সেদিন বিকেলে দেবদারু গাছের ছায়ায়
তুমি আর আমি হেঁটে গেছি বহুদূর;
মনে কি আছে তোমার সেই বাতাসের সুর?
সবুজ ছায়ার মায়া ছেড়ে ঘাসের সবুজে
দুজন বসেছি মুখোমুখি;
আকাশের আলোয় তোমার মুখখানি
দেখেছি অনেক সুখি।
হাতে হাত রেখে দুচোখের মায়াবী খাঁচায়
আমার স্বপ্নের সব পাখিরা স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব নিলো,
সপ্রতিভ তোমার হাসিতে ওরা খাঁচাছেড়ে আগামীর
দিগন্তে উড়াল দিলো।
চারপাশে সবুজ ঘাসেরা আমাদের ঘিরে
আশীর্বাদ করেছে, তা তুমি বুঝতে পারনি,
অনুভব করতে পারনি-ে তুমি
একালের মহুয়া সুন্দরী।
প্রকৃতির মধ্যে ডুবে থাকা গুপ্ত ঘাতক কীটেরা
যেভাবে সুন্দর খেয়ে ফেলে, তেমনি তোমাকে
গ্রাস করতে আসবে কালের করাত;
কেমন করে যে সবুজের হাসি হাসবে তোমার বরাত,
আমি জানি না তা,
শুধু জানি মহুয়া সুন্দরী,
ঝড়ঝঞ্ঝাময় জীবনের রাজপথ
গর্বিত হবেই যখন গড়বে আমাদের প্রেমের বিজয়ী রথ।
দক্ষিণে দরিয়া সাক্ষী উত্তরে ঐ হিমালয়
জীবন জগৎ হবে প্রেমময়; আর কোনো মৃত্যু নয়।
কবি ও নারী / ফজলুল হক তুহিন
কবিছাড়া তুমি পূর্ণ নও, নারী
কবিও অপূর্ণ তুমিছাড়া।
মৃত্তিকা পূর্ণতা পায় না গাছের শেকড়ছাড়া
আকাশ অপূর্ণ মেঘ, নক্ষত্র, চাঁদের আলোছাড়া
নদীর জীবন ব্যর্থ ছলাৎ ছলাৎ ঢেউছাড়া
কবির জগৎ ধু ধু মরুভূমি তুমিহারা।
অরণ্য অপূর্ণ থেকে যায় প্রাণিহীন
আলোছাড়া সূর্য আধাঁরে বিলীন
পাখিছাড়া গাছপালা শূন্যতার সারি
কবিছাড়া তুমি অর্ধনারী।
নারী, এসো, পরস্পর হই পূর্ণ
তাবৎ অহং করে ফেলি চূর্ণ।
নদী ও নারী / ফজলুল হক তুহিন
আমার সামনে দিয়ে বয়ে বয়ে যাচ্ছে কীর্তিনাশা;
যেমন অনন্তকাল ধরে মানুষের রক্তে স্বপ্ন-আশা,
তুমি কাশবনে আছ দাঁড়িয়ে, আমার পাশাপাশি;
একদিকে নদী আর অন্য পাশে তুমি,
মধ্যবর্তী আগন্তুক আমি শুনি দুজনের ভাষা।
নদী আর নারী চিরকাল সভ্যতার সৃজনে চেতনে;
আমরা মুগ্ধতা নিয়ে বের হই পৃথিবী ভ্রমণে,
রোমাঞ্চিত, আনন্দিত, তৃপ্ত হয়ে ফিরি ঘরে,
স্বাভাবিক জীবনযাপনে আবারো অভ্যস্ত হয়ে যাই;
তবু রেশ থেকে যায়- ঢেউ ওঠে স্বপ্নে, রক্তে, মনে।
কীর্তিনাশা, তোমার গন্তব্য জানি বঙ্গোপসাগরে;
নারী, তুমি যাবে কোথা, কার সাথে?
তোমাকে ডাকছি আমি মজ্নুর মতো,
তোমার মঞ্জিল হোক কেবল আমার ঘরে।
সবুজের সম্মোহন থেকে / ফজলুল হক তুহিন
‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’-
আমি আর তুমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি ঘাসে ঘাসে,
পায়ে পায়ে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে
আনন্দে ভাসছে ঘাসফড়িং, আমার মন;
বৃষ্টিভেজা মাটির সুবাস চেতনায় সারাক্ষণ!
আমাদের সামনে-পেছনে-পূর্বে ও পশ্চিমে সবুজ প্রান্তর,
তোমার চুলের আকর্ষণে মেঘপুঞ্জ নেমে এসেছে ঐ দেখ,
কখন যে ভিজিয়ে দেয় সে, ভয়ে উদ্বিগ্ন অন্তর!
তোমার শাড়িতে লুটোপুটি দিয়ে যাচ্ছে জলদ হাওয়ারা
আমি চেয়ে আছি আর বাতাসকে হিংসে করছি।
চারিদিকে এতো গাঢ় সবুজের সমারোহ
নিজেকে হারিয়ে ডুবে যাচ্ছি অহরহ;
সবুজের সম্মোহন থেকে আমাকে বাঁচালে তুমি,
হাতছানি দিয়ে মনদৃষ্টি কেড়ে নিলে তোমার সবুজে।
দু’চোখের সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছি হাতে হাত রেখে,
আর ফরহাদ হয়ে স্বপ্ন দিয়ে ভবিষ্যত যাচ্ছি এঁকে।
জীবনের মানে / ফজলুল হক তুহিন
আমি পদ্মা আর তুমি স্বচ্ছ যমুনার ধারা
দুটি স্রোত মিলিত হয়েছে প্রেমের বিন্দুতে,
বর্ষায় ছাপিয়ে ওঠা দুই কূল আত্মহারা
চলো ছুটে চলি পূর্ণতার বঙ্গোপসাগরে।
মাঝপথে পার্থিব পলির চর কেনো তোলো?
কেনো বাঁধতে চাইছো ঘর, ফসলের চাষ;
গড়ে তুলতে কী আগামীর প্রজন্ম আবাস?
নারী, তুমি বুঝি জীবনের পূর্ণতা চাও না?
কী হবে এখন আর ঘর বেঁধে প্রিয়তমা,
দু’জন যখন নিশিদিন চলেছি স্রোতের টানে;
বুঝেছি প্রেমের সুখজ্বালা, জীবনের মানে-
চলো তাই মিশে যাই দু’জন মহাসাগরে।
বনসাই / ফজলুল হক তুহিন
তুমি যে সবুজ বনসাই আমাকে দিয়েছো,
সেটা বনসাই হয়ে থাক, তা আমি চাই না।
আমার বাগানে আমি সেটা লাগাব, ঢালব পানি
রোজ যত্ন নেবো, ছোঁবো; কিছুতেই রাহাজানি
হতে দেবো না; হোক না সৌন্দর্যের জানাজানি
পরওয়া করি না কারো, ঝড়ের ভয় পাই না।
সময়ের সঙ্গে বড় হবে বটের গাছটি
সুখস্বপ্নসাধের পাখিরা নেচে যাবে ডালে ডালে,
জীবন্ত স্মৃতির আলো খেলে যাবে পাতায় পাতায়
ষড়ঋতু দেখা দেবে কবিতার সৃষ্টিসুখকালে।
শেকড় বিস্তৃত হবে জীবনের মৃত্তিকা জড়িয়ে
প্রাণের আবেগে সবুজতা যাবে আকাশে ছড়িয়ে।
যতদিন বেঁচে আছি এই বৃক্ষ আমার প্রেরণা-
সৃজনের উৎসধারা চোখের সামনে বড় হোক;
যতই সবুজ হবে, পল্লবিত, কুসুমিত হবে
জীবন ততোই হবে প্রাণময় আর কাব্যময়।
একদম ভুলে যাবো বেদনার আরণ্যক
আমায় ছুঁবে না পৃথিবীর কোন দুঃখ-শোক।
স্বপ্নমাখা আলোয় / ফজলুল হক তুহিন
জীবন কাটতো সাদামাটা বর্ণবিহীন,
চালচুলোহীন, বাউন্ডুলে যেমন করে
ঘুরে বেড়ায়, আমার তেমন পথে-ঘাটে-স্টেশনে
অলস ধূসর সময় যেত অকারণে।
নাই কোন কাজ, নাই কোন সাজ, ধুলো শুধু দুই চরণে।
হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলো জীবন আমার
অঙ্গার হওয়া অন্তর এখন উর্বর সবুজ শ্যামল
শুকনো বিলে জল থৈ থৈ মাছের আনাগোনা
দীন ভিখেরির হঠাৎ রাজা হওয়া
শূন্য খাতায় ভরে ওঠে অযুত কাব্যসোনা।
এসব কিছু হওয়ার মূলে তুমিই শুধু
জীবন ভরে দিলে আমার স্বপ্নমাখা আলোয়,
দিনে আমার সূর্য জ্বলে, রাতের বেলা পূর্ণিমা চাঁদ
আলোকিত জীবনে আজ গতি এবং প্রাণের আবাদ।
বন্ধু, তুমি, যেও না তাই আমায় ছেড়ে
জীবন থেকে জীবন তবে ভাগ্য নেবে কেড়ে।
পিরিতির জ্বালা / ফজলুল হক তুহিন
একেই কি গো পিরিতি বলে লোকে?
অস্থির দোয়েল ফড়ফড় ওড়ে হৃদয়ের আরণ্যকে
সময় কি অসময় বোঝে না সে
বোঝে না ঝড়ের রাত, ডানা ঝাপটায় আকাশে আকাশে।
তাই বুঝি লোকে বলে, পিরিতির
জ্বালা বড় জ্বালা- আমি বলি, সুখের সে জ্বালা।
এই সুখ সমুদ্র-অরণ্য-নদী দেখে মেটে না
ভরে না মন দেখে পাহাড়-পবর্ত-গাছপালা।
পিরিতিতে দুটি নদীর সঙ্গম
দোতারায় দুটি সুরের ঝংকার
দুটি বিচ্ছিন্ন গ্রামের পথের মিলন
পিরিতি আমার জীবন-ওঙ্কার।
মহাকাব্যিক কাজলে / ফজলুল হক তুহিন
প্রকৃতির সাথে তীব্র আত্মীয়তা আমার শৈশব থেকে
জীবনের প্রতিটি উপমা খুঁজেছি, পেয়েছি তার কাছে।
দুঃখে-ব্যথায়-দুঃস্বপ্নে, সুখে-আনন্দে-সৃষ্টিতে প্রতিক্ষণে,
আশ্রয়-নির্ভর-পটভূমি হয়ে আমি চেয়েছি জীবনে।
কিন্তু কি যে হলো, তার সাথে পরিচয়ে, প্রথম প্রণয়ে
আর এক মানুষী প্রকৃতি, প্রকৃতির আড়ালে জেগেছে;
রোদের রাজত্বে মন তার কাছে প্রশান্তি পেয়েছে.
বহুদূর পথ হেঁটে এই কবি সত্যি ফিরেছে আলয়ে।
আমি তোমার জগতে সুখ-স্বপ্ন-ছায়া, তৃষ্ণা-প্রেম-কাম
সবকিছু পেয়ে ফরহাদ হয়ে যাবো; গ্রীষ্মে ও বসন্তে
শরতে ও শীতে আমি আশ্রয় পেয়ে তোমার সবুজ আঁচলে
সৃষ্টিসুখে দু’চোখ সাজিয়ে দেবো মহাকাব্যিক কাজলে।
চেতনার সরোবরে / ফজলুল হক তুহিন
গোধুলি বেলায় তুমি বসেছিলে নদীতীরে
অস্তগামী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত মুখ,
রবীন্দ্রনাথের কাছে এই আলো- কনে দেখা আলো
আমি বলি, প্রেম বোঝা আলো, প্রকৃতি জ্বালালো।
তুমি হেসে চুলের বিন্যাসে হলে মনোযোগী
সেই হাসি যেন ঝিকিমিকি ছোট ছোট ঢেউ,
তোমার মুখের কারুকার্য বঙ্গ টেরাকোটা
যার লাগি চোখে ঝরে জলবিন্দু ফোটা ফোটা।
আমার হাতের মধ্যে হাত রেখে হলে আনমনা
কী যে ভাবো তুমি? ভয় কী জমেছে মনে?
কালের করাত দেখে এত ভীরু হলে চলে
দেখো, কবি আজো খাড়া হয়ে শিখা হয়ে জ্বলে।
সূর্য বাড়ি ফিরে গেছে, তুমিও অস্থির
সন্ধ্যার আলো-আঁধারি ঘিরে আছে আমাদের,
তুমি কোন্ ঘরে ফিরে যাবে, বন্ধু, কোন ঘরে?
যাও, তবে ফিরে এসো চেতনার সরোবরে।