সাত সাগরের মাঝি / ফররুখ আহমদ

কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হ’ল জানি না তা’।
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা ।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না? তবু, তুমি জাগলে না?
সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকে জাহাজ,
অচল ছবি সে, তসবির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ।
হালে পানি নাই, পাল তার ওড়ে নাকো,
হে নাবিক! তুমি মিনতি আমার রাখো;
তুমি উঠে এসো, তুমি উঠে এসো মাঝি মাল্লার দলে
দেখবে তোমার কিশতি আবার ভেসেছে সাগর জলে,
নীল দরিয়ায় যেন সে পূর্ণ চাঁদ
মেঘ তরঙ্গ কেটে কেটে চলে ভেঙে চলে সব বাঁধ ।
তবু তুমি জাগো, কখন সকালে ঝরেছে হাসনাহেনা
এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না? তবু, তুমি জাগলে না?

দুয়ারে সাপের গর্জন শোনো নাকি?
কত অসংখ্য ক্ষুধিতের সেথা ভিড়,
হে মাঝি ! তোমার বেসাতি ছড়াও, শোনো,
নইলে যে সব ভেঙে হবে চৌচির ।

তুমি দেখছো না, এরা চলে কোন আলেয়ার পিছে পিছে ?
চলে ক্রমাগত পথ ছেড়ে আরও নিচে !
হে মাঝি ! তোমার সেতারা নেভেনি একথা জানো তো তুমি,
তোমার চাঁদনি রাতের স্বপ্ন দেখেছে এ মরুভূমি,
দেখ জমা হল লালা রায়হান তোমার দিগন্তরে;
তবু কেন তুমি ভয় পাও, কেন কাঁপো অজ্ঞাত ডরে!

তোমার জাহাজ হয়েছে কি বানচাল,
মেঘ কি তোমার সেতারা করে আড়াল?
তাই কি অচল জাহাজের ভাঙা হাল
তাই কি কাঁপছে সমুদ্র ক্ষুধাতুর
বাতাসে ফাঁপানো তোমার ও ফাঁকা পাল?
জানি না, তবুও ডাকছি তোমাকে সাত দরিয়ার মাঝি,
প্রবাল দ্বীপের নারিকেল শাখা বাতাসে উঠেছে বাজি।
এ ঘুমে তোমার মাঝিমাল্লার ধৈর্য নেইকো আর,
সাত সমুদ্র নীল আক্রোশে তোলে বিষ ফেনভার,
এদিকে অচেনা যাত্রী চলেছে আকাশের পথ ধরে
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
বেসাতি তোমার পূর্ণ করে কে মারজানে মর্মরে?
ঘুম ঘোরে তুমি শুনছ কেবল দুঃস্বপ্নের গাঁথা।

উচ্ছৃঙ্খল রাত্রির আজো মেটেনি কি সব দেনা?
সকাল হয়েছে। তবু জাগলে না?
তবু তুমি জাগলে না?

তুমি কি ভুলেছ লবঙ্গ ফুল, এলাচের মৌসুমী,
যেখানে ধূলিতে কাঁকরে দিনের জাফরান খোলে কলি,
যেখানে মুগ্ধ ইয়াসমিনের শুভ্র ললাট চুমি
পরীর দেশের স্বপ্ন সেহেলি জাগে গুলে বকাওলি!

ভুলেছ কি সেই প্রথম সফর জাহাজ চ’লেছে ভেসে
অজানা ফুলের দেশে,
ভুলেছ’ কি সেই জামরুদ তোলা স্বপ্ন সবার চোখে
ঝলসে চন্দ্রালোকে,
পাল তুলে কোথা জাহাজ চলেছে কেটে কেটে নোনা পানি,
অশ্রান্ত সন্ধানী।
দিগন্ত নীল-পর্দা ফেলে সে ছিঁড়ে
সাত সাগরের নোনা পানি চিরে চিরে।

কোন্ অজ্ঞাত বন্দরে এসে লাগলো সেই জাহাজ
মনে পড়ে নাকো আজ,
তবুও সেখানে ভ’রেছে জাহাজ মারজানে মর্মরে
এইটুকু মনে পড়ে।
কবে যে তোমার পাল ফেটে গেছে উচ্ছৃঙ্খল ঝড়ে,
তোমার স্বপ্নে আজ অজগর দুঃস্বপ্নেরা ফেরে!
তারা ফণা তোলে জীর্ণ তোমার মৃত্যুর বন্দরে
তারা বিষাক্ত করেছে তোমার নুয়ে পড়া আকাশেরে।

তবু শুনবে কি, তবু শুনবে কি সাত-সাগরের মাঝি
শুকনো বাতাসে তোমার রুদ্ধ কপাট উঠেছে বাজি;
এ নয় জোছনা-নারিকেল শাখে স্বপ্নের মর্মর,
এ নয় পরীর দেশের ঝরোকা নারঙ্গি বন্দর
এবার তোমার রুদ্ধ কপাটে মানুষের হাহাকার,
ক্ষুধির শিশুর কান্নায় শেষ সেতারের ঝংকার।

আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
ভাঙা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।

কে জানে কখন কেটেছে তোমার স্বপ্নমুগ্ধ রাত,
আজকে কঠিন ঝড়ের বাতাস দ্বারে করে কষাঘাত,
সর্প-চিকন জিহ্বায় তার মৃত্যুর ইঙ্গিত,
প্রবল পুচ্ছ আঘাতে তোমার রঙীন মিনার ভাঙে।
হে মাঝি! তবুও থেমো না দেখে এ মৃত্যুর ইঙ্গিত,
তবুও জাহাজ ভাসাতে হবে এ শতাব্দী মরা গাঙে।

এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ,
এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠছে কেঁপে,
এখানে এখন অজস্র ধারা উঠছে দু’চোখ ছেপে
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ…

কাঁকর বিছানো পথ,
কত বাধা, কত সমুদ্র, পর্বত,
মধ্যদিনের পিশাচের হামাগুড়ি,
শকুনি ফেলেছে ছায়া আমাদের মাথার উপরে উড়ি,
ফেলেছি হারায়ে তৃণঘন বন, যত পুষ্পিত বন,
তবু দেখা যায় দুরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ…
শাহী দরজার সকল কপাট অনেক আগেই খোলা,
অনেক আগেই সেখানে দ্বাদশী জোছনা দিয়েছে দোলা।

হে মাঝি! তোমার নোঙ্গর তুলবে না?
এখনো কি আছে দেরী?
হে মাঝি! তোমার পাল আজ খুলবে না?
এখনো কি তার দেরী?

বাতাসে কাঁপছে তোমার সকল পাল
এবার কোরো না দেরী,
নোনা পানি যদি ছুুঁয়েছে তোমার হাল
তা’হলে কোরোনা দেরী,
এবার তা’হলে বাজাও তোমার যাত্রার জয়ভেরী,
আসুক যাত্রী পথিক, হে মাঝি এবার কোরো না দেরী।

দেরী হয়ে গেছে অনেক জানো তা তুমি,
ফিরে গেছে কত জাহাজ-ভাসানো দরিয়ার মৌসুমী,
কত এলাচের দানা উড়ে গেছে ঝড়ে
দারুচিনি-শাখা ভেঙেছে বনান্তরে,
মেশ্কের বাস বাতাস নিয়েছে লুটি’
মৃত্যু এখন ধরেছে তোমার টুটী,
দুয়ারে জোয়ার ফেনা;
আগে বহু আগে ঝরেছে তোমার সকল হাসনাহেনা।

সকল খোশবু ঝরে গেছে বুস্তানে,
নারঙ্গি বনে যদিও সবুজ পাতা-
তবু তার দিন শেষ হয়ে আসে ক্রমে-
অজানা মাটির অতল গভীর টানে
সবুজ স্বপ্ন ধূসরতা বয়ে আনে
এ কথা সে জানে
এ কথা সে জানে।

তুব সে জাগাবে সব সঞ্চয়ে নারঙ্গি রক্তিম,
যদিও বাতাসে ঝরছে ধূসর পাতা;
যদিও বাতাসে ঝরছে মৃত্যু হিম,
এখনো যে তার জ্বলে অফুরান আশা;
এখনো যে তার স্বপ্ন অপরিসীম।

হে মাঝি! এবার তুমিও পেয়ো না ভয়,
তুমিও কুড়াও হেরার পথিক-তারকার বিস্ময়,
ঝরুক এ ঝরে নারঙ্গি পাতা, তবু পাতা অগণন
ভিড় করে- যেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজ-তোরণ।

সে পথে যদিও পার হতে হবে মরু
সে পথে যদিও দরিয়ার নোনা পানি
তবুও সে পথে আছে মঞ্জিল, জানি আছে ছায়াতরু
            পথে আছে মিঠে পানি।

তবে পাল খোলো, তবে নোঙ্গর তোলো;
এবার অনেক পথ শেষে সন্ধানী!
হেরার তোরণ মিলবে সমুখে জানি।
তবে নোঙ্গর তোলো
তবে তুমি পাল খোলো,
তবে তুমি পাল খোলো ॥

আউলাদ / ফররুখ আহমদ

অনেক ঝড়ের দোলা পার হ’য়ে এল সে নাবিক।
অনেক ক্ষুধিত রাত্রি, আর বহু সামুদ্রিক
চঞ্চল করেছে তারে, অন্ধকারে হারায়েছে দিক,
কালা-পানি ঘিরে ঘিরে ডাকিয়াছে মৃত্যুর দূতীরা,
ভেঙে-পড়া জাহাজের বেঁকে যাওয়া খোল ভ’রে তার
উঠিয়াছে ব্যর্থতার স্বেদসিক্ত চরম নিরাশা,
সম্মুখে ডেকেছে তারে হিংস্র-নীল তিমির পাথার;
অচেনা জগতে তবু সে নাবিক খুঁজে পেল বাসা।
যদিও দু’চোখ তার দুঃস্বপ্নের কালো ভয়ে ভরা
যদিও বিবর্ণ ওষ্ঠে লেগে আছে মৃত্যুর আস্বাদ,
তবু জীর্ণ জাহাজের ভাঙা খোল আজ জয়ে ভরা
পশ্চাতে জাগিয়েছে শুধু সে দুঃসহ স্মৃতির নিষাদ
বহু ঝড় পার হয়ে এনেছে সে সম্পূর্ণ পশরা,
মানুষের আউলাদ ফিরেছে বিজয়ী সিন্দবাদ।
দুর্গম সমুদ্র পারে আরেক অচেনা লোকে
দেখিছে সে মানুষের ঘর
জীবন্ত কবর,
যেথা বাসা বেঁধে আছে দাম্ভিকের মৃত মরুমন
পাথর জমানো প্রহসন।
সারে সারে
কাতারে কাতারে
চলে ভারবাহী দল,
গাঁইতি, শাবল নিয়ে
কলম, লাঙল নিয়ে,
শ্রান্ত পদতল
চলে যাত্রীদল,
চলে ক্ষুধাতুর শিশু শীর্ণদাঁড়া, আর
চলিতেছে অসংখ্য কাতার
পার হ’য়ে মরু, মাঠ, বন।
মানুষের আদালত ঘরে
পাথর-জমানো প্রহসন।
চলে দল বেঁধে শিশু ওষ্ঠে তুলি জীবনের
পানপাত্র সুতীব্র বিস্বাদ
মানুষের বুভুক্ষু মুমূর্ষু আউলাদ!
জনতার-
পাথর জমানো পথ,
এ বীভৎস সভ্যতার
গড়খাই কাটা পথ
আঁধারে ঢাকিয়া আকাশেরে
ডাকে তাহাদেরে ॥
এ কোন পরিখা?
এখানে জ্বলিছে শুধু ক্ষুধাতুর দিবসের শিখা
বিষাক্ত ধোঁয়ার কুজঝটিকা
মৃত্যুর বিকট বিভীষিকা।
মজলুম মনের বোঝা, ভারাক্রান্ত বেদনা অগাধ,
তারই মাঝে লাথি খেয়ে চলে আজ আদমের মৃত আউলাদ,
শয়তানের ডরে;
বীভৎস কবরে;
জটিল গহ্বরে।
দল বেঁধে চলিছে শিশুরা মড়কের পথে,
কুৎসিত কুটিল প্রান্তে অন্ধকার শড়কে বিপথে
যেখানে প্রত্যেক প্রান্তে আজাজিল পাতিয়াছে ফাঁদ
তারি পানে, দুর্নিবার টানে চলে আজ মানুষের
দুর্বল, বিশীর্ণ আউলাদ।
আমি দেখি পথের দু’ধারে ক্ষুধিত শিশুর শব,
আমি দেখি পাশে পাশে উপচিয়া পড়ে যায়
ধনিকের গর্বিত আসব,
আমি দেখি কৃষাণের দুয়ারে দুর্ভিক্ষ বিভীষিকা,
আমি দেখি লাঞ্চিতের ললাটে জ্বলিছে শুধু অপমান টিকা,
গর্বিতের পরিহাসে মানুষ হয়েছে দাস,
নারী হ’ল লুণ্ঠিতা গণিকা।
অনেক মঞ্জিল দূরে প’ড়ে আছে মানুষের ঘাঁটি,
এখানে প্রেতের বহির্বাটি
এখানে আবর্তে পথহারা
চলিতেছে তারা
তাদেরে দিয়েছে ডাক জড়তার ক্রুর আজদাহা,
শতকের সভ্যতার এরা আজ হ’ল তাই অন্ধ, গুমরাহা।
বাড়ায়ে ত্রস্তের দল, বাড়াবে ভ্রন্টের দল,
নর-ঘাতকের সাথে, নারী-ঘাতকের হাতে
হ’ল এরা শোণিত-চঞ্চল
হ’ল এরা জালিম, নিষাদ,
মানুষের অমানুষ মৃত আউলাদ।
পায় পায় বাধা শৃঙ্খল-বন্ধন,
থেমে যায় জীবন-স্পন্দন,
মানুষের আদালতে
পাথর-জমানো প্রহসন।
এবার
ক্লীবের প্রতীক এই মানুসের আদালতে নয়,
শয়তানের কাদা মাখা কালো পথে নয়-
এবার আল্লার আদালতে
আমাদের ফরিয়াদ,
ক্ষুধিত লুণ্ঠিত এই মানুষের রিক্ত ফরিয়াদ।
অনেক সভ্যতা জানি মিশেছে ধূলির নীচে, অনেক সামুদ
কত ফেরাউন, কত জালিম পিশাচ নমরুদ
মিশে গেল ধূলিতলে
নতুন যাত্রীর দল দেখা দিল দুর্গম উপলে
উড়ায়ে নিশান
সাথে ক’রে নিয়ে এল জীবনের অ-শ্রান্ত তুফান।
শুনি আজ তাদেরি দামামা
বাতাসে ওড়ে তাহাদের বিজয়ী আমামা
শুনি শুধু তাহাদেরি স্বর
বলিষ্ঠ বক্ষের তলে সুকোমল অন্তরের স্বর…
আর যেন ক্লিষ্ট নাহি হয়
আর যেন ত্রস্ত নাহি হয়,
পথে দেখি- পীড়নের ফাঁদ,
আর যেন ভ্রষ্ট নাহি হয়
মানুষের ভবিষ্য দিনের আউলাদ ॥

নিশান-বরদার / ফররুখ আহমদ

দিন রাত্রির বোঝা হ’ল আজ দুঃসহ গুরুভার,
স্খলিত পথীর আয়োজন চলে পশ্চাৎ যাত্রার,
চারদিকে বন মরণ শর্তে জীবনের অধিকার-
এখানে তোমার নিশান ওড়াও হে নিশান বরদার।
ঘন হ’য়ে এল দুঃখের রাত তিমির নিবিড়তর
এবার তোমার আলেঅর নিশান এ-পথে প্রকাশ ক’রো,
সূর্যের ঝড়ে এই আঁধারের মরাপাতা ফেলো ছিঁড়ে
মৃত্যুর তীরে তীরে
ওড়াও তোমার প্রথম ঊষার দীপ্ত বহ্নিশিখা
আলোর তুফানে ভাসাও জীর্ণ শেহেলা কুজঝটিকা।
তোমার নিশান উড়ছে কোথায় নির্জন প্রান্তরে,
জনারণ্যের এখানে শূন্য শাখা,
নীড় ছেড়ে তার স্বপ্নের পাখী বহুদিন পলাতকা
জরাস্থবির গুমরি মরে-
হে নিশান-বরদার।
ইব্রাহিমের পথ বেয়ে যার শুরু হ’ল যাত্রার,
কমলিওয়ালার ডেরায় যে পেল ঠাই
সেই কাহফিল-ওয়ারার নিশান শারাবন তহুরার
কাফুর সুবাস ব’য়ে নিয়ে আসে পার হ’য়ে কান্তার;
তুমি আনো সেই আলোর ইশারা ভাঙো এ তিমির দ্বার
মৃতারণ্যের এ মনে আবার তুমি তার করো ঠাই।
মুক্ত কা’বার ভেঙেছে ‘লাত’ ‘মানাত’
কালের কোঠায় তবু বদলিয়ে হাত
মনে মনে বাসা বেঁধেছে লাত মানাত
মিরু মজ্জায় আদ সামুদের জড়তার কালোরাত।
কোথায় আলোর দূত?
মাথা চাড়া দিয়ে কাঁটা বনে জাগে আদ সামুদ।
চারদিকে কারা ফেলে বিষাক্ত শ্বাস,
কারা ব’য়ে আনে করোটিতে মৃতাসব,
শবের মিছিলে ভিড় ক’রে আসে শব;
মুখে ব’য়ে আনে চরম সর্বনাশ।
সে পাশবতার আজ উদ্যত ফণা
বিষাক্ত করে সুদূর সম্ভাবনা,
ভেঙে পড়ে তার পুচ্ছ আঘাতে স্বপ্নের চারাগাছ,
লাত মানাতের সঙ্গে নাচে পিশাচ
আধো জীবন্ত তনু;
রং চটা তার আকাশে কখন নিভেছে বর্ণধনু।
সে সিঁদরাতুল-মুনতাহার
পথ ভোলা বুলবুলি,
প্রতি মুহুর্তে আবিল করে সে
এই ধরণীর ধূলি,
ম্লান জুলমাতে আজ সে বিবর গড়ি
দীপ্ত দিনেরে ক’রেছে কখন বিস্বাদ শর্বরী।
তার কণ্ঠের বীভৎস চিৎকারে-
কেঁপে ওঠে বারে বারে
উষর মাটির বক্ষে অনুর্বর
দুঃস্বপ্নের ঘর।
শঙ্কিত তার দিনের আকাশ,
বিভীষিকা ভরা ঘুম,
ছিন্ন ডেরার দুয়ারে আঘাত
হানে মরু সাইমুম,
তার কলিজার রক্তে রঙিন গ’ড়ে ইমারত,
তার কঙ্কাল বিছায়ে জালিম মাপে মিনারের পথ;
পথে পথে আজ শোন তার হাহাকার
হে নিশান-বরদার।
এখানে তোমার নিশান ওড়াও, নিশান ওড়াও বীর,
এখানে শুধুই আবছায়া রাত্রির
তিমির নিবিড়তর,
এখানে তোমার সূর্য প্রকাশ করো।
জনারণ্যের শাখায় শাখায় জাগে প্রাণ-ব্যাকুলতা
আনো আনো তার বিপুল তৃষার দুকূলে উচ্ছলতা
সমুদ্র স্রোতোধার;
হে নিশান-বরদার ॥

নিশান / ফররুখ আহমদ

আধো চাঁদ আঁকা নিশান আমার! নিশান আমার!
তুমি একদিন এনেছিলে বান-জীবন তুফান!
জুলফিকারের, খালেদী বাজুর তুমি সওয়ার,
উমরের পথে বিশ্বের দ্বারে হে অম্লান,
পার হয়ে গেছ বিয়াবান আর খাড়া পাহাড়
সবল হাতের কবজায় যবে ছিলে সওয়ার।
কমজোর বাজু পারে না বইতে ও গুরুভার,
সঙ্গ দিলে আজ ওড়ে না নিশান মানবতার;
চারদিকে আজ দেখছে সে তাই মৃত্যু তার।
কার হাতে তুমি সওয়ার হ’য়েছ আল হেলাল?
আরাফাত মাঠ প’ড়ে আছে ম্লান নাই বেলাল।
তাই বিমর্ষ আকাশ-কিনার, দিনের মিনার;
পারি না ওড়াতে সেখানে নিশান-নিশান আমার।
অথবা পঙ্গু দুর্বল আজ ঈমান তাই
পরাজিতের এ দুয়ারে জেহাদী নিশান নাই,
আজ প’ড়ে আছি খেলার পুতুল আজাজিলের,
মুমিনের দিল হারায়ে আমরা মৃত দিলের
বোঝা ব’য়ে যাই ফরমান মেনে প্রবৃত্তির
তাই ক্রমাগত দূর স’রে যায় দিনের তীর…
অন্ধ বধির মৃত্যুর নীড়, আসে শিকল,
শাসনে, শোষণে সারা তনুমন জরা-বিকল।
আজকে তোমাকে ডাক দিই তাই হে অপচল।
হে জুলমাতের সফেদ মুক্তি, চির অটল।
তুমি ফিরে এসো আমাদের হাতে। শুভ্র ঊষার
সাফা মারোয়াঁর তাজা প্রাণ নিয়ে পথিক হেরার
জ্বলায়ে যাও এ মৃত জনপদ সিপাহসালার,
ভেঙে ফেলো এই জগদ্দলের মৃত্যু দুয়ার।
হে নিশান ফের ইঙ্গিত দাও মানবতার,
হে নিশান ফের ইঙ্গিত দাও
মৃত যাত্রীকে পথ চলার,
ইঙ্গিত দাও মানবতার সে
পূর্ণ চাঁদের ভরা-বিকাশ।
মানবতাহীন মানুষের বুকে
যেখানে উঠেছে নাভিশ্বাস,
বঞ্চিত তনু মনের আকাশ
খাক হ’য়ে যেথা জ্বলে আকাশ,
চৈত্র-দগ্ধ পোড়া মাটি ম্লান
নিষ্প্রভ নীল শূন্যাকাশ,
সেখানে জাগাও সাড়া সু-প্রবল
দাও আহ্বান পথ চলার;
সেখানে তোমার ইশারা জানাও মানবতার।
তায়েফের পথে শোণিত স্নানের আমন্ত্রণ,
জেরুজালেমের দুস্তর মাঠ
পাড়ি দিতে করো পরাণপণ!
নিশান আমার! নিশান আমার!
একী নির্দেশ সীমা-বিলোপ।
সবুজের বন কেতকীর বন
সে কি শুধু হবে মনসা-ঝোপ।
সেখানে কি তুমি জাগবে না আর নিশান আমার?
সেখানে কি তুমি জেগেছ আবার নিশান আমার?
আউষ ধানের দেশে মদিনার রক্ত গোলাব
সকল আশার পূর্ণতা নিয়ে মেলবে কলাপ,
বন্য ঝড়ের বৈশাখী পাখা নিশান আমার
আধো চাঁদ আঁকা, হায় মেঘ ঢাকা নিশান আমার।
পথে প্রান্তরে লুণ্ঠিত আজ যার জীবন,
যে মৃত দলের সম্মুখে ব্যুহ রচে মরণ
তাদের আকাশে জাগালে আজ এই কিসের পণ:
বাঁচাতে হবে এ ধূলি-লুণ্ঠিত গণ-জীবন।
এই অতুলন জীবন বাঁচাতে হবে,
পায়রার খোপ ছেড়ে কবুতর ভাসবে আবার নভে,
অনেক দিনের জরা-বিশীর্ণ পায়রা সে
মুক্ত হাওয়ার আস্বাদ হায় পায় না সে,
তারে দিতে হবে নতুন হাওয়ার
আস্বাদ আর নব চেতন,
পায়রার খোপে মহা-বিস্তৃতি
সিন্ধুতীরের উজ্জীবন।
বিরাট আকাশ ভরানো দিল।
উমরের সেই মহান দারাজ
দিগন্ত পারে ছড়ানো দিল।
নিশান আমার কি স্বপ্ন তুমি দেখছো আজ;
নিশান আমার শীর্ণ মুঠিতে
পেতে চাও তুমি মহা-নিখিল?
ক্ষুধিত মাটিতে সে নয় তাজমহল,
মানুষের মাঠে বিরান মাটিতে
এবার ফলাবে তাজা ফসল,
এবার নিশান থামবে না তুমি
গ’ড়তে শিলার তাজমহল,
এবার তোমার যাত্রা সেখানে
ক্ষুধা বিশীর্ণ অশ্রুজল,
এবার তোমার যাত্রা সে-পথে
যেথা উমরের পায়ের ছাপ,
জং ধ’রে যেথা প’ড়ে আছে হায়
আলীর হাতের জুলফিকার,
পিঠে বোঝা নিয়ে ক্ষুধিতের দ্বারে
চলে একটানা পথ তোমার;
দেখো সিরাজাম-মুনীরা জ্ব’লছে
মুছে দিতে সব ফাঁকা প্রলাপ…
গুঁড়ো ক’রে দিতে কুয়াশার ভিতে
ম্লান জড়তার স্থবির গতি,
নাস্তিকতার টুটি ছিঁড়ে নিতে
সায়ফুল্লার ঠিকরে জ্যোতি।
যেথা কবন্ধে মৃত জড়বাদ;
সেখানে জীবন চিরন্তন।
নিশার আমার ক’রবে কি ফের
সফেদ নূরের বীজ বপন?
নিশান আমার। নিমান আমার।
এতদিন হ’ল সময় তবে?
আজ কি অন্ধ নফসের সব
জিন্দানখানা ভাঙতে হবে?
পিছু ঠেলা দিয়ে জড় রোগীদের
দেবে কি আবার বিপুল গতি;
আল-বোর্জের অচল শিখরে
বহাবে কি প্রাণ স্রোতস্বতী।
নিশান আমার! একদিন তুমি হে দূত ঊষার
খালেদের হাতে, তারেকের হাতে, হ’য়েছ সওয়ার,
উমর আলির হাতের নিশান নবীজীর দান।
আমাদের কাছে নিশান তোমার শিখা হ’ল ম্লান।
তুমি আনো ফের হেজাজ মাঠের মরু সাইমুম
ভাঙো আঁধারের শিখর ওড়াও জড়তার ঘুম,
তুমি আনো সাথে মানবতার সে নির্ভীক ঝড়
প্রলয়াকাশের বুকে জীবনের দাও স্বাক্ষর,
আউষ ধানের দেশে মদিনার সৌরভ ভার
ঝড় বৈশাখে জাগো নির্ভীক, জাগো নিশঙ্ক হেলাল আবার!
হও প্রতিষ্ঠ আকাশে আকাশে নিশান আমার
নিশান আমার ॥

হে নিশান-বাহী / ফররুখ আহমদ

নিশান কি ঝড়ে প’ড়ে গেছে আজ মাটির ‘পরে?
আধো চাঁদ-আঁকা সেই শাশ্বত জয়-নিশান?
বহু মৃত্যুর প্রলয়-আঘাতে, প্রবল ঝড়ে
নুয়ে গেছে সেই প্রথম দিনের জয়-নিশান?
হামাগুড়ি দিয়ে কারা চলে ঐ পতাকীদল?
কার ক্রন্দনে ভরছে শূন্য জলস্থল?
নিশান কি আজ প’ড়ে গেছে ভূঁয়ে,
নিশান-বাহী কি চলে মাটি ছুঁয়ে
শিয়রে কি তার কঠিন বাধার জগদ্দল?
বুক চাপা দেওয়া ঘন মিথ্যার জগদ্দল?
হে নিশান-বাহী! আজো সম্মুখে রাতের সীমা
দৃষ্টি রোধে কি তিমিরাচলের ঘন ম্লানিমা?
আজো সম্মুখে বন্ধুর পথ বালিয়াড়ির
সঙ্গী বিহীন জনতা-মুখর সাগরতীর?
ঐ দেখো স্রোতে অরূপ আলোকে সূর্যতরী
তিক্ষ্ণ আলোর তুফানে ছিঁড়িছে এ শর্বরী,
এই কালো রাত জমাট-তুহিন হিম-অতল,
ছিঁড়ে চ’লে যায় আলোর ছোঁয়ায় গলানো জল।
পাওনি এখনো আলোর পরশ নবজীবন?
মৃত শব হতে হয়নি কি আজো উজ্জীবন,
এখনো সূর্য ভাঙেনি কি এই রাতের সীমা,
এখনো তোমার পথ ছেয়ে আছে  ঘনম্লানিমা?
হে নিশান-বাহী! তাই আছো নুয়ে?
তাই কি পতাকা আছে মাটি ছুঁয়ে?
তবু এই চলা জানে উদয়ের পূর্বাভাস,
কালো কুয়াশার পর্দায় ঢাকা
তোমার সূর্য, আলো, আকাশ।
পায়ের তলায় প্রবল অশ্বখুরে
মরুবালুকার স্ফুলিঙ্গ উঠে নির্মেষে মিলায় দূরে,
ওড়ে বাতাসের শিখার শিখরে মুক্তি লাল,
শ্বেত পতাকায় শান্তিচিহ্ন আল-হেলাল।
সেই উদ্দাম রণতরঙ্গ মানে না বাধা,
পলকে পলকে জ্বলে তার খুরে অগ্নিশিখা।
আলোর প্লাবনে কে নিশান-বাহী অগ্রগামী,
ঝড়ের দাপটে ভাঙে শতকের কুজঝটিকা?
আমাকে জাগাও তোমার পথের ধারে,
আমাকে জাগাও এ বিজন কান্তারে,
আমাকে জাগাও যেখানে সেনানী। মানে না বাঁধন রবি,
আমাকে জাগাও যেখানে দীপ্ত সে মদিনাতুন্নবী,
বিশ্বকরুণা, মুক্তি পদ্ম-বেদনা লাল
বহিছে চিত্ত-সুরভিত-শ্বেত আল হেলাল ॥
আজ দেখি হেথা ভাঙে গড়ে শর্বরী বিস্বাদ,
পাপড়ি খোলার মুহুর্তে জাগে মুমুর্ষ অবসাদ।
কোথায় নিশান, কালের পাখায় মিলালো কোথা সে-দিন,
সেই অভিযান-স্মৃতি নিয়ে আছে মরুভূমি ধূলিলীন,
জরাগ্রস্ত এ শ্বাপদ ভূমির রজনী-স্বপ্নহীন,
প্রবল বাধার পাহারায় হেথা উদ্যত সংগীন ॥
হে নিশান-বাহী। অশ্বখুরের প্রবল ধ্বনি
যায় না শোনা,
আজ অগণন ক্ষুধিত মুখের আর্তধ্বনি
যায় না গোণা।
কোথায় তোমার বীর-সঙ্গীর উদ্বোধন?
ফিরে আসে আজ নিরাশ হাওয়ায় শূন্যমন।
মাটি ছোঁওয়া হায় তোমার নিশান ওড়ে না ঝড়ে;
তোমার সাথীরা পথে প্রান্তরে জরায় মরে।
হে নিশান-বাহী! ওড়াও তবু আধেক চাঁদ,
ভাঙো বারবার রাত্রির দ্বার মৃত্যুবাঁধ
হয়তো এখানে জাগিবে না আজ শস্ত্রধ্বনি,
ভাঙা শিরদাঁড়া হবে শঙ্কিত মৃত্যু গণি;
হে নিশান-বাহী! ওড়াও তবুও ওড়াও
হেলাল রশ্মি আকাশে আকাশে ছড়াও।
নিশান তোমার যদি না ওড়ে;
নিশান তোমার প্রবল ঝড়ে
যদি বা কখনো ধূলায় পড়ে
তবুও দিনের স্বপ্নসাধ
এ ধূলি-ধূসর পথের ‘পরে।
জানি এই-দল ভাঙা মিছিল
বিজয়ী মুঠিতে নেবে নিখিল,
খুলি রাত্রির তিমির খিল
জাগাবে সূর্য; জাগাবে নীল ॥
এখনো তোমার দৃষ্টিতে জাগে সুদূরের ইঙ্গিত-
সমুদ্রপথ আবিস্কারের বিপুল সম্ভাবনা।
নিমেষে আকাশ পার হ’য়ে এসে বসুধার সঙ্গীত
শুনিবার সাধ এখনো তোমার যায়নি অন্যমনা।
তুমি বেঁচে আছো, আজো বেঁচে আছো-সেনানীর তরবারী;
আধো চাঁদ আজো সঙ্গী তোমার যে আল-হেলালধারী।
তোমার তনুর অণুতে অণুতে সেই অশ্রুত সুর,
জাগ্রত মানবাত্মা হেরিছে সমুদ্র অশ্রুর।
আছে তার পার, সাগর-বেলার তীরে ভয় পেয়োনাকো
আধো চাঁদ আঁকা হে নিশানধারী, এ মিনতি মোর রাখো-
যেথা সমুদ্র হিংস্র ক্ষুধায় আঁধার-নীল
যেথা আবর্ত-সঙ্কুল স্রোত বাধা কুটিল ॥

তুফান / ফররুখ আহমদ

দুর্বার তরঙ্গ এক ব’য়ে গেল তীর-তীব্র বেগে,
বলে গেল: আমি আছি যে মুহুর্তে আমি গতিমান;
যখনি হারাই গতি সে মুহুর্তে  আমি আর নাই।
–    ইকবাল

সে তুফান থেমে গেছে, সাইমুমের সে দুর্ধষ পাখা-
সাহারার সূর্য-ঝড় লুপ্ত হিম-শর্বরী-অতলে,
অন্ধ, মূক আঁধারের অজগর হিংস্র ফণা তলে
দূরচারী বেদুইন-খর রশ্মি আজ মেঘে ঢাকা,
আজ মরু-বালুকাতে লুপ্ত তার বিজয়ী পতাকা,
সেই গতিহারা ঝঞ্ঝা ধূলিলীন অস্তিত্ববিহীন
দুর্ভিক্ষ মড়কে আজ গণিতেছে তার শেষ দিন
ক্ষুধার কাফনে তার সর্বগ্রাসী মৃত্যু অংগরাখা
সে বিপূল প্রাণ-বহ্নি তবু আজো মরে নাই জানি
হে বলিষ্ঠ! যদি তুমি নেমে এস এ-পথে বারেক
এই মৃত মরুতটে যদি তুমি দাঁড়াও সন্ধানী,
মানুষের এ মিছিলে দিতে পারো যদি গতিবেগ,
অনায়াসে সেই ঝড় আবার তুলিবে তারা টানি,
মৃত মাঠে দিয়ে যাবে সাহারার উদ্দাম আবেগ ॥

লাশ / ফররুখ আহমদ

(তেরশো পঞ্চাশে)

যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়,
কালো পিচ-ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়,
সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে জমিনের ‘পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর।
জানি মানুষের লাশ মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে ধরণীর ‘পর,
ক্ষুধিত অসাড় তনু বত্রিশ নাড়ীর তাপে প’ড়ে আছে
নিঁসাড় নিথর,
পাশ দিয়ে চ’লে যায় সজ্জিত পিশাচ, নারী নর
-পাথরের ঘর,
মৃত্যু কারাগার,
সজ্জিতা নিপুণা নটী বারাঙ্গনা খুলিয়াছে দ্বার
মধুর ভাষণে,
পৃথিবী চষিছে কারা শোষণে, শাসনে
সাক্ষ্য তার রাজপথে জমিনের ‘পর
সাড়ে তিন হাত হাড় রচিতেছে মানুষের অন্তিম কবর।
প’ড়ে আছে মৃত মানবতা
তারি সাথে পথে মুখ গুঁজে।
আকাশ অদৃশ্য হ’ল দাম্ভিকের খিলানে, গম্বুজে
নিত্য স্ফীতোদর
এখানে মাটিতে এরা মুখ গুঁজে মরিতেছে ধরণীর ‘পর!
এ পাশব অমানুষী ক্রুর
নির্লজ্জ দস্যুর
পৈশাচিক লোভ
করিছে বিলোপ
শাশ্বত মানব-সত্তা, মানুষের প্রাপ্য অধিকার,
ক্ষুধিত মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় রুধিয়া দুয়ার,
মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর;
সাক্ষ্য তার প’ড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরণীর ‘পর।
স্ফীতোদর বর্বর সভ্যতা-
এ পাশবিকতা,
শতাব্দীর ক্রূরতম এই অভিশাপ
বিষাইছে দিনের পৃথিবী।
রাত্রির আকাশ।
এ কোন সভ্যতা আজ মানুষের চরম সত্তাকে
করে পরিহাস?
কোন ইবলিস আজ মানুষেরে ফেলে মৃত্যুপাকে
করে পরিহাস?
কোন আজাজিল আজ লাথি মারে মানুষের শবে?
ভিজায়ে কুৎসিত দেহ শোণিত আসবে
কোন প্রেত অট্টহাসি হাসে?
মানুষের আর্তনাদ জেগে ওঠে আকাশে আকাশে।
কোন প্রবৃত্তির কাছে আজ ওরা পড়িয়াছে বাঁধা?
গোলাবের পাপড়িতে ছুড়িতেছে আবর্জনা, কাদা
কোন শয়তান?
বিষাক্ত কামনা দিয়ে কে ভরায় আকাশের রঙিন খিলান?
কার হাতে হাত দিয়ে নারী চলে কাম সহচরী?
কোন সভ্যতার?
পাঁজড়ার হাড় কেটে নৃত্য সুর জেগে ওঠে কার?
শ্রমীকের রক্তপাতে পান-পাত্র রেঙে ওঠে কার?
কোন সভ্যতার?
মানুষ তোমার হাতে করিয়ছে কবে আত্মদান,
তারই শোধ তুলে নাও হে জড়-সভ্যতা শয়তান।
শিশুর শোণিত হেসে অনায়াসে করিতেছে পান,
ধর্ষিতা নারীর  দেহে অত্যাচার করিছ অম্লান,
জনতার সিঁড়ি বেয়ে উর্ধ্বে উঠি অতি অনায়াসে
তারে তুমি ফেলে যাও পথ-প্রান্তে নর্দমার পাশে।
জড়পিন্ড হে নিঃস্ব সভ্যতা।
তুমি কার দাস?
অথবা তোমারি দাস কোন পশুদল।
মানুষের কী নিকৃষ্ট স্তর।
যার অত্যাচারে আজ প্রশান্তি; মাটির ঘর: জীবন্ত কবর
মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে ধরণীর ‘পর।
সুসজ্জিত-তনু যারা এই জড় সভ্যতার দাস,
যাদের পায়ের চাপে ডুকরিয়া কেঁদে ওঠে পৃথিবী, আকাশ,
তারা দেখে নাকো চেয়ে কী কলুষ দুর্গন্ধ পুরীষে
তাদের সমগ্র সত্তা পশুদের মাঝে চলে মিশে।
কক্কুর, কুক্কুরী
কোন ব্যাভিচারে তারা পরস্পর হানিতেছে ছলনার ছুরি,
আনিছে জারজ কোন মৃত সভ্যতার পদতলে।
উরুর ইঙ্গিত দিয়ে তাদের নারীরা আজ মৃত্যুপথে চলে,
মানুষের পথ ছেড়ে বহু নিম্নে মৃত্যুর অতলে।
তাহাদেরি শোষণের ত্রাস
করিয়াছে গ্রাস
প্রশান্তির ঘর,
যেথা মুখ গুঁজে আছে শীর্ণ শব ধরণীর ‘পর।
হে জড় সভ্যতা।
মৃত-সভ্যতার দাস স্ফীতমেদ শোষক সমাজ।
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ।
তারপর আসিলে সময়
বিশ্বময়
তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিন্ডে পদাঘাত হানি
নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বার-প্রান্তে টানি;
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও;
ধ্বংস হও
তুমি ধ্বংস হও ॥

স্বর্ণ ঈগল / ফররুখ আহমদ

আল-বোরজের চূড়া পার হ’ল যে স্বর্ণ-ঈগল
গতির বিদ্যুৎ নিয়ে, উদ্দাম ঝড়ের পাখা মেলে,
ডানা-ভাঙা আজ সে ধুলায় যায় তারে পায় ঠেলে
কঠিন হেলার কোটি গর্বোদ্ধত পিশাচের দল।
মাটিতে লুটানো আজ সেই স্বর্ণপক্ষ, তনুতল!
আলো, বাতাসের সাথী, তুফানের সওয়ার নির্ভীক
অস্তিম লগ্নের ছায়া দেখে আজ সে মৃত্যু-যাত্রিক,
অতল কূপের তীরে পাষাণ-সমাধি, জগদ্দল।
সূর্য আজ ডুব দিল অক্সাসের তটরেখা পারে,
আসন্ন সন্ধ্যায় কালি নিয়ে এল পুঞ্জীভূত শোক,
পাহাড় ভুলের বোঝা রুদ্ধপথে দাঁড়ালো নির্মম।
এখানে বহে না হাওয়া এ বিস্তীর্ণ প্রন্তরের ধারে,
এই অজগর রাত্রি গ্রাসিয়াছে সকল আলোক,
সোহরাবের লাশ নিয়ে জেগে আছে নিঃসঙ্গ রুস্তম।

পাঞ্জেরী / ফররুখ আহমদ

রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে:
অসীম কুয়াশা জাগে শুন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
দীঘল রাতের শ্রান্ত সফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা প’ড়েছি এসে?
একী ঘন-সিয়া জিন্দিগানীর বা’ব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব,
অস্ফুট হ’য়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
বন্দরে ব’সে যাত্রীরা দিন গোণে,
বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে;
বুঝি কুয়াশায় জোছনা-মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।
আহা পেরেশান মুসাফির দল
দরিয়া কিনারে জাগে তকদিরে
নিরাশার ছবি এঁকে।
পথহারা এই দরিয়া-সোঁতায় ঘুরে
চ’লেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
মুসাফির দল ব’সে আছে কুল ঘেরি।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
একাকী রাতের ম্লান জুলমাত হেরি।
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
শুধু গাফলতে, শুধু খেয়ালের ভুলে
দরিয়া অথই ভ্রান্তি নিয়াছি তুলে,
আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী;
মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি’
কেঁদেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারী,
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাকার,-ওকি
রোণাজার ক্ষুধিতের!
ওকি দরিয়ার গর্জন,- ওকি বেদনা মজলুমের!
ওকি ক্ষুধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী!
পাঞ্জেরী!
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি;
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি;
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরী, কত দেরী ॥

পুরানো মাজারে / ফররুখ আহমদ

পুরানো মাজারে শুয়ে মানুষের কয়খানা হাড়
শোনে এক রাতজাগা পাখীর আওয়াজ। নামে তার
ঘনীভূত রাত্রি আরো ঘন হ’য়ে স্মৃতির পাহাড়।
এই সব রাত্রি শুধু একমনে কথা কহিবার
নিজেদের সাথে। জানি; – মুসাফির-ধূলির অতিথি
প্রচুর বিভ্রমে, লাস্যে দেখেছিল যে তন্বী পৃথিবী
পুঞ্জীভূত স্মৃতি তার জীবনের ব্যর্থ শোক-গীতি:
রাতজাগা পাখীর আওয়াজ: জমা আঁধারের ঢিবি –
যেন এক বালুচর, দুই পাশে তরঙ্গ-সঙ্কুল
জীবনের খরস্রোত, নিষ্প্রাণ বিশুভ্র বালুচরে
কাফনের পাশ দিয়ে বেজে চলে দৃঢ় পাখোয়াজ।
পুরানো ইটের কোলে শোনে কারা সংখ্যাহীন ভুল
ঝরেছে অপরাজেয় অগণিত মৃত্যুর গহ্বরে।
মাজারে কাঁপায়ে তোলে রাতজাগা পাখীর আওয়াজ।।

Create a website or blog at WordPress.com

Up ↑

%d bloggers like this: