কোন হেঁয়ালি হ’ল না আমার সাধা,-
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়,- পথে পথে ধায় ধাঁধা!
-নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভরে!
ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি
শিশুর মতন,- শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি।
ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটরক্ষেতের শেষে
তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে!
-ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,-
বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!
বিজন তারার সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!
পড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!
হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়!
কোন যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!
একদিন যদি আমি
একদিন যদি আমি কোনো দূর বিদেশের সমুদ্রের জলে
ফেনার মতন ভাসি শীত রাতে- আসি নাকো তোমাদের মাঝে
ফিরে আর- লিচুর পাতার পরে বহুদিন সাঁঝে
যেই পথে আসা-যাওয়া করিয়াছি- একদিন নক্ষত্রের তলে
কয়েকটা নাটাফল তুলে নিয়ে আানারসী শাড়ির আঁচলে
ফিঙার মতন তুমি লঘু চোখে চলে যাও জীবনের কাজে,
এই শুধু…বেজীর পায়ের শব্দ পাতার উপরে যদি বাজে
সারা রাত…ডানার অস্পষ্ট ছায়া বাদুড়ের ক্লান্ত হয়ে চলে
যদি সে পাতার পরে,- শেষ রাতে পৃথিবীর অন্ধকারে শীতে
তোমার ক্ষীরের মতো মৃদু দেহ-ধূসর চিবুক, বাম হাত
চালতা গাছের পাশে খোড়ো ঘরে স্নিগ্ধ হয়ে ঘুমায় নিভৃতে,
তবুও তোমার ঘুম ভেঙে যাবে একদিন চুপে অকস্মাৎ,
তুমি যে কড়ির মালা দিয়েছিলে- সে হার ফিরায়ে দিতে
যখন কে এক ছায়া এসেছিলো…দরজায় করেনি আঘাত।
এখানে আকাশ নীল / জীবনানন্দ দাশ
এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভরে- বারবার রোদ তার চিকণ সোনালী চুল
কাঁঠাল জামের বুকে নিঙরায়- দহে বিলে চঞ্চল আঙুল
বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন,
ধনপতি, শ্রীমন্তের বেহুলার, লহনার ছুঁয়েছে চরণ;
মেঠো পথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধুল,
কবেকার কোকিলের, জানো কি তা? যখন মুকুন্দরাম হায়
লিখিতেছিলেন বসে দুপহরে সাধের সে অন্নদামঙ্গল,
কোকিলের ডাক শুনে লেখা তার বাধা পায়- থেমে থেমে যায়-
অথবা বেহুলা একা যখন চলেছে ভেঙে গাঙুড়ের জল
সন্ধ্যার অন্ধকারে, ধানক্ষেতে, আমবনে, অস্পষ্ট শাখায়
কোকিলের ডাক শুনে চোখে তার ফুটেছিল কুয়াশা কেবল।
এই পৃথিবীতে এক
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে- সব চেয়ে সুন্দর করুণ:
সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুর, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে- সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;
সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের পর-
শঙ্খমালা নাম তার: এ বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো- বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর
তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।
আমি যদি ঝরে যাই / জীবনানন্দ দাশ
আমি যদি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;
যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,
যখন চড়াই পাখি কাঁঠালিচাঁপার নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে,
যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে উঠানের খয়েরি পাতায়,
যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,
শামুক-গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-
তখন আমারেযদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,
ঠেস্ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়,
তাহলে জানিয়ো তুমি আসিয়াছে অন্ধকারে মৃত্যুর আহ্বান-
যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরও চিল আর শালিখের ভিড়
একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর,
যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;-
কবে যে আসিবে মৃত্যু: বাসমতী চালে ভেজা শাদা হাতখান
রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে স্নান-