এখানে আকাশ নীল / জীবনানন্দ দাশ

এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভরে- বারবার রোদ তার চিকণ সোনালী চুল
কাঁঠাল জামের বুকে নিঙরায়- দহে বিলে চঞ্চল আঙুল
বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন,
ধনপতি, শ্রীমন্তের বেহুলার, লহনার ছুঁয়েছে চরণ;
মেঠো পথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধুল,

কবেকার কোকিলের, জানো কি তা? যখন মুকুন্দরাম হায়
লিখিতেছিলেন বসে দুপহরে সাধের সে অন্নদামঙ্গল,
কোকিলের ডাক শুনে লেখা তার বাধা পায়- থেমে থেমে যায়-
অথবা বেহুলা একা যখন চলেছে ভেঙে গাঙুড়ের জল
সন্ধ্যার অন্ধকারে, ধানক্ষেতে, আমবনে, অস্পষ্ট শাখায়
কোকিলের ডাক শুনে চোখে তার ফুটেছিল কুয়াশা কেবল।

আমি যদি ঝরে যাই / জীবনানন্দ দাশ

আমি যদি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;
যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,
যখন চড়াই পাখি কাঁঠালিচাঁপার নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে,
যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে উঠানের খয়েরি পাতায়,
যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,
শামুক-গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-
তখন আমারেযদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,
ঠেস্ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়,

তাহলে জানিয়ো তুমি আসিয়াছে অন্ধকারে মৃত্যুর আহ্বান-
যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরও চিল আর শালিখের ভিড়
একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর,
যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;-
কবে যে আসিবে মৃত্যু: বাসমতী চালে ভেজা শাদা হাতখান
রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে স্নান-

আবার আসিব ফিরে / জীবনানন্দ দাশ

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠালছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবো- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলায় নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা বায়- রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিব ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে-

 

যেদিন সরিয়া যাব / জীবনানন্দ দাশ

যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে- দূর কুয়াশায়
চলে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর
ভিক্ষা করে লয়ে যাবে- সেদিন দুদন্ড এই বাংলার তীর-
এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কি ভাবিব, হায়;-
সেদিন রবে না কোনো ক্ষোভ মনে-এই সোঁদা ঘাসের ধুলায়
জীবন যে কাটিয়াছে বাংলায়- চারি দিকে বাঙালির ভিড়
বহু দিন কীর্তন ভাসান গান রূপকথা যাত্রা পাঁচালীর
নরম নিবিড় ছন্দে যারা আজও শ্রাবণের জীবন গোঙায়,

আমারে দিয়েছে তৃপ্তি; কোনোদিন রূপহীন প্রবাসের পথে
বাংলার মুখ ভুলে খাঁচার ভিতরে নষ্ট শুকের মতন
কাটাইনি দিন মাস, লহনার খুল্লনার মধুর জগতে
তাদের পায়ের ধুলো-মাখা পথে আমি যে বিকায়ে দিয়েছি মন
বাঙালি নারীর কাছে- চালধোয়া স্নিগ্ধ হাত; ধানমাখা চুল,
হাতে তার শাড়িটির কস্তা পাড় ডাঁশা আম, কামরাঙা, কুল।

তোমরা যেখানে সাধ / জীবনানন্দ দাশ

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে
রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
দেখিব খয়েরি ডানা শালিকের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে,
ধবল রোমের নীচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে- একবার- দুইবার- তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে;
দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ- সাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে
শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়াল সে পুকুরের ধারে,

খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন্ কাহিনীর দেশে-
‘পরণ-কথার গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,
কলমীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীড়ে-
নীরবে পা ধোয় জলে একবার- তারপর দূরে নিরুদ্দেশে
চলে যায় কুয়াশায়- তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে
হারাব না তারে আমি- সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।

সেই দিন এই মাঠ / জীবনানন্দ দাশ

সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি- এই নদী নক্ষত্রের তলে
সেদিনও দেখিবে স্বপ্ন- সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
আমি চলে যাব বলে চালতাফুল কি আর ভিজিবে  না শিশিরের জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে? লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!

চরিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ- মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;
এশিরিয়া ধুলো আজ-বেবিলন ছাই হয়ে আছে।

বোধ / জীবনানন্দ দাশ

 

আলো-অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়,- কোন্ এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়,
সব চিন্তা- প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর!- কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর?- শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর?- প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই!- ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর পরে?
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়,- কোন্ এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে!

পথে চলে পারে-পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধরে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারি পাশে!
তবু সে চোখের চারি পাশে!
তবু সে বুকের চারি পাশে!
আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে!

আমি থামি-
সেও থেমে যায়;

সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধাঁ?
আমার পথেই শুধু বাঁধা?
জন্মিয়েছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হয়ে-
সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিম্বা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিম্বা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে
জন্ম দেবে- জন্ম দেবে বলে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি?- তাহাদের মন
আমার মনের মতো না কি?
-তবু কেন এমন একাকি?
তবু আমি এমন একাকি!

হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল?
বালটিতে টানি নি কি জল?
কাস্তে হাতে কতবার যাই নি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা- আঁশটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
-এই সব স্বাদ;
-এ সব পেয়েছি আমি- বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
একদিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন- অবাধ- অগাধ;
চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে-
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;

আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা করে চলে গেছে- যখন ডেকেছি বারে বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিল একদিন- এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র-নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বারবার দিয়েগেছে বাধা
আমি তা ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা- ধূলো আর কাদা-।

মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়-প্রেম নয়- কোনো এক বোধ কাজ করে!
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কোন জলের মতো ঘুরে ঘুরে এক কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!

এই বোধ-শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ-অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে?-করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালোশিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ-গলগন্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা-পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,
যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
-সেই সব।

পঁচিশ বছর পরে / জীবনানন্দ দাশ

শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে-
বলিলাম: ‘একদিন এমন সময়
আবার আসিয়ো তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!-
পঁচিশ বছর পরে।
এই বলে ফিরে আসিলাম ঘরে;
তারপর, কতবার চাঁদ আর তারা,
মাঠে মাঠে মরে গেল, ইঁদুর-পেঁচারা
জ্যোৎস্নায় ধানক্ষেত খুঁজে
এল-গেল।- চোখ বুজে
কতবার ডানে আর বাঁয়ে
পড়িল ঘুমায়ে
কত-কেউ!- রহিলাম জেগে
আমি একা- নক্ষত্র যে বেগে
ছুটিছে আকাশে,
তার চেয়ে আগে চলে আসে
যদিও সময়-
পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!-

তারপর-একদিন
আবার হলদে তৃণ
ভরে আছে মাঠে-
পাতায়, শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে দিকে, চড়–য়ের ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে- পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা- কড়কড়!
শসাফুল-দু-একটা নষ্ট শাদা শসা-
মাকড়ের ছেঁড়া জাল,-শুকনো মাকড়সা
লতায়-পাতায়;
ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়;
হীম আকাশের গায়- ইঁদুর-পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে মাঠে, ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: