আয়না / আসাদ চৌধুরী

দরশ পরশ লাগি আউলাইছে গা॥ জ্ঞানদাস

পেঁয়াজ আমার ননদী পেঁয়াজ বাটি যদি,
নয়ন জলে আ-লো বুইন উথালপাথাল নদী।
মরিচ আমার শাউড়ি মরিচ বাটতাম না।
( আ-গো) বাতাস বইলে বাউরী কানতে পারতাম না।
নকশী করা কেঁথা বানাই রঙ্গীল সুতা দিয়া
ঘরের মানুষ বাহির হৈল রুমাল উড়াল দিয়া।
বৈদেশে যার নাগর গেল চৈত বৈশাখে আইছে।
শীতল বলো ঠান্ডা বলো স্বামীর মতোন নয়।
বাপ বলো পুত বলো হলদীর মতোন নয়।
হলুদ আমার সোয়ামী যতনে বাটিব
বাটিয়া ঘসিয়া হলুদ অঙ্গেতে মাখিব।
ধুইয়া পুছিয়া মুখে শ্বেত চন্দন লেপিব।
যতন করিয়া চোখে কাজল মাখিব।
তাম্বুল গুয়াতে ওষ্ঠ রাঙা যে করিব
পড়শি আইলে রাঙা ঠোঁডে মিষ্টি হাসি দিব।
হাসিয়া ভাসিয়া তবে নিরলে বসিব
নিরলে বসিয়া মুখ আয়নাতে হেরিব।
আয়না না দেখিতে গিয়া কান্দন আসে ক্যানে
মরার আয়নার গুষ্টি আছড়াইয়া ভাঙিব।

সন্দেহ

চিরল চিরল তেঁতুল পাতা
বাতাস পাইলে কাঁপে
সাপের মতন লকলকাইয়া
চুলার আগুন তাপে।
(আমার) শীতে কাঁপে দেহ।

অর্ধেক আমরা অবোলা নারী
সব কথা কি কইতে পারি?
আছে বুড়া, আছে গুঁড়া
আছে যোগী, রুগী
(তবু) বেবাকের সন্দেহ।

আলো শাউড়ি, ভালো মানুষের ঝি
(তবু) আমারে অসতী ব’লে,
মিছে খোঁটা দেহ,
চন্দ্র সূর্য সাক্ষী আমার
শীতে কাঁপে দেহ।

(সংস্কৃতশ্লোক অনুসারণে)

বাতাস যেমন পরিচিত

তখন আমার বায়োস্কোপের বাতিক ছিলো,
ঠিক মনে নেই কোন সিনেমায় দেখেছিলাম,
ছবির নায়ক বিকাশ রায় না অসিতবরণ;
চন্দ্রাবতী, কানন দেবী কে নায়িকা,
ঝাপসা হয়ে মুছে গেছে দেখেছিলাম
নদীর তীরে তাল নারিকেল সুপুরি বন
বাসায় ফিরে বাড়ির জন্য কেঁদেছিলা।
হে রূপমহল, তখন আমি কত্তটুকুন?

আছেন বটে এমন মানুষ হয় নি দেখাই
দেখি নি যার যত্নে রাখা ঝাপসা ছবি
কুটুম্ব নন, আত্মীয় নন, শত্রুও নন,
পিতৃবন্ধু… এসব কিছুর ধার ধারে না,
অথচ তার আনাগোনা সকল ঘরে,
সবাই চেনেন, বাতাস যেমন পরিচিত।

লাল সবুজে ঝিলিক মারে কৃষ্ণচূড়া
পাগল হয়ে ডাকতে থাকে কালো কোকিল
বাড়তে থাকে গাছের মতো শহীদ মিনার
বুকের ভিতর শেকড়গুলো আলাপ করে।

সতর্কবাণী

লাল গোলাপের ঝলমলে বালব, নারী,
একটা ফুঁতেই নিভিয়ে দিতে পারি।
দিন-রজনীর চোখ-মারা রোড, রাগাও যদি
এক নিমেষে হ’য়ে যাবে
কুমীর বোঝাই গহিন নদী।
যদি আমি চটি,
ডিপের কাছে বুড়ো বট-ই
সবুজ শাড়ি ছুঁড়ে দিয়ে দেখাবে তার তোবড়ানো বুক
দেখবে তখন গাছ-গাছালির হাজার রকম অসুখ-বিসুখ।
সবগুলো রঙ এক চুমুকে খেতে পারি
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া ভাবতে পারো?
কালো-আলোর বোরকা-ঢাকা আদিম নারীর
চর্বি ও নুন অই তনুতে থাকবে আরো?
প্রণয়-গাঁথার বাজে পঙক্তির বিশ্রী জ্বালা
যতোবারই পড়তে যাবে হোঁচট খাবে।
হানবে আঘাত খড়ের মতো ঘরের বালা
তখন তোমরা এই আসাদকেই মারতে যাবে।
অথচ ও নারী,
এক ইশারায়
কাঠের ডগায়
ফুল ফোটাতে পারি।

আত্মজীবনী : ৩

সুখের হাত ধরেছিলাম
হঠাৎ ছুটে গ্যালো-
তখন থেকে চেষ্টা তাকে
ধরার।
কান্না শুরু আমার।
দুখের হাত ধরেছিলাম
হঠাৎ ছুটে গ্যালো-
তখন থেকে চেষ্টা তাকে
ধরার।
দুঃখ শুরু আমার।

আত্মজীবনী : ২

তোদের আবার দুঃখ কেন, রাজার মতো?
দায়িত্ব নেই, যোগ্যতা নেই লড়াই করার,
ভান করেছিস দিন রাত্তির সভ্য হবার
ঝুঁকি নেবার মুরোদও নেই, রাজার মতো
দুঃখ করিস, মিছিমিছি এ রোগ কেন?
আকাশ সমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে
বুকের ভেতর অরণ্য তোর কেবল পাতা
পেশির মতো দা বাঁকানো কাঁধ আছে তোর?

কেবল পাতা ঝুরতে থাকে, বাতাস যেদিক
বয় সেদিকে উড়তে থাকে, ঘুরতে থাকে।
তুই কি না ফের রাজার মতো শোক করেছিস?
শোকের আয়তন দেখে তুই বেজায় খুশি।
সুখের তালিকাতে লেখা সবুজ কালির
নাম দেখে তুই বেজায় খুশি, কিসের আশায়
দুঃখের ক্রমে নিজেই লিখিস ভুল বানানে
নিজেরই নাম, পিতার রাখা আদর মাখা।
আপন হাতে পদ্য লিখে ত্যাগের জন্য
দৌড়ে গেছিস ভোগীর পাড়ায় মুখোশ ছাড়াই
তাড়া খেয়ে করলি শুরু উল্টোকাঁদা।
ঘর সাজাবার গোলাপ খেলি পেটের ভুখে।
কোন্ সাহসে শোক জানাবি রাজার মতো?
আলো খাবি, লোভীর মতো আঁধারও চাস।
বোতল ভরা বিশেষণের গুদাম যে তোর
সব খেতে চাস একা একা, অথচ তোর
রাজার মতো দুঃখ আছে, বড়াই করিস।
তোদের আবার দুঃখ কেন রাজার মতো?

আত্মজীবনী : ১

গোলাপের মধ্যে যাবো।
বাড়ালাম হাত
ফিরে এলো রক্তাক্ত আঙুল।
সাপিনীর কারুকার্য
নগ্ন নতজানু
চরাচরে আবেগ বিলায়।
আমার অধরে শুধু
দাঁতের আঘাত।

চাঁদের ভিতরে খাদ্য
আমাকে কেবল
নিয়ে যায়
নিঅনের কাছে
হায় দেহ, শুধুই শরীর
বিদ্যুৎবিহীন।

স্বীকারোক্তি

তোদের হলুদ মাখা গা
তোরা রথ দেখতে যা-
আমরা হলুদ কোথায় পাব?
আমরা উল্টোরথে যাব।
– প্রাচীন লোকসাহিত্য

উল্টোভাবে রোপণ করা বৃক্ষ সে কি
আমার দেহ, আমার শরীর?
অনুমতির অনুরোধে দেয় নি টোকা আমার ঘরে
দেয় নি টোকা আম্মা কিংবা
স্বর্গীয় সেই বিরাট পুরুষ, লোকপ্রিয় জনক আমার।
ডুবে যাচ্ছে আঙুলগুলো
ডুবে যাচ্ছে অভিজ্ঞতায়
ভূকম্পনের কাঁপন জাগে
নখে এবং শিরায় শিরায়
অজস্র হাত প্রসারিত,
ব্যগ্র বাহুর শাখাগুলো
গভীর তৃষায় বাড়ায় গ্রীবা।
শরৎকালের ঝকঝকে রোদ,
খুঁজছো কাকে? হাঁকছে গ্রীবা
সবুজ আলোর চক্ষু ছুড়ে?
বুকের ভিতর কালো শেকড়
হাতড়ে বেড়ায় অন্ধকারে
আমার হৃদয়, ও রে হৃদয়।
তুই কি ভাঙা বেহালার সুর,
অন্ধকারের প্রজাপতি?
বটের মূলে করুণ গাথা স্মৃতির গীত
প্রাচ্য দেশের অন্তরঙ্গ আজান যেন
ফলবতী গাছের মতো বিনয় নত
দলামুথা সহিষ্ণু ঘাস
সার্বজনীন সূর্যকিরণ, জলের প্রপাত
রোগের গতি… বনস্পতি…
আশৈশব সে ভ্রান্ত বৃক্ষ, যাহার গোড়ায়
দীর্ঘশ্বাসের করুণ কবর, মৃত্তিকা নেই
ভূতের মতন ছায়াবিহীন উল্টোপায়ে
জীবন-মরণ পরিক্রমণ অনিচ্ছাতে
কাঙাল বটে সেই বেচারা ছায়াবৃত আয়তনের।

আমার বাবা

আমার বাবা বাসতো ভালো আমাকে
আমার ময়লা জামাকে,
শোনো বলি চুপি চুপি
আমার উলের রঙিন টুপি
দিতো মাথায় ফাঁক পেলেই,
হাসতো তখন দাঁত মেলেই।
আসতো চিঠি মুক্তো হাতের
আসতো হাসি জ্যোৎস্না রাতের
সব মেলেই।
আমার বাবা বাসতো ভালো দেশটাকে,
শ্যামল পরিবেশটাকে,
সবার চেয়ে প্রিয় ছিলো তাহার
টেবুল বোঝাই মুখরোচক আহার।

আমার বাবা আজব মানুষ,
তাঁহার কাছে প্রিয় মানুষ,
সাদা, কালো, হলুদ, লাল,
থ্যাবড়া নাক, গোল কপাল,
বাংলাভাষী, উর্দুভাষী,
বাসায় হতো ঠাসাঠাসি
দেশ-বিদেশের লোকের সাথে
আড্ডা দিতো দিনে-রাতে
আমার বাবা কেমনতর মানুষ?
আমার বাবা বাসতো ভালো মানুষ।

মুদির ছেলে হুমায়ূনে
বশ হলো তার আজব গুণে,
কাজীপাড়ার শান্তি ধোপা,
গোলাপীর মা’র দারুণ চোপা,
রিকশাচালক, সমীরুদ্দি,
মধ্যপাড়ার কানু বদ্যি,
ত্রস্তব্যস্ত কাগজঅলা
আলাপ জমায় বাড়িয়ে গলা
মিহিন সুরের গোয়ালিনী
বাজিয়ে চুড়ি রিনিঝিনি
আলাপ জমায় আছে কি হুঁশ?
আমার বাবা আজব মানুষ।

আমার বাবা বাসতো ভালো আমাকে
আমার মাকে, মামাকে,
পরী আপার উঠলে কথা
গুলিয়ে যেতো বুড়োর কথা;
আমার দু’বোন আজম ভাইতে
দ্বন্দ্ব হতো কে কার চাইতে
আদর পেলো বাবার কাছে
সেসব রিপোর্ট আমার কাছে
গণি ভাইকে ডাকতো বুড়ো ‘আব্দুল গণি’
সে ছিলো, তার শেষ বয়সের চোখের মণি।
এটুক বুঝি বাসতো ভালো আমাকে
এমন কি মোর জামাকে
এমন কি মোর বন্ধু-বান্ধব
ছাত্র-ছাত্রী, গোলাপের টব,
চেয়ার টেবুল, র‌্যাকের বই
জুতো, ছাতা, কতো কী কই
যাহা ছিলো আমার
চাকরি কিংবা খামার-
সবই অতি প্রিয় ছিলো বাবার
বুড়ো বাবার।

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: