‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ বাস্তবিকই কবিদের মধ্যে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ যারা মানুষকে নিয়ে কবিতা রচনা করেন। কবিতা যখন মানুষের ব্যথা বুকে ধারণ করে সৃষ্টি হয়; তখন সে-কবিতা দেশ কাল স্থানের ঊর্ধ্বে উঠে অমরত্ত্ব প্রাপ্ত হয়। আনন্দের কথা, প্রথম দশকের প্রতিশ্রুতিশীল কবি সাইফ আলির পুতুল খেলার গল্প কাব্যগ্রন্থটি মানবপ্রেমে সিক্ত হয়ে মানবতার এক অনন্য উচ্চারণ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ কবিরা যখন তরল প্রেমের গদ্য কবিতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে নিজেদের আমিত্বের অন্ধকারে হারিয়ে ফেলছে তখন সাইফ আলি নিজেকে নিমজ্জিত করেছেন মানবপ্রেমের মহাসমুদ্রে। সত্যিকার অর্থে এই কবি কাল্পনিক দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে রোমান্টিক আবহের কবিতা রচনার পক্ষপাতি নন। টি বি শেলির মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যেন এই কবি ফুঁসে ওঠেন মানবতার মহামন্ত্রে। কবিরাই শ্রেষ্ঠ আইনপ্রণেতা, কবিরাই শ্রেষ্ঠ সত্যের ধারক, কবিরাই মানুষের প্রকৃত মুক্তিদাতা- এই মন্ত্রে উজ্জিবিত হয়ে কবি সাইফ আলি নির্ভয়ে-নিঃসঙ্কোচে কলম ধরতে জানেন নির্যাতিত মানুষের পক্ষে। সঙ্গত কারণেই পুতুল খেলার গল্প হয়ে উঠেছে নিপিড়িত মানুষের আর্তনাদের রক্তাক্ত দলিল। এই কবি যখন উচ্চারণ করেন-
গণমাধ্যম যেখানে মরা গরুর খোঁজে ভাগাড়ে ভাগাড়ে ঘুরে বেড়ায়
মানবতাবাদের দালালেরা যেখানে উটপাখি হয়ে মাথা গুঁজে পড়ে থাকে চুপচাপ
সেখানে তো তোমাকেই দিতে হবে জবাব হে ছেলে,
তার আগে বলো দেখি এমন সাহস তুমি কোথা থেকে পেলে!?
তখন পাঠকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে যায় কবির মানবতাবোধ নিয়ে।
কবিরা হলেন তাঁদের সময়ের শ্রেষ্ঠ বিবেক। মানুষের উপর যেকোনো ধরণের নিপিড়ন-নির্যাতন একজন প্রকৃত কবিকে উৎপিড়িত না করে পারে না। সাইফ আলি এই প্রকৃত কবিদেরই একজন। উগ্র জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ভোগবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের শিকার তৃতীয় বিশ্বের অসহায় মানুষের করুণ আর্তনাদ এই কবিকে ব্যথাক্লিষ্ট করে তোলে। তাই তিনি এভাবে উচ্চারণ করতে পারেন-
শুনতে পেলাম একটা পুতুল কাঁদছিলো
খুব বেশি না ছোট্ট বুকে পুতুল খেলার সাধ ছিলো;
পুতুল পুতুল ছিন্ন পুতুল বোমায়
বিশ্ব তখন ঘোমায়।
আকাশজুড়ে কয়েকটা চিল উড়ছিলো
মুহুর্মুহু মণ্ডামিঠাই ছুড়ঁছিলো
মণ্ডামিঠাই তেতো খুকুর কাছে
এসব খবর তার কি জানা আছে?
পুতুল পুতুল শান্ত পুতুল চোখ খোলো
মানবতার মিথ্যে গানের আকাশ ছেড়ে
নতুন করে ঢেউ তোলো;
ঘুমিয়ে থাকা বিবেক-বোধে ঢেউ তোলো।
স্বদেশ ও পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সব ঘটনা এই কবিকে বিচলিত করে তোলে। সবাই যখন দেখেও না দেখার ভান করে বিপন্ন মানবতার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায় তখন তরুণ এই কবি থমকে দাঁড়ান অবাক বিস্ময়ে; অতঃপর ফেটে পড়েন দ্রোহে ও বিক্ষোভে:
যদি, উড়ন্ত পাখির বুকে
বন্দুকের নল তাক করে
লক্ষ্যভেদী নিশানারা মুচকি হেসে বলে-
এ আমার স্বাধীনতা
এ আমার অধিকার…
তবে, স্বাধীনতা এই সব পাখিদের রঙিন মিছিলে
অধিকার এইসব রক্তমাখা বুলেটের গায়ে,
লেগে থাক;
সমুন্নত থেকে যায় যাক।
আমি তার করিনে পরোয়া,
আমি তাকে ঘৃণা করি;
করে যাবো যতোদিন বাঁচি।
সাইফ আলি কবিতা রচনা করেন জেনেশুনে। তিনি জানেন কবিতাকে একজন স্থপতির মতো নিখুঁত নির্মাণ করতে হয়। এর জন্য থাকা চাই ছন্দ, অন্তমিল ও অলংকার শাস্ত্রের জ্ঞান। এই কবির পুতুল খেলার গল্প কাব্যগ্রন্থটি আদ্যপান্ত পাঠ করে আমার মনে হয়েছে তিনি কবিতাকে নির্মাণ করতে জানেন প্রয়োজনীয় মাল-মসলা দিয়ে। কবিতার রাস্তা বড়ই জটিল, দীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ। অনেক সাধনা, প্রণয় ও নিবেদনের মাধ্যমে পার হতে হয় এই পথ। কবি পাশাপাশি একজন চিত্রশিল্পী হওয়ায় তিনি তাঁর কবিতার ক্যানভাসও নানা রঙ, রূপ ও চিত্রকল্পে সাজিয়ে তুলতে পারেন। পুতুল খেলার গল্প কাব্যগ্রন্থটির ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আমার বিশ্বাস এই কবি আধুনিক বাংলা কবিতায় একটি স্থায়ী আসন করে নিতে পারবেন। আমি এই কাব্যগ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি।
-সায়ীদ আবুবকর
Like this:
Like লোড হচ্ছে...