মুহূর্তের কবিতা / ফররুখ আহমদ

সময়-শাশ্বত, স্থির। শুধু এই খঞ্জন চপল
গতিমান মুহূর্তেরা খর স্রোতে উদ্দাম, অধীর
মৌসুমী পাখীর মতো দেখে এসে সমুদ্রের তীর,
সফেদ, জরদ, নীল বর্ণালিতে ভরে পৃথ্বীতল।

সন্ধ্যাগোধূলির রঙে জান্নাতের এই পাখী দল
জীবনের তপ্ত শ্বাসে, হৃদয়ের সান্নিধ্যে নিবিড়,
অচেনা আকাশ ছেড়ে পৃথিবীতে করে আসে ভীড়;
গেয়ে যায় মুক্তকণ্ঠে মৃত্যুহীন সঙ্গীত উচ্ছল।

মুহূর্তের এ কবিতা, মুহূর্তের এই কলতান
হয়তো পাবে না কণ্ঠে পরিপূর্ণ সে সুর সম্ভার,
হয়তো পাবে না খুঁজে সাফল্যের, পথের সন্ধান,-
সামান্য সঞ্চয় নিয়ে যে চেয়েছে সমুদ্রের পার;
তবু মনে রেখো তুমি নগণ্য এ ক্ষণিকের গান
মিনারের দম্ভ ছেড়ে মূল্য চায় ধূলিকণিকার॥

উৎসর্গ পাতা / মুহুর্তের কবিতা / ফররুখ আহমদ

পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির শ্রদ্ধেয় কর্মী ও সদস্যদের উদ্দেশ্যে
(কয়েকটি আদর্শ-দীপ্ত দিনের স্মরণে)

সে-সব উজ্জ্বল দিন আজ শুধু স্মৃতির সঞ্চয়,
শেষ মঞ্জিলের পথে যাওয়া সে সুতীব্র প্রয়াস,
প্রতি পায়ে সংগ্রামের সে দুর্বার চেতনা, বিশ্বাস
উন্মুক্ত দিনের সেনা ভুলেছে সে কাহিনী দুর্জয়।
এখন মন্থর স্রোতে জেগে ওঠে ক্লান্তি ও সংশয়,
দূরান্তে নহর দেখে আজ প্রাণ খোঁজে না আশ্বাস,
ঘূর্ণী হাওয়া বয়ে আনে সেদিনের সুরভি সুবাস,
প্রতি পদক্ষেপে তবু জেগে ওঠে আঁধারের ভয়।
সাত মঞ্জিলের রাহা পাড়ি দিয়ে রুস্তম যেমন
আলোকিত বিশ্ব ছেড়ে মাজেন্দ্রান গিরিগুহা মুখে
থেমেছিল অন্ধকারে, অতর্কিতে তখন সম্মুখে
বিশাল সফেদ দেও জেগেছিল মৃত্যুর মতন
জরাচিহ্ন জড়তার আজ এই আঁধারে তেমন
মৃত্যু-বিভীষিকা নিয়ে অন্ধকারে দাঁড়ায়েছে ঝুঁকে।।

সাত সাগরের মাঝি / ফররুখ আহমদ

কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হ’ল জানি না তা’।
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা ।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না? তবু, তুমি জাগলে না?
সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকে জাহাজ,
অচল ছবি সে, তসবির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ।
হালে পানি নাই, পাল তার ওড়ে নাকো,
হে নাবিক! তুমি মিনতি আমার রাখো;
তুমি উঠে এসো, তুমি উঠে এসো মাঝি মাল্লার দলে
দেখবে তোমার কিশতি আবার ভেসেছে সাগর জলে,
নীল দরিয়ায় যেন সে পূর্ণ চাঁদ
মেঘ তরঙ্গ কেটে কেটে চলে ভেঙে চলে সব বাঁধ ।
তবু তুমি জাগো, কখন সকালে ঝরেছে হাসনাহেনা
এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না? তবু, তুমি জাগলে না?

দুয়ারে সাপের গর্জন শোনো নাকি?
কত অসংখ্য ক্ষুধিতের সেথা ভিড়,
হে মাঝি ! তোমার বেসাতি ছড়াও, শোনো,
নইলে যে সব ভেঙে হবে চৌচির ।

তুমি দেখছো না, এরা চলে কোন আলেয়ার পিছে পিছে ?
চলে ক্রমাগত পথ ছেড়ে আরও নিচে !
হে মাঝি ! তোমার সেতারা নেভেনি একথা জানো তো তুমি,
তোমার চাঁদনি রাতের স্বপ্ন দেখেছে এ মরুভূমি,
দেখ জমা হল লালা রায়হান তোমার দিগন্তরে;
তবু কেন তুমি ভয় পাও, কেন কাঁপো অজ্ঞাত ডরে!

তোমার জাহাজ হয়েছে কি বানচাল,
মেঘ কি তোমার সেতারা করে আড়াল?
তাই কি অচল জাহাজের ভাঙা হাল
তাই কি কাঁপছে সমুদ্র ক্ষুধাতুর
বাতাসে ফাঁপানো তোমার ও ফাঁকা পাল?
জানি না, তবুও ডাকছি তোমাকে সাত দরিয়ার মাঝি,
প্রবাল দ্বীপের নারিকেল শাখা বাতাসে উঠেছে বাজি।
এ ঘুমে তোমার মাঝিমাল্লার ধৈর্য নেইকো আর,
সাত সমুদ্র নীল আক্রোশে তোলে বিষ ফেনভার,
এদিকে অচেনা যাত্রী চলেছে আকাশের পথ ধরে
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
বেসাতি তোমার পূর্ণ করে কে মারজানে মর্মরে?
ঘুম ঘোরে তুমি শুনছ কেবল দুঃস্বপ্নের গাঁথা।

উচ্ছৃঙ্খল রাত্রির আজো মেটেনি কি সব দেনা?
সকাল হয়েছে। তবু জাগলে না?
তবু তুমি জাগলে না?

তুমি কি ভুলেছ লবঙ্গ ফুল, এলাচের মৌসুমী,
যেখানে ধূলিতে কাঁকরে দিনের জাফরান খোলে কলি,
যেখানে মুগ্ধ ইয়াসমিনের শুভ্র ললাট চুমি
পরীর দেশের স্বপ্ন সেহেলি জাগে গুলে বকাওলি!

ভুলেছ কি সেই প্রথম সফর জাহাজ চ’লেছে ভেসে
অজানা ফুলের দেশে,
ভুলেছ’ কি সেই জামরুদ তোলা স্বপ্ন সবার চোখে
ঝলসে চন্দ্রালোকে,
পাল তুলে কোথা জাহাজ চলেছে কেটে কেটে নোনা পানি,
অশ্রান্ত সন্ধানী।
দিগন্ত নীল-পর্দা ফেলে সে ছিঁড়ে
সাত সাগরের নোনা পানি চিরে চিরে।

কোন্ অজ্ঞাত বন্দরে এসে লাগলো সেই জাহাজ
মনে পড়ে নাকো আজ,
তবুও সেখানে ভ’রেছে জাহাজ মারজানে মর্মরে
এইটুকু মনে পড়ে।
কবে যে তোমার পাল ফেটে গেছে উচ্ছৃঙ্খল ঝড়ে,
তোমার স্বপ্নে আজ অজগর দুঃস্বপ্নেরা ফেরে!
তারা ফণা তোলে জীর্ণ তোমার মৃত্যুর বন্দরে
তারা বিষাক্ত করেছে তোমার নুয়ে পড়া আকাশেরে।

তবু শুনবে কি, তবু শুনবে কি সাত-সাগরের মাঝি
শুকনো বাতাসে তোমার রুদ্ধ কপাট উঠেছে বাজি;
এ নয় জোছনা-নারিকেল শাখে স্বপ্নের মর্মর,
এ নয় পরীর দেশের ঝরোকা নারঙ্গি বন্দর
এবার তোমার রুদ্ধ কপাটে মানুষের হাহাকার,
ক্ষুধির শিশুর কান্নায় শেষ সেতারের ঝংকার।

আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
ভাঙা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।

কে জানে কখন কেটেছে তোমার স্বপ্নমুগ্ধ রাত,
আজকে কঠিন ঝড়ের বাতাস দ্বারে করে কষাঘাত,
সর্প-চিকন জিহ্বায় তার মৃত্যুর ইঙ্গিত,
প্রবল পুচ্ছ আঘাতে তোমার রঙীন মিনার ভাঙে।
হে মাঝি! তবুও থেমো না দেখে এ মৃত্যুর ইঙ্গিত,
তবুও জাহাজ ভাসাতে হবে এ শতাব্দী মরা গাঙে।

এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ,
এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠছে কেঁপে,
এখানে এখন অজস্র ধারা উঠছে দু’চোখ ছেপে
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ…

কাঁকর বিছানো পথ,
কত বাধা, কত সমুদ্র, পর্বত,
মধ্যদিনের পিশাচের হামাগুড়ি,
শকুনি ফেলেছে ছায়া আমাদের মাথার উপরে উড়ি,
ফেলেছি হারায়ে তৃণঘন বন, যত পুষ্পিত বন,
তবু দেখা যায় দুরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ…
শাহী দরজার সকল কপাট অনেক আগেই খোলা,
অনেক আগেই সেখানে দ্বাদশী জোছনা দিয়েছে দোলা।

হে মাঝি! তোমার নোঙ্গর তুলবে না?
এখনো কি আছে দেরী?
হে মাঝি! তোমার পাল আজ খুলবে না?
এখনো কি তার দেরী?

বাতাসে কাঁপছে তোমার সকল পাল
এবার কোরো না দেরী,
নোনা পানি যদি ছুুঁয়েছে তোমার হাল
তা’হলে কোরোনা দেরী,
এবার তা’হলে বাজাও তোমার যাত্রার জয়ভেরী,
আসুক যাত্রী পথিক, হে মাঝি এবার কোরো না দেরী।

দেরী হয়ে গেছে অনেক জানো তা তুমি,
ফিরে গেছে কত জাহাজ-ভাসানো দরিয়ার মৌসুমী,
কত এলাচের দানা উড়ে গেছে ঝড়ে
দারুচিনি-শাখা ভেঙেছে বনান্তরে,
মেশ্কের বাস বাতাস নিয়েছে লুটি’
মৃত্যু এখন ধরেছে তোমার টুটী,
দুয়ারে জোয়ার ফেনা;
আগে বহু আগে ঝরেছে তোমার সকল হাসনাহেনা।

সকল খোশবু ঝরে গেছে বুস্তানে,
নারঙ্গি বনে যদিও সবুজ পাতা-
তবু তার দিন শেষ হয়ে আসে ক্রমে-
অজানা মাটির অতল গভীর টানে
সবুজ স্বপ্ন ধূসরতা বয়ে আনে
এ কথা সে জানে
এ কথা সে জানে।

তুব সে জাগাবে সব সঞ্চয়ে নারঙ্গি রক্তিম,
যদিও বাতাসে ঝরছে ধূসর পাতা;
যদিও বাতাসে ঝরছে মৃত্যু হিম,
এখনো যে তার জ্বলে অফুরান আশা;
এখনো যে তার স্বপ্ন অপরিসীম।

হে মাঝি! এবার তুমিও পেয়ো না ভয়,
তুমিও কুড়াও হেরার পথিক-তারকার বিস্ময়,
ঝরুক এ ঝরে নারঙ্গি পাতা, তবু পাতা অগণন
ভিড় করে- যেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজ-তোরণ।

সে পথে যদিও পার হতে হবে মরু
সে পথে যদিও দরিয়ার নোনা পানি
তবুও সে পথে আছে মঞ্জিল, জানি আছে ছায়াতরু
            পথে আছে মিঠে পানি।

তবে পাল খোলো, তবে নোঙ্গর তোলো;
এবার অনেক পথ শেষে সন্ধানী!
হেরার তোরণ মিলবে সমুখে জানি।
তবে নোঙ্গর তোলো
তবে তুমি পাল খোলো,
তবে তুমি পাল খোলো ॥

ছড়ার আসর ১৩ / ফররুখ আহমদ

আয়রে ঘোড়া পরেনদা
পাখনা মেলে উড়ে যা,
কিসসা শুনি রোজ আমি
করি যে তোর খোঁজ আমি,-
জোসনা যখন ফুটফুটে
মনে মনে যাই ছুটে,
সাঁঝের পরী রয় পীছে;
মাটির ধরা রয় নিচে।।

ছড়ার আসর ১২ / ফররুখ আহমদ

চেরাগটাতে জ্বালো
আঘণ মাসের আলো;
নীহার-ভেজা মাঠে নামে
রাতের ছায়া কাল,
মাগো তোমার কিসসা কথা
লাগবে এখন ভাল।।

ছড়ার আসর ০৯ / ফররুখ আহমদ

ভয়ে পালায় বোকা,
ভয় পায় না খোকা!
খোকন সোনার সাহস ছিল,
বুদ্ধি ছিল চোখা;
ভয় না পেয়ে ভেঙে দিল
হুতোম পেঁচার ধোঁকা।।

ছড়ার আসর ০৮ / ফররুখ আহমদ

“আলফা ডাঙায় যাবি কে?
আমটা পেড়ে খাবি কে?”

“আলফা ডাঙার মাঠে
ধুতুম, ধুতুম ডাকে;
আলফা ডাঙায় যাব না
আমটা আমি খাব না।”

ছড়ার আসর ০৭ / ফররুখ আহমদ

বড় হ’লে যাবো আমি
‘হলদি কোটা’র দেশে,
তা’রা- সাঁঝ সকালে ডাকে,
তা’রা- ফুল কুড়িয়ে রাখে,
তা’রা- মেহেদী পাতায় হাত রাঙিয়ে
বেড়ায় খেলে হেসে।।

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: